গত অক্টোবর ৪, ২০২১ সালে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) দেশের অন্যতম নাগরিক সমাজের সংগঠন আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল। এতে অংশ নিয়েছিল দেশের বিশিষ্ট নাগরিক সম্প্রদায়ের মানুষ। বিষয়টি ছিল সংবিধানের ধারা ১১৮(১)-এ বর্ণিত নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া, বিশেষ করে ওই ধারা-উপধারায় বর্ণিত একটি আইন প্রস্তুত করে পরবর্তী নির্বাচন কমিশনকে নিয়োগ দেওয়া। যদিও গত দুই নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল কিন্তু ওই দুই কমিশন তাদেরই দুর্বলতার কারণে জনগণের, বিশেষ করে ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এর কারণ, বিশেষজ্ঞদের মতে প্রক্রিয়াটি এবং কথিত দুটি সার্চ কমিটি যেমন সংবিধানের আওতায় গঠিত হয়নি, তেমনি তাদের মাধ্যমে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি। এরই প্রেক্ষাপটে ‘সুজন’ একটি আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া এবং একটি খসড়া সুপারিশ আকারে উপস্থাপন করে এবং খসড়াকে ঘিরেই আলোচনা হয়। উপস্থিত বক্তারা সবাই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্য মতামত ব্যক্ত করেন। এই আলোচনার কয়েকদিন আগে দেশের ৪৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি আইন তৈরি এবং এরই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনের মতামত প্রকাশ করেন।
স্মরণযোগ্য যে, বাংলাদেশের দশম নির্বাচন কমিশন (শামসুল হুদা কমিশন) ২০১১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিষ্ঠিত আইনের খসড়াসহকারে সুপারিশ উপস্থাপন করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওই সুপারিশ কার্যকর অথবা আলোচিত হতে দেখা যায়নি।
যাহোক শাসক দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী তার প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন যে, এবারও আগের প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন নিয়োগ হবে। তবে আইনমন্ত্রী তার ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, তিনি মনে করেন অবশ্যই একটি আইন হওয়া উচিত তবে এ স্বল্প সময়ে সেটি সম্ভব নয়। এটা অবশ্য তার মতামত। তথাপি আমি মনে করি সুজন আইনের একটি খসড়া উপস্থাপন করেছে, তার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেওয়া যেতে পারে। তবে সুজনের খসড়ার সঙ্গে আমার মতামতে তফাত রয়েছে। সেখানেই একটি সার্চ কমিটি এবং তার গঠন প্রক্রিয়া, যেখানে প্রায় সব স্টেকহোল্ডারকে প্রতিনিধি রাখার কথা বলা হয়েছে। তার মাধ্যমে নির্বাচিত নামগুলো সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়োগের জন্য পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।
এর বিপরীতে আমার মনে হয়, এই নির্বাচন পদ্ধতির আইন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তিন ধাপে হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, প্রস্তাবিত সিলেক্ট বা সার্চ কমিটি যেসব নাম কমিটি সদস্যদের মধ্য থেকে অথবা বিবিধ উপায়ে প্রাপ্ত নাম, যোগ্যতার মাপকাঠিতে উতরিয়ে গেলে নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি পদের জন্য ন্যূনতম তিনটি নাম নির্বাচন করে দ্বিতীয় ধাপে সংসদীয় কমিটিতে প্রেরণ করা। বিদ্যমান কোনো সংসদীয় কমিটি যেখানে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার উপস্থিতিতে সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে হয় একমত অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়োগের জন্য পাঠাবেন।
যেহেতু আইনের আওতায় এ প্রক্রিয়ায় সরকারপ্রধানের উপস্থিতি এবং বিরোধীদলীয় নেতার নেতৃত্বে সংসদের অন্যান্য বিরোধী দলের সদস্য থাকবেন সেখানে একতরফা, অস্বচ্ছ এবং অন্য প্রক্রিয়া সংবিধানের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সর্বসম্মতিক্রমে নিয়োজিত হবে। এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের ওপর প্রথম থেকেই হয়তো জনগণে আস্থার সংকট তৈরি হবে না। যার অভাব দেশের প্রতিটি কমিশন গঠনের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেছে, বিশেষ করে গত দুই কমিশন গঠনের বর্তমান সরকার কর্তৃক (রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে) নিয়োগপ্রাপ্ত, পর থেকে কমিশন আস্থার সংকটে পতিত হয়েছিল, যার কারণে ওই দুই নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্মকা-ের ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারেনি। এমনকি তাদের তদারকিতে কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। বর্তমান কমিশন নিয়ে যে ধরনের সমালোচনা হয় তা মোটেই কাম্য নয়। এমনকি কমিশনের নিজেদের বিপরীতধর্মী বক্তব্য পরিস্থিতিকে অস্বচ্ছ, অগ্রহণযোগ্য এবং আস্থাহীনতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। ভোটাদের আস্থা না থাকায় এবং পরিচালনার ব্যর্থতার কারণে নির্বাচনের প্রতি একেবারেই আস্থা নেই, যে কারণে নির্বাচনের ফলাফলকে যেমন একতরফা মনে করা হয়, তেমনি ভোটার উপস্থিতির হার নিয়েও ব্যাপক সন্দেহ পোষণ করা হয়। বাস্তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ভোটাররা নির্বাচনেই আসেনি। অনেক পত্রপত্রিকার মতে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শতভাগের ওপরও ভোট পড়েছে। এগুলো কীভাবে সম্ভব তা নির্বাচন কমিশন খতিয়ে দেখেছে কিনা, দেখলেও তা জনগণের সামনে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা হয়নি।
নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, ত্রুটিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য না হয় এবং নির্বাচন কমিশন যদি সম্পূর্ণ না হলেও অন্তত তাকে প্রদত্ত আইনি শক্তি ব্যবহার না করে তবে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যারা গবেষণা করে এমন বিশেষজ্ঞ যেমন পিসি মাঙ্ক (২০০৬), গুইলেরমো ও ডোনেল (২০০২), পিপা নরিস (২০১৬), আর্নল্ড সেডলার (২০০৬) সালের গবেষণায় সমষ্টিগতভাবে বলেন যে, যারা নির্বাচন পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’ এবং ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের’ মধ্যে যে সূক্ষ্ম বিভাজন তবে কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ‘গণতান্ত্রিক চেহারা স্বৈরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের কারণে যে উদার গণতন্ত্র ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের’ জন্ম দেয় সে দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপরই বর্তায়। তবে এ কথাও ঠিক যে, শুধু নির্বাচন কমিশনের একার ওপর গ্রহণযোগ্য ভালো নির্বাচন নির্ভর করে না।
সব শরিক, যার মধ্যে ভোটাররাও রয়েছেন, রয়েছেন মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এবং প্রধানত নির্বাচনকালীন সরকারের মনোভাবের ওপর। তথাপি নির্বাচনের যে কোনো ফলাফলের দায়-দায়িত্ব বর্তায় নির্বাচন কমিশনের ওপর।
একটি নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে শরিকদের সহযোগিতা অপরিহার্য। এ কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। মোজাফফর শাহীন এবং আর্নল্ড সেডলার (২০০২) তাদের তত্ত্ব (ঞযবড়ৎু) ‘নির্বাচন প্রশাসন’ ((ঊষবপঃড়ৎধষ মড়াবৎহসধহপব) বলেন যে, একটি নির্বাচন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার সব ধাপ সঠিকভাবে প্রণীত হলেও প্রধান শরিকদের নিঃশর্ত সহযোগিতা ছাড়া শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন কমিশনও ভালো নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তাদের গবেষণা ও মতামতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকরা একমত পোষণ করেন, যেমন এএসকে নরম্যান (২০০৩, ২০০৫), ভি মারচেঞ্জি (২০১১) বার্ড কে (২০০৪), ওয়েলিংটন (২০০৪) এবং হেউড (২০০২)। নির্বাচন যদিও একটি সমষ্টিগত দায়িত্ব তবে অধিনায়কের ভূমিকা পালন করে নির্বাচন কমিশন যার অবস্থান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে।
যাহোক বিশ্বব্যাপী নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শক্তিশালী চালিকাশক্তি তার গঠন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। নির্বাচন কমিশনের ওপর বিশ্বাস এবং তাদের শক্তিমত্তা নির্মোহ আইনের প্রয়োগের ওপর নির্ভর করবে কীভাবে শরিকদের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করা বিশ্বাস জোগাতে হবে যে, ভোটাররা নিজের ইচ্ছায় নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে স্বচ্ছন্দে বাড়ি ফিরতে পারবে। এটা সম্ভব একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে। এ কারণে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আইনের মাধ্যমে ন্যূনতম পক্ষে কথায় ও কর্মে নিরপেক্ষ লোকের নিয়োগ বাঞ্ছনীয়।
প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব যে সংবিধান রচিত হয়েছে সেখানে ১১৮ ধারায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। সরকারি-আধাসরকারি কমিশন নয়। কাজেই স্বাধীন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করে এমন লোককে নিয়োগ দেওয়া যায় না যা ইদানীং শোনা যায় বিভিন্ন দল দ্বারা প্রভাবিত লোক নিয়োগ দেওয়ার কথা। বর্তমান কমিশন গঠনের পর এমন দাবি এসেছে রাজনৈতিক দল থেকে। আমার মতে, এমন চিহ্নিত করে নিয়োগ দেওয়া সংবিধানের ধারা ১১৮-এর চেতনার পরিপন্থী। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনেকটা আশার সঞ্চার করে যে, হয়তো সরকারও চাইছে এ বিতর্ক এড়াতে একটি আইন তৈরি করে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন যে, এত অল্প সময়ে হয়তো সম্ভব নয়। তথাপি নাগরিক সমাজের বিশ্বাস যে, সবার সহযোগিতায় কষ্টকর হলেও সম্ভব হতে পারে। তবে যে প্রক্রিয়াতে আমরা আশা করি যে স্বচ্ছতার মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে। একবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় নির্বাচন কমিশন শুধু একটি নির্বাচনই অনুষ্ঠিত করে না, নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে ‘নির্বাচনী প্রশাসনের’ (ঊষবপঃড়ৎধষ মড়াবৎহধহপব)-কে প্রাধান্য দিতে হয় যার পরিধি একটি নির্বাচন হতে পরবর্তী পর্যন্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা নির্ধারিত পাঁচ বছর সময়কালে। (সূত্র : ইলেকট্ররাল গভার্নেন্স ইন সাউথ এশিয়া : এ কমপেরেটিভ স্টাডি অব বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল অ্যান্ড পাকিস্তান (২০২১); প্রথমা প্রকাশন।
এম সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)