মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদে ভোটাভুটিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। এর ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও কংগ্রেসের কাজে বাঁধা দেয়া- এই দুটি অভিযোগে শুরু হলো ট্রাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়া।
বুধবার প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পের অভিশংসন বা ইমপিচমেন্টের পক্ষে রায় দিয়েছেন এমপিরা। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে বড় ধরনের অপরাধের দায়ে পদ থেকে অপসারণ করা যায়। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ নেওয়া অথবা অন্য কোন বড় ধরনের কিম্বা লঘু অপরাধ।
ট্রাম্প তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই প্রক্রিয়ার মুখোমুখী হলেন। এর আগে আরো দু’জন প্রেসিডেন্টের ইমপিচের পক্ষে রায় দিয়েছিল নিম্নকক্ষ। তাদের একজন বিল ক্লিনটন।
এরপর কী হবে?
নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে যে ট্রাম্পের অভিশংসন প্রস্তাব পাস হবে সেটি আগেই ধারণা করা গিয়েছিল। কারণ প্রতিনিধি পরিষদে রয়েছে বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ৪৩৫ আসনের হাউজে সব এমপি উপস্থিত থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে দরকার ২১৮ ভোট। ডেমোক্র্যাটদের এমপি আছেন ২৩৩ জন। তাই এখানে ট্রাম্পের অভিসংশনের পক্ষেই প্রস্তাব পাস হবে সেটি আশা করেছিল সবাই।
এখনো অফিশিয়ালি ফলাফল ঘোষণা করা না হলেও ট্রাম্পের বিপক্ষে পর্যাপ্ত ভোট পড়েছে বলে জানা গেছে।
নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ইমপিচের পক্ষে প্রস্তাব পাস হলে সেটি উঠবে উচ্চকক্ষ সিনেটে। সেখানে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। তার ভিত্তিতে রায় দেবে সিনেট। প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই পাস হতে হবে।
অভিশংসনের ক্ষেত্রে সিনেটের প্রক্রিয়াটি ঠিক পার্লামেন্টের অন্যান্য কাজের মতো নয়। এ বিষয়ে সেটি একটি বিচার প্রক্রিয়া মতো। দুই দলের এমপিরা হবে বিচারক বা জুরি। আর মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সেই প্রক্রিয়ার সভাপতিত্ব করবেন।
সিনেটে কোন প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করতে হলে দুই তৃতীয়াংশ এমপির ভোট লাগবে; কিন্তু ১০০ আসনের সিনেটে আবার ক্ষমতাসীন রিপাবলিকাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাদের আসন অর্ধেকেরও বেশি। (৫৩)। তাই সেখানে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে প্রস্তাবটি, আদতে যা পাস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর ডেমোক্র্যাটদের আছে ৪৫ আসন, স্বতন্ত্র এমপি দুজন।
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়ছে, অন্তত ২০ জন রিপাবলিকান সিনেটর যদি ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দেন তাহলে তাকে ইমপিচ করা যেতে পারে। এই ২০ জন এমপিকে ডেমোক্র্যাটরা রাজি করাতে পারবে কি না সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। রিপাবলিকান সিনেটরদের অনেকেই ট্রাম্পের ঘোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তাদের সাথে ট্রাম্পের বিরোধের খবরও প্রায়ই আসে মিডিয়ায়। তাদের টার্গেট করতে পারে ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার মতো বড় বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেবেন কিনা সেটি বড় একটি প্রশ্ন
কবে শুরু হবে সিনেটের বিচার
সংবিধানে এ বিষয়ে নির্ধারিত কোন সময়নসীমা দেয়া নাই। তবে ডেমোক্র্যাট সিনেটররা জানিয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব এটি করা হবে। সেটি হতে পারে আগামী ৬ জানুয়ারি থেকে। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিস ম্যাককনেল আভাস দিয়েছেন যে, নথিপত্র সিনেটে এসে পৌছলে এই শুনানিই হবে তাদের প্রথম কাজ।
ডেমোক্র্যাট নেতাদের পক্ষ থেকেও একটি পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে এই কাজের। সেটিতেও সম্ভাব্য শুরুর তারিখ হিসেবে ৬ জানুয়ারির কথা বলা হয়েছে। ৯ জানুয়ারির কথাও বলা হচ্ছে কারো পক্ষ থেকে।
কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট
যদি সিনেটেও ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে তাকে পদ ছাড়তে হবে। সেক্ষেত্রে নতুন একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। সিনেটের বিচারে ট্রাম্পের বিপক্ষে রায় এলে মার্কিন সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদের বাকি সময়টুকু প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ২০ জানুয়ারি ২০২১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন ২১ জানুয়ারি থেকে।
বিল ক্নিনটন, এন্ড্রু জনসন ও রিচার্ড নিক্সন
এর আগে সর্বশেষ যে প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তিনি বিল ক্লিনটন। সেটা ১৯৯৮ সালের ঘটনা। ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে ভোট পড়েছিল হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে; কিন্তু সিনেটে তার দল ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বেঁচে যান ক্লিনটন।
এর আগে এরকম ঘটনা ঘটেছিল ১৮৬৮ সালে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসনের বিরুদ্ধেও অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে ক্লিনটন কিংবা জনসন তাদের কাউকেই সিনেটে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
তাই অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু মানে মানেই এটা নয় যে প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সেই নজির নেই। আগে যাদের বিরুদ্ধে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাদের মধ্যে দুই জন বেঁচে গেছেন সিনেটে আর একজন নিজ থেকেই পদত্যাগ করেছেন। এখনও পর্যন্ত কোন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের কারণে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি।
তবে রিচার্ড নিক্সনকে প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো এমনটাই বলা হয়। কুখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়ে ১৯৭৪ সালে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। বিশ্লেষকরা বলেন, ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া সফল হবে সেটি বুঝতে পেরেই নিক্সন পদত্যাগ করেছিলেন।
ওয়াটারগেট নামক হোটেলে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী অফিসে গোপনে নজরদারি অভিযোগ আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে।