রাজধানী ঢাকা ও অন্য তিনটি বড় শহর বাদে গোটা বাংলাদেশকেই গ্রামবাংলা হিসেবে ধরা যায়। দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। কিন্তু তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অভাব-অভিযোগ, ব্যথা-বেদনার কথা ক’জনইবা খোঁজ রাখেন। গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে বসবাসকারী এসব অবহেলিত মানুষের ছোট ছোট টুকরো খবর কুড়িয়ে এনে প্রকাশ করেন মফস্বল সাংবাদিকরা। এমনি টুকরো টুকরো নানা ছবির মধ্যে ছড়িয়ে আছে তাদের সুখ-দুঃখ আশা-বেদনার গল্পগাথা।
১৯৭৩ সাল। ৪৮ বছর আগে চারটি সংবাদ তৎকালীন দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ছাপা হয়। খবরগুলো ওই সময় যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। ওই সব সংবাদে তৎকালীন গ্রামবাংলার সমাজচিত্র ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ধরা পড়ে। দৈনিক বাংলার বাণীর তৎকালীন যশোর প্রতিনিধি মোহাম্মদ মসিউল আযম খবরগুলো সংগ্রহ করেন।
মায়ের শেষ আবেদন
মেয়েটি জন্ম অবধি নতুন কাপড় পরেনি। যশোর, ১৩ সেপ্টেম্বর, সরকারি নির্দেশ থাকা সত্তে¡¡ও যশোর কোতোয়ালি থানার লেবুতলা-হৈবতপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলে কাফনের কাপড় মজুদ রাখা হয় না বলে ইউনিয়নের অধিবাসীরা অভিযোগ করেছেন। এর ফলে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা অধিক মূল্যে কাপড় সংগ্রহ করতে পারেন না বলেই অনেক মুর্দাকে পুরনো কাপড়েই দাফন সমাধা করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। স¤প্রতি ওই ইউনিয়নের ছোট হৈবতপুর গ্রামের জনৈক আফতাব বিশ্বাসের তিন বছরের একটি কন্যাসন্তানের মৃত্যুর পর তার আত্মীয়-স্বজনরা লাশটি দাফনের জন্য কাপড় সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের ইউনিয়ন থেকে দাফনের কাপড় সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে আশেপাশের ইউনিয়নের শরণাপন্ন হন। কিন্তু এক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরেক ইউনিয়নের কাফনের কাপড় দিতে অস্বীকৃতি জানান। অতঃপর তারা সেখান থেকে ফিরে আসেন বিফল মনোরথ হয়ে। অবশেষে আত্মীয়-স্বজনরা লাশটি পুরনো কাপড়েই দাফন করার মনস্থ করেন এবং এ কথা মৃত কন্যার মাকে জানানো হলে তিনি ঢুকরে কেঁদে ওঠে বলেন, ‘মেয়েটি জন্ম অবধি নতুন কাপড় পরেনি, আজ ওকে নতুন কাপড় পরিয়ে দাও।’ মায়ের এই অনুরোধে অনেকেরই চোখে সেদিন পানি এসেছিল। এই দৃশ্য দেখার পর আত্মীয়দের একজনের করুণায় হৃদয় বিগলিত হয়। তখনকার মতো দাফন স্থগিত রেখে তিনি ছুটে যান পাশের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে। তার হাতে-পায়ে ধরে চেয়ে আনেন একগজ মার্কিন কাপড়। একটি মানুষের কাফনের জন্য প্রয়োজন সাড়ে তিন গজ মার্কিন। তবু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক গজেই সারতে হয়।
শুধু লেবুতলা-হৈবতপুর ইউনিয়নেই নয়, যশোরের পল্লীতে পল্লীতে আজ চলছে দারুণ বস্ত্রসঙ্কট। অনেক মহিলাই বস্ত্রাভাবে তাদের আব্রু রক্ষা করতে পারছেন না। আর দুস্থ পরিবারের কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে কাফনের কাপড় কেনা সম্ভব না হওয়ার দরুন পুরনো কাপড়েই অনেকেরই দাফন সমাধান করতে হচ্ছে।
নূরজাহান অপবাদ সহ্য করতে পারেনি
যশোর, ১৭ জুলাই, নূরজাহান চেয়েছিল এ দেশের আর পাঁচটি মেয়ের মতো একটু আশ্রয়, একটি নীড়, মোটা কাপড়, আর মোটা ভাত। এর বেশি তার আর কাম্য নয়। কিন্তু দারিদ্র্য বাদ সাধল- স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। যশোর কোতোয়ালি থানার চূড়ামনকাটি ইউনিয়নের গোবিলা গ্রামে দরিদ্র পিতার ঘরে সে জন্মেছে। পিতা জীবিত নেই। বাপের আদরের মেয়ে নূরজাহান নূরীর (২০) বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামের জনৈক চাঁদ আলীর সাথে। অবশ্য সে ছিল তার চতুর্থ স্ত্রী।
একপর্যায়ে স্বামীর সাথে মনোমালিন্যের ফলে অভিমানী নূরী বাপের বাড়িতে চলে আসে সপ্তাহখানেক আগে। এখানেও অভাব অনটন। বাপের সংসারে সাত-আট প্রাণীর সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি সে। পাড়া-পড়শি গৃহস্থের বাড়িতে কাজকর্ম করে যা পায় তাই দিয়ে আধপেটা খেয়ে বাকি অংশ নিজের আদরের ভাই-বোনদের জন্য বেঁধে আনে। ঘটনার দিন নূরী পেয়েছিল প্রতিবেশী গৃহস্থের বাড়িতে ‘ভুরা’ ভানার কাজ। হঠাৎ মনের অজান্তে এক অসতর্ক মুহূর্তে কিছু ভুরার চাল সরিয়ে ফেলে। কিন্তু গৃহস্থরা তার এই চুরি ধরে ফেলে চুরির অপবাদ দেয়। সে চুরি করতে পারে, ভুল করতে পারে পেটের দায়ে- ক্ষুধার তাড়নায়। কিন্তু অপবাদ সে সইতে পারে না। আর পারেনি বলেই এই ভুবনের হাজার ফুটন্ত ফুলের মাঝ থেকে নিঃশব্দে ঝরে পড়েছে। যে মেয়ে কঠোর পরিশ্রমে নুয়ে পড়েনি, কিন্তু সামান্য চুরির অপবাদে সে মুষড়ে পড়েছে। বারবার বলতে থাকে সামান্য ভুুরার চাল নিয়ে চোর অপবাদ পেলাম। এ পোড়া মুখ আর দেখাব না। সে দরিদ্র। কিন্তু আত্মসম্মান তার অনেক বড়। তাই সে এ অপবাদ থেকে চরি নিষ্কৃতির জন্য গত ৭ জুলাই রোববার এনড্রিন পানে আত্মহত্যা করেছে। অপবাদ হতে সে পেয়েছে চির মুক্তি।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় ফিচারটি ছাপা হয়। তখন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির জাতীয় কার্যকরী কমিটির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও যশোর জেলা জেলার কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
তিনি পিস্তল বের করে বললেন…
১৯৭৩ সালে সমসাময়িক সময়ে বাংলার বাণীতে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি সংবাদ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন সময়ে। সাতক্ষীরা জেলার এক যুবলীগ নেতা যশোর বিমানবন্দরে আসেন বিমানের যাত্রী হিসেবে। তিনি এমন মুহূর্তে বিমানবন্দরে পৌঁছান তখন বিমানে আরোহণের সিঁড়ি নেমে গেছে। বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। যুবলীগ নেতা বিমানবন্দরে কর্তব্যরত কর্মীদের সামনে পিস্তল বের করে বললেন, বিমানের দরজা খুলে দিতে। তারা জানালেন, এর কোনো নিয়ম নেই বন্ধ দরজা খোলার।
ঘটনাটি আমার কানে আসার পরই আমি বিস্তারিত জেনে পত্রিকার জন্য একটি স্টোরি তৈরি করে টেলিফোনে সেটি পাঠাই। পরদিনই খরবটি প্রকাশিত হয়। বাংলার বাণীর পত্রিকা সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে মৌখিক একটি নির্দেশনা দেন- ‘আপনি যা দেখবেন তাই-ই লিখবেন। তিনি আমার দলের নেতাকর্মী যেই হোন না কেন।’ তার এই নির্দেশনা আমাকে অনেকটা সাহসী করে তুলেছিল। আমি যতদূর সম্ভব তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করেছি। যশোর শহরের এক যুবলীগ নেতা কাপড়ের লাইসেন্স পেয়ে চট্টগ্রামে সমস্ত কাপড় তুলে সেখানে তা বিক্রি করে দেন। আমি নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ খবর জানার পর পত্রিকায় খবর পাঠালাম। ‘যুবনেতা হোলসেল করে দিয়েছেন চট্টগ্রামে’।
নড়াইল জেলা যুবলীগ একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। যুব লীগ প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি ওই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে যোগদান করবেন। তখন নড়াইল জেলার বাংলার বাণী কোনো প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়নি। ঢাকা পত্রিকা অফিস থেকে আমাকে ওই সম্মেলনের খবর সংগ্রহের জন্যে দায়িত্ব দেয়া হয়। যশোর সার্কিট হাউজ থেকে সকাল ৯টায় নড়াইলের উদ্দেশে গাড়ি বহরে সফরসঙ্গী হয়ে রওনা হই। সম্মেলন শেষে ওই দিন বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরে যাবেন বাংলার বাণী সম্পাদক। দুপুরের খাবার ব্যবস্থা থাকে যশোর সার্কিট হাউজে। তার সফরসঙ্গীরা সবাই যখন খাবার টেবিলে, একমাত্র আমি এক কোনায় বসে খবর লেখায় ব্যস্ত। আমার লক্ষ্য হলো- এই সম্মেলনের খবর দ্রুত লেখা শেষ করে ঢাকা থেকে আগতদের হাতে ধরিয়ে দেয়া। কেননা, খোদ সম্পাদক এসেছেন যশোর-নড়াইলে। শেখ ফজলুল হক মনি দেখলেন- আমি দুপুরের খাবার না খেয়ে লেখালেখি করছি। তিনি বললেন, আপনি তো খাননি। বললাম, আমি খেতে গেলে নিউজের প্যাকেট হাতে হাতে দিতে পারব না। তিনি তখনই আমার পকেটে ১০০ টাকার একটি নোট গুঁজে দিলেন। আমি না না বলতেই তিনি আমার পকেট চেপে ধরে বললেন, আমি বলছি; আপনি রাখেন। আমি বললাম, দুপুরের খাবার খেতে এত টাকা লাগবে না। তিনি পুনরায় বললেন, আপনি রাখেন। শেখ ফজলুল হক মনির আমার প্রতি দুর্বলতা ছিল দু’টি কারণে। একটি হলো- আমি একজন কলেজশিক্ষক। আবার তার পত্রিকার সংবাদদাতা। আরেকটি হলো- যুব প্রেসিডিয়ামের অন্যতম নেতা ফকির আবদুর রাজ্জাক ছিলেন আমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। তিনি দেশ স্বাধীনের পর সরকারি কলেজে শিক্ষকতার পেশায় যোগদান করেন। পরবর্তীকালে শেখ ফজলুল হক মনির অনুরোধে সরকারি চাকরি ছেড়ে বাংলার বাণী পত্রিকায় সহযোগী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তিনি আমাকে ফজলুল হক মনির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ফজলুল হক মনি একদিন পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সবাইকে ডেকে জানালেন- আপনারা যশোরের এই অধ্যাপক সাংবাদিকের প্রতি একটু খেয়াল রাখবেন। ফলে বাংলার বাণী পত্রিকায় সবার কাছে ছিল আমার একটি বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা। তা ছাড়া স্বাধীনতার পর দেশে বিভিন্ন সমস্যা, যুবলীগের সভা-সম্মেলনের খবর প্রায় প্রতিদিনিই পত্রিকায় ছাপা হতো। তখনকার যশোরে হাতেগোনা সাংবাদিকদের সাথে সংবাদ ছাপার ক্ষেত্রে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল।
আমাদের কালের সাংবাদিকরা অনেকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বৃহত্তর যশোর জেলার মাত্র চার-পাঁচজন জীবিত আছেন। দেশ ও সমাজের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব ছিল; তা লেখনীর মাধ্যমে পূরণ করতে পারিনি। তাই এখনকার সাংবাদিকসমাজের প্রতি প্রত্যাশা, আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে- তবেই ওই সব স্বপ্ন পূরণ হবে।
লেখক : সাংবাদিক, সাবেক কলেজশিক্ষক ও উন্নয়নকর্মী