শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪০ অপরাহ্ন

ঘরের কোন্দলে বলি আ.লীগের বিদ্রোহীরা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১০ নভেম্বর, ২০২১
  • ১২৩ বার

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতায় নেমেছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী ও মনোনয়ন না পাওয়া ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সমর্থকরা। ফাঁকা মাঠে নিজেদের সঙ্গে নিজেদের লড়াইয়ে একের পর এক প্রাণ যাচ্ছে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের। বিদ্রোহী পক্ষেই প্রাণ ঝরছে বেশি।

অভিযোগ উঠেছে, বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা নির্বাচনী প্রচারে মাঠে নামতেই তেড়ে আসছে দলীয় প্রার্থীর অনুসারীরা। শুধু হুমকিই নয়, কথায় কথায় খুন-খারাবির ঘটনা ঘটছে। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৩০ জনের জীবন গেছে, আহত হয়েছেন হাজারের বেশি মানুষ। অনেকে হয়েছেন পঙ্গু; অনেকে হয়েছেন বাড়িঘরছাড়া।

এদিকে আগামীকাল দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে তৃণমূলের রাজনীতিতে অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ হওয়ায় উদ্বিগ্ন নেতাকর্মী ও ভোটাররা। এতে ক্ষুব্ধ খোদ আওয়ামী লীগের

স্থানীয় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলছেন, একটি ভুল সিদ্ধান্তে নিজ দলের অনেক মুখ হারাতে হলো। অনেককে পঙ্গু হতে হয়েছে। অনেককে দল থেকে দেওয়া হয়েছে অব্যাহতি। দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও মনোনয়ন প্রদানে অস্বচ্ছতাকে দলের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল গোছানোর পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগের। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব কার্যক্রম শেষ করবে- এমন ঘোষণা দিয়েই মাঠে নেমেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতারা। দলীয় প্রতীকের মাধ্যমে ইউপিসহ স্থানীয় নির্বাচন দেওয়ায় সেই পরিকল্পনা অনেকটাই ভেস্তে গেছে। তারা বলছেন, বিদ্রোহীদের অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের আগে স্বচ্ছ মনোনয়ন দরকার ছিল। বিদ্রোহীদের অব্যাহতি দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এ পরিস্থিতির নেপথ্যে যারা আছেন তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন নীতিনির্ধারণীয় পর্যায়ের নেতা এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, একদিকে দলীয় প্রতীক দিয়ে সারাদেশে একটা খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। কিছু এলাকায় উন্মুক্ত করে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ হয়েছে। তৃণমূল থেকে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তাদের নাম বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে নতুন নাম সংযুক্ত করা হয়েছে। সব মিলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, নেত্রী শেখ হাসিনা বারবারই বলে থাকেন তৃণমূলই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। তা হলে সেই শক্তিকে বিভাজিত করছে কারা- প্রশ্ন রাখেন দলের এ নেতা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) ফারুক খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেসব জায়গায় সহিংসতা হয়েছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বেশি সজাগ হওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানিয়েছি। আমি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে মনে করি, নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা থাকতে হবে, দলের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবিচল আস্থা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে যারা মনোনয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তৃণমূল থেকে নাম পাঠান, তাদের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে সহিংসতা হয়, কারণ এসব নির্বাচনে প্রার্থী অনেক হয়ে যায়। দেখা যায় একটি ইউনিয়নে ৫০ জনও প্রার্থী থাকেন। ফলে একে অন্যের মুখোমুখি হয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন।’

বিদ্রোহীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গত ইউনিয়ন নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী ছিল, এবার তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এবার যারা বিদ্রোহী, তারা আগামীবার মনোনয়ন পাবে না। এ বার্তাই আমরা দিচ্ছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর, খুলনা, নাসিনগর, নড়াইল, সিলেট, পটুয়াখালী, বান্দরবান, নওগাঁ, দিনাজপুর, খাগড়াছড়িসহ অন্তত ২০ জেলার ৩ শতাধিক বিদ্রোহীকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে রূপগঞ্জ, কাপ্তাই, যশোর, নরসিংদী, নাটোর, মেহেরপুর, পঞ্চগড়, সিলেট, রাজবাড়ী, জয়পুরহাট, বাগেরহাট, মাদারীপুর, গাইবান্ধাসহ বেশকিছু এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতায় ৩০ জন নিহত হয়েছে। সব মিলিয়ে থমথমে পরিস্থিতি তৃণমূল আওয়ামী লীগে। দলীয় প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা আছেন খোশমেজাজে। অন্যদিকে আতঙ্কে আছেন বিদ্রোহীরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৬৭টি। এতে ৩০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক হাজার ৯৪২ জন। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনগুলো ধরলে এ সংখ্যা আরও বেশি।

কেন বিদ্রোহী

অন্য দল থেকে এসেই মনোনয়ন পাওয়া, দলের বিতর্কিত ব্যক্তিকে ঠেকাতে অথবা নিজেকে বেশি জনপ্রিয় ভাবার মতো কারণেই মূলত আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি। বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাবি, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তারা ভোটের মাঠে জয়ী হবেন।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের চম্পাফুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল লতিফ মোড়ল। আওয়ামী লীগের এ নেতা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তার এলাকায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির পরীক্ষিত নেতা মোজাম্মেল। সেই ক্ষোভ থেকে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু দলীয় প্রার্থীর ভয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারে যেতে পারছেন না। এ বিষয়ে আবদুল লতিফ মোড়ল বলেন, ‘নৌকার টিকিট পেয়ে এক সময়কার বিএনপি নেতা মোজাম্মেল হক নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন। প্রকাশ্যে ভোট ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এ জন্য আমি থানায় জিডি করেছি।’ মোজাম্মেল এ অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ‘আমার প্রতি জেলাসি থেকে এসব অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব সত্য নয়।’

মাদারীপুরের কালকিনী উপজেলার কয়েরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাকির হোসেন। অন্যদিকে এ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন কালকিনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কামরুল হাসান। কামরুল হাসানের দাবি, বেশি জনপ্রিয় হয়েও তিনি মনোনয়ন পাননি। এ কারণে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তার অভিযোগ নির্বাচনী প্রচারে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। কোথাও বের হলেই জাকির হোসেনের লোকেরা মারতে আসেন।

দ্বিতীয় ধাপে যশোরের ঝিকরগাছায় ১১টি ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী ১৪ জন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে আটটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে যশোর-২ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য নাসির উদ্দীনের ভাই ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান একেএম গিয়াস উদ্দীনও আনারস প্রতীকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এ ছাড়া চৌগাছার ১১ ইউপিতে ১৯ বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ীর ১৬ ইউপিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে তানোরের সাতটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৩৪ জন এবং গোদাগাড়ীর নয়টি ইউনিয়নে ৩৮ জন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দুই উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আছেন ২৪ জন। কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় ১৭টি ইউপিতে ১৩ বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন।

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের ১১ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে আটটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৩ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী নওগাঁ, নেত্রকোনা, নরসিংদী, সুনামগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে। নওগাঁর ২০ ইউপিতে ৪২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের ১৭ ইউপিতে ৩৫ জন, পাবনার ১০ ইউপিতে ৩৩ জন, নেত্রকোনার ২৬ ইউপিতে ৩৬ জন, নরসিংদীর ১২ ইউপিতে ৩২ জন এবং সুনামগঞ্জের ১৯টি ইউপিতে ৩৩ বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আগামীকাল দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে সারাদেশের ৮৪৮ ইউনিয়ন পরিষদে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় ৯০০।

সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে এমন ১০ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ নেতারা জানান, কেন্দ্রের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিচ্ছেন জেলা ও উপজেলার নেতারা। বিতর্কিতদের মনোনয়নের প্রসঙ্গ এলে কেন্দ্রীয় নেতারা তৃণমূলের দোষ দিয়ে দেন। কিন্তু তৃণমূল থেকে নাম আসেনি, এমন অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি মনোনয়ন পেয়েছেন। তাদের বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা কী বলবেন বলেও প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

এদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় কিংবা বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ায় গতকালও চার জেলায় ৪০ জনকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের সময়ের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- বগুড়ার : শিবগঞ্জ এবং শেরপুর উপজেলায় ১৪ নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলায় ৯ জন এবং শেরপুরে ৫ জন। গত সোমবার রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু এবং সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

মানিকগঞ্জ : সিংগাইর উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় ৬ ইউনিয়নের আটজনকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। গতকাল দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

বড়াইগ্রাম (নাটোর) : বড়াইগ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় ৪ আওয়ামী লীগ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান স্বাক্ষরিত অব্যাহতিপত্র ওই চার নেতার কাছে পাঠানো হয়।

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : রূপগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীসহ ১৪ জনকে দল থেকে বহিষ্কার ও একজনকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই ও সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহিদ বাদল স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com