দেশের উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে আজও নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি তৈরি হয়নি। অথচ বিচারপতি নিয়োগে সংবিধানে আইন তৈরির কথা বলা হয়েছে। নীতিমালা তৈরির দাবিতে করা রিটে হাইকোর্ট সাত দফা পর্যবেক্ষণ দেন, কিন্তু সেটারও বাস্তবায়ন নেই। ফলে অনেকটা অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগ হওয়ায় বারবারই প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ হচ্ছে বলে খবর ছড়িয়েছে। এ অবস্থায় আইনজীবীরা বিচারপতি নিয়োগের আগেই একটি নীতিমালা করার দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা নয়, আইন করার কথা ভাবা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে নিয়োগ সামনে হবে, সেটার আগে বোধ হয় এ আইন হচ্ছে না। এটা করতে সময় লাগবে। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সংবিধানে স্পষ্টভাবে আইন করার কথা বলা আছে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে। কিন্তু কোনো সরকারই এটি করছে না নিয়োগে দলীয় প্রভাব বজায় রাখার জন্য। এতে অনেক অযোগ্য, অদক্ষরা বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন- যেটা সরকারদলীয় আইনজীবীরাও চান না। সবাই চান দক্ষ ও যোগ্য বিচারপতি নিয়োগ হোক। এ জন্য আইন বা নীতিমালা প্রয়োজন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছি। আশা করি, সরকার দ্রুতই এটি করার উদ্যোগ নেবে।
সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদে বিচারপতি নিয়োগে আইন তৈরির কথা বলা আছে। এই অনুচ্ছেদের ‘গ’ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে, তিনি বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।’ কিন্তু সংবিধানের এই বিধান আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১২ সালের ৩ জুলাই আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়
সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু ‘সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিল-২০১২’ নামের একটি বেসরকারি বিল সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখায় জমা দেন। এতে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকের পদসংখ্যা নির্ধারণ ও রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করতে কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে খসড়া নীতিমালা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়। এতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের বিচারক নিয়োগের বিধান অনুসরণ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি, আইনবিদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে খসড়াটি করা হয়েছিল। কিন্তু তা চূড়ান্ত হয়নি। এর পর ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট আইন কমিশন থেকেও বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এটিও আমলে নেওয়া হয়নি।
উচ্চ আদালত থেকেও পৃথক রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা এসেছে। ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো বিচারপতি নিয়োগে গাইডলাইন দেন আপিল বিভাগ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের অস্থায়ী ১০ বিচারপতিকে বাদ দেওয়া সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এমএম রুহুল আমীনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ওই গাইডলাইন দেন। এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নেবেন এবং তারা পরস্পর চিঠিপত্রের মাধ্যমে বা টেবিলে বসে পরামর্শ করতে পারেন। তবে এই শলাপরামর্শের প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করতে তাদের মধ্যেকার আলাপ-আলোচনার রেকর্ড রাখতে হবে, যাতে বিরোধ বা মতানৈক্য দেখা দিলে কোনো দ্ব্যর্থকতা ছাড়াই তা নিরসন করা যায়।’
এর পর আরও কয়েকটি রায়ে এ বিষয়ে নিদের্শনা দেওয়া হয়। সবশেষ ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের দাবিতে করা একটি রিটে ৭টি পর্যবেক্ষণ দেন হাইকোর্ট। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি গভীর আস্থা আছে- এমন ব্যক্তি হতে হবে। নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তের অবশ্যই উজ্জ্বল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা, সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দক্ষতা, স্পষ্ট আইনি ধারণা এবং সততা থাকতে হবে। সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে আগ্রহী ব্যক্তিদের জীবনবৃত্তান্ত আহ্বানের প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। এর মধ্য থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ের জন্য প্রধান বিচারপতি ইচ্ছে করলে সাক্ষাতের জন্য ডাকতে পারেন। পেশাগত জীবনে একজন ব্যক্তির অর্জিত দক্ষতা ও পারদর্শিতাকে প্রথমত বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বিচারকের পরিপক্বতা, পেশাগত অভিজ্ঞতার হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়স সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত। অধস্তন আদালত থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান যোগ্যতা হওয়া উচিত সততা; দ্বিতীয়ত থাকতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রোফাইল, পেশাদারিত্ব, সততা ও দক্ষতা। এই সাত দফা ছাড়াও রায়ে বলা হয়, উচ্চ আদালতে মেধাবী আইনজীবীদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাদের বেতন যত স্মার্ট করা সম্ভব তা করতে হবে।
ওই রিটের পক্ষে শুনানিকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম বলেন, পর্যবেক্ষণগুলো আপিল বিভাগও বহাল রেখেছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। যারা বিচারপতি হন, তাদের কীভাবে বাছাই করা হয়, কীভাবে তাদের বায়োডাটা নেওয়া হয়, আগ্রহীরা কীভাবে আবেদন করবেন- এসব প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। হাসান আজিম আরও বলেন, আগে আইনজীবী হিসেবে যারা ভালো করতেন, প্রধান বিচারপতি তাদের ডেকে কথা বলতেন, নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করতেন। এখন এটি হয় না। একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আইনজীবী যিনি বিচারপতি হতে চান, তিনি তো দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবেন না। তার ইচ্ছাটা প্রকাশের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকতে হবে। আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতির কাছে অন্তত বায়োডাটা দাখিলের সুযোগ দেওয়া উচিত। এটি সাত দফা পর্যবেক্ষণের মধ্যেও রয়েছে।