রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪১ অপরাহ্ন

কোভিড ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ : কারা কখন পাবেন

লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১
  • ১৫০ বার

প্রাণসংহারী করোনা অতিমারীতে বিশ^ব্যাপী এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি ও মৃত প্রায় ৪৯ লাখেরও বেশি। এ ভয়ঙ্কর অতিমারীকে রুখতে দ্রুতই আবিষ্কৃত হয় এ যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র কোভিড ভ্যাকসিন। এ পর্যন্ত প্রায় ১৮টি ভ্যাকসিন বিশ^ব্যাপী অনুমোদিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ১৮২টি দেশে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনিকা, ১৩৬টি দেশে ফাইজার, ৭৬টি দেশে সিনোফার্ম ও মর্ডানা, ৫৬টি দেশে জনসন অ্যান্ড জনসন, ৪৮টি দেশে স্পুটনিক-ভি, ৪১টি দেশে সিনোব্যাক, ৭টি দেশে ক্যানসিনো ও ভারতের বায়োএন্টেক, ৩টি দেশে সিনোফার্ম-উহান, ২টি করে দেশে জেএফ-২০০১, আবদালা, সোবারানা-২, স্পুটনিক লাইট, ইপি ব্যাক করোনা এবং একটি করে দেশে কোভিরান রাবেকাত, কাজব্যাক ও মেডিজেল প্রয়োগ করা হয়েছে।

কোভিড ভ্যাকসিন তৈরিতে মূলত ৪টি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। যথা- নিষ্ক্রিয় ভাইরাল ভ্যাকসিন, ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন, মেসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন, প্রোটিন ভ্যাকসিন। নিষ্ক্রিয় ভাইরাল ভ্যাকসিন তৈরিতে করোনা জীবাণুর মৃত কোষ ব্যবহার করা হয়। তা শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু প্রতিরোধী কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে অ্যান্টিবডি সৃষ্টিতে সহায়তা করে। সিনোফার্ম, সিনোব্যাক ইত্যাদি এ প্রযুক্তিতে প্রস্তুতকৃত। এ ভ্যাকসিনগুলোর ২ ডোজ প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত। অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনিকা, স্পুটনিক-ভি প্রভৃতি তৈরিতে ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। মানবদেহে ক্ষতিকারক নয়- এমন ভাইরাসের কোষে করোনা ভাইরাসের উপাদান সংযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এ ভ্যাকসিন শরীরে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে আক্রান্ত ভাইরাস ধ্বংসে সক্ষম। অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনিকা পূর্ণাঙ্গ ডোজ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রায় ৮৮ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। করোনা ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফাইজার ও মর্ডানা ভ্যাকসিন তৈরি। এসব ভ্যাকসিন প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর করোনা প্রতিরোধী হিসেবে কার্যকর। করোনা ভাইরাস কোষস্থ প্রোটিনের একাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রোটিন ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। নোভাভ্যাক্স ও স্যানফি জিএসকে প্রযুক্তিতে তৈরি ভ্যাকসিন। দুই ডোজের এ ভ্যাকসিনেরও করোনা ভাইরাসকে ৮০ শতাংশ রুখে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।

বর্তমানে প্রচলিত ও অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলোর কোনোটিই করোনার সব ধরনের বিরুদ্ধে শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। তবে রোগের তীব্রতা, হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যু হ্রাসে ভূমিকা রাখে প্রতিটি ভ্যাকসিন। তাই বলা হচ্ছে, এসব ভ্যাকসিনের ঘোষিত প্রতিরোধ ক্ষমতা বা সুরক্ষার কমতি ঘটলে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হতে পারে। কোনো ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির মাত্রা ও নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর এর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের পর বুস্টার ডোজ প্রদান করা হয়। সাধারণভাবে হেপাটাইটিস, পোলিও, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার ইত্যাদি ভ্যাকসিনে বুস্টার ডোজ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে কোনো ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্তের আগেই যদি হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকে বা প্রমাণ মেলে, তা হলে সুরক্ষার মাত্রা বজায় রাখতে অতিরিক্ত ডোজ ব্যবহার করা হয়।

কোভিড ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস কিংবা প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি ও বজায় রাখার সময়সীমা গুরুত্বপূর্ণ। তবে করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন উদ্ভবের কারণে প্রায় সব ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অবশ্য ভ্যাকসিনের সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতা অনেক উপাদানের ওপর নির্ভর করে- বয়সের প্রভেদ, জনগোষ্ঠীর তারতম্য, ভ্যাকসিন উপাদানের শ্রেণি বিভাগ ইত্যাদি। বুস্টার ডোজ প্রয়োগে ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়টি প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে। মানবদেহে ভ্যাকসিন কর্তৃক তৈরি অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমতে শুরু করলেই ওই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা যে কম, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষমতা বয়স, লিঙ্গ, কো-মরবিডিটি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। তবে কোভিড ভ্যাকসিনের দেহে তৈরি অ্যান্টিবডি কমবেশি ৬ মাস কার্যকর থাকে। এ বিষয়ে সব ভ্যাকসিনই প্রায় নিশ্চিত করে বলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এফডিএ ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স ও কো-মরবিডিটি রয়েছে এবং ক্রমাগত করোনা আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের পূর্ণাঙ্গ ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার ৬ মাস পর মডার্না ও ফাইজার ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ প্রদানের অনুমোদন প্রদান করেছে। সিডিসি ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত তথা স্বাস্থ্যকর্মী, অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্য, পুলিশ, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টাফ, খাদ্য ও কৃষিকর্মী, পরিবহন এবং উৎপাদন শ্রমিক, মুদি দোকানদার ইত্যাদি কাজে নিয়োজিতদের বুস্টার ডোজ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বুস্টার ডোজ প্রদানের আগে ওইসব অঞ্চল বা দেশে সংক্রমণের হার, রোগের তীব্রতা, কো-মরবিডিটি, ঝুঁকির মাত্রা, ভ্যাকসিনের প্রকার ও সংক্রমিত করোনা ভাইরাসের ধরনবিষয়ক তথ্যাদি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন ও ইমিউনাইজেশনবিষয়ক জয়েন্ট কমিটি অ্যাস্ট্রাজেনিকার বুস্টার ডোজের সুপারিশ করেছে সত্যি। কিন্তু কখন বা কাদের জন্য এ বুস্টার ডোজ প্রযোজ্য হবে, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেননি। তবে প্রতিরোধ ক্ষমতায় দুর্বল ব্যক্তিদের তৃতীয় ডোজের বিষয়ে তারা অনুমোদন দিয়েছেন এবং বুস্টার ডোজের বিষয়ে অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিনকে নিরাপদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চীন দুর্বল প্রতিরোধক্ষম ব্যক্তিদের দেহে সিনোফার্মের তৃতীয় ডোজ ব্যবহার শুরু করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ৬ মাস পর বুস্টার ডোজ নেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেছে ওই দেশের নাগরিকদের জন্য।

গবেষণায় দেখা গেছে, বুস্টার ডোজ গ্রহণকারীদের মধ্যে বুস্টার নেয়নি- এমন লোকদের চেয়ে আক্রান্তের হার ১১ গুণ কম ও রোগের তীব্রতা ১৯ দশমিক ৫ গুণ হ্রাস পায়। আরেক গবেষণায় বুস্টার ডোজ গ্রহণকারীদের দেহে ৫ গুণ বেশি অ্যান্টিবডির অস্তিত্ব পাওয়া যায় এবং তৃতীয় ডোজ ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

বুস্টার ডোজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ভ্যাকসিন সরবরাহ ও প্রাপ্তির বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এটি সত্য যে, বৈশি^ক করোনা অতিমারী রোধে বিশে^র সব দেশের সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। বিশে^ এ পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ৩৭৫ কোটি অর্থাৎ ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কমপক্ষে একটি করে ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণে সক্ষম হয়েছে। সম্পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে এমন জনসংখ্যার শতকরা হার ৩৭। বিশে^র প্রায় ২৫টি দেশে ভ্যাকসিন প্রদানের শতকরা হার ১০-এর নিচে, প্রায় ২০টি দেশে<২০-এর নিচে, ১৬টি দেশে<৩০, ৩২টি দেশে অর্ধেক মানুষ অর্থাৎ ৫০ শতাংশ লোককে ভ্যাকসিন প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে এখন পর্যন্ত শতকরা ১১ এবং প্রথম ডোজ শেষ করেছে প্রায় ২৩ ভাগ। ১৯ অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ সম্পন্ন করেছে ৩ কোটি ৯১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৪৮ এবং পূর্ণাঙ্গ ডোজ সম্পন্ন করেছে এমন সংখ্যা ১ কোটি ৯৬ লাখ হাজার ৩২ হাজার ১০৭। সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত যেখানে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ গড়ে ২০ শতাংশ মানুষ প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন সম্পন্ন করেছে, সেখানে উন্নত দেশগুলোর ৮০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছে। তাই এটি নিশ্চিত, বৈশি^কভাবে করোনা রোধে বুস্টার ডোজ প্রদানের বাস্তবতা এখনো নেই। তবে ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করে অতিরিক্ত ডোজ কিংবা বুস্টার ডোজ গ্রহণ শুরু করেছে এমন দেশের সংখ্যাও কম নয়।

বিশে^র সব দেশের মানুষের ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার স্বার্থে ধনী রাষ্ট্রগুলোকে আপাতত বুস্টার ডোজ প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলেছে, বুস্টার ডোজ প্রয়োগ শুরু হলে যেসব দেশের সিংগভাগ মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষায়, সেসব দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এ ক্ষেত্রে বৈশি^ক করোনা অতিমারীর সফল নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল যুদ্ধটিই দীর্ঘায়িত হবে।

লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান : এমফিল, এমপিএইচ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com