বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে দুটি অর্থবছর শেষ করেছে, তৃতীয় অর্থবছর চলমান। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে নির্বাচনী ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে উন্নয়ন বাজেটে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। চারটিতে বরাদ্দ এক শতাংশের নিচে। একটি এক শতাংশের ওপরে, একটি ৩ শতাংশের সামান্য বেশি। অপরটিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ হয়েছে ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত মোট বরাদ্দ ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, বিগত সময়ে করোনার কারণে যদি বরাদ্দ না হয়ে থাকে, তা হলে আগামী দুটি বাজেটে বরাদ্দ দিয়ে দেশের সর্বস্তরে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে। সর্বশেষ নির্বাচনের আগে দলটি ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। সরকার গঠন করতে সক্ষম হলে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা সেখানে সুস্পষ্ট করা হয়।
জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর বর্তমান সরকার এখন পর্যন্ত তিনটি অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছে (২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছর)। ওই তিনটি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দে নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকারগুলো কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, সম্প্রতি সে বিষয়ে একটি মূল্যায়ন উপস্থাপন করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন সমন্বয়’। সেখানে বলা হয়েছে, নির্বাচনী ইশতেহারের ৩.১৯ অনুচ্ছেদে ‘স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা’ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘লক্ষ্য ও পরিকল্পনা’ উপস্থাপিত
হয়েছে। এগুলোকে ১০টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিভক্ত করা যায়- ১. দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা প্রাপ্তি উন্নত করা; ২. এক বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ওপরে সব বয়ঃগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা;
৩. সব বিভাগীয় শহরে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা; ৪. প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগ, ক্যানসার ও কিডনি চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা; ৫. প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অন্তত ১০০ শয্যার স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যানসার ও কিডনি চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা; ৬. সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং হাসপাতালগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি প্রচলন করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আরও নির্ভুল ও জনবান্ধব করা; ৭. অনলাইনে দেশ-বিদেশ থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসকের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা; ৮. কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ভবনসহ সব সুবিধা পর্যায়ক্রমে আধুনিকীকরণ করা; ৯. আয়ুর্বেদি, ইউনানি, দেশজ ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ অব্যাহত রাখা এবং ১০. গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা কেন্দ্র্রগুলোয় চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি, সেবার মান বৃদ্ধি এবং উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
উন্নয়ন সমন্বয়ের গবেষণা পরিচালক আব্দুল্লাহ নাদভি আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে দুটি বাজেট বাস্তবায়ন করেছে, একটি চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ ইশতেহারকেন্দ্রিক বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে তিনটি ইশতেহারে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর মধ্যে সবার জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা, দেশ-বিদেশে চিকিৎসকদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের আধুনিকীকরণ। হয়তো করোনার কারণে এসব বিষয়ে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। তিনি বলেন, করোনার পাশাপাশি এগুলোতেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজেট বাড়িয়ে হলেও এগুলো বাস্তবায়ন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা উচিত।
উন্নয়ন সমন্বয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান সরকারের বিগত দুটি অর্থবছর এবং চলমান অর্থবছরে এসব খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে- ১. দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা প্রাপ্তি উন্নত করার ক্ষেত্রে বরাদ্দ ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২. এক বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ওপরে সবাইকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার ক্ষেত্রে বরাদ্দ শূন্য শতাংশ। ৩. সব বিভাগীয় শহরে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার ক্ষেত্রে বরাদ্দ শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ। ৪. প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হার্ট, ক্যানসার ও কিডনি চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে বরাদ্দ শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ। ৫. প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অন্তত ১০০ শয্যার স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যানসার ও কিডনি হাসপাতাল স্থাপনে বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ। ৬. সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং হাসপাতালগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি প্রচলন করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আরও নির্ভুল ও জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে বরাদ্দ ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। ৭. অনলাইনে দেশ-বিদেশ থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসকের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বরাদ্দ শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ। ৮. কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ভবনসহ সব সুবিধা পর্যায়ক্রমে আধুনিকীকরণ করার ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ। ৯. আয়ুর্বেদি, ইউনানি, দেশজ ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ অব্যাহত রাখতে বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ। ১০. গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেবার মান বাড়াতে বরাদ্দ ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।
উন্নয়ন সমন্বয় বলছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে আরও দুটি (২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব ও বাস্তবায়ন করা হবে। সেসবে নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে বরাদ্দ থাকবে বলে আশা করা যায়।