শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৪১ অপরাহ্ন

১৩৩ টাকায় মিলছে কনস্টেবলের চাকরি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২১
  • ১০৭ বার

লাখ লাখ টাকা খরচ করে নয়, মেধা ও যোগ্যতা থাকলে মাত্র ১৩৩ টাকা খরচ করেই মিলছে পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি। সংস্কারকৃত নিয়োগ বিধি অনুযায়ী, এ বছর প্রত্যেক প্রার্থীকে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য বিবেচিত হতে সাত ধাপে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এর কোনো একটিতেও উত্তীর্ণ হতে না পারলে তদবির কিংবা টাকা খরচ করেও চাকরি মিলছে না। ইতোমধ্যে দেশের ১০ জেলায় এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। অন্য জেলাগুলোতেও নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। গত ২৫ অক্টোবর শুরু হয়েছে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া। শেষ হবে ২৬ নভেম্বর।

পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালের আগে প্রতিবছরই কনস্টেবল পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যেত। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে প্রভাবশালীরা একাধিক তালিকা ধরিয়ে দিতেন জেলা পুলিশ সুপারদের হাতে। সে অনুযায়ীই দিতে হতো নিয়োগ। শুধু তা-ই নয়, চাকরি নামের এই সোনার হরিণকে পেতে খরচ করতে হতো লাখ লাখ টাকাও। তবে ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্ব নেওয়ার পরই ২০১৮ সালে স্বচ্ছতার সঙ্গে

কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার নতুন নজির সৃষ্টি করেন। এ জন্য দুদক থেকে তাকে প্রশংসাপত্রও দেওয়া হয়। জাবেদ পাটোয়ারীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ড. বেনজীর আহমেদও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। অপেক্ষাকৃত যোগ্য ও মেধাবীরা যেন নিয়োগ পান এ জন্য তিনি সংস্কার করেন নিয়োগবিধি। সে অনুযায়ীই এবার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, খাগড়াছড়ি, খুলনা, ঝিনাইদহ, নওগাঁ, লালমনিরহাট ও পটুয়াখালী জেলায় স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এই ১০ জেলায় ৩৬৫টি পুরুষ কনস্টেবল পদের বিপরীতে ৩ হাজার ৫০৭ জন এবং ৬৪টি নারী কনস্টেবল পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ৩৪৭ প্রার্থী। তাদের মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন ৪২৯ জন। চূড়ান্ত নিয়োগের আগে তাদের পেরোতে হচ্ছে সাতটি ধাপ- প্রাথমিক বাছাই, শারীরিক মাপ, ফিজিক্যাল অ্যানডুরেন্স টেস্ট; লিখিত পরীক্ষা; মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা; প্রাথমিক নির্বাচন; পুলিশ ভেরিফিকেশন; স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চূড়ান্তভাবে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। প্রার্থীদের শারীরিক সক্ষমতাও এ বছর সাতটি ইভেন্টের মধ্য দিয়ে যাচাই করা হচ্ছে- দৌড়, পুশ আপ, লং জাম্প, হাইজাম্প, ড্র্যাগিং এবং রোপ ক্লাইম্বিং। আর সম্পূর্ণ যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় তাই দিনমজুর, কৃষক, অটোভ্যানচালকসহ সাধারণ পরিবারের সন্তানরাই বেশিরভাগ চাকরি পেয়েছেন। কোনো ধরনের তদবির বা অর্থ ছাড়াই পুলিশের চাকরি পাওয়ায় অনেককেই দেখা যায় আনন্দের বাঁধ ভাঙতে। স্বপ্নপূরণ করা সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রুও ঝরিয়েছেন অনেক বাবা-মা।

গরিব কৃষকের মেয়ে সানজিদা আক্তার। বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারি গ্রামে। সাত সদস্যের সংসারে তিনিই বড় মেয়ে। ময়মনসিংহের মুসলিম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এই ছাত্রী নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন টিউশনি করেই। সানজিদার স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করার। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের সদস্য হয়ে ‘সোনার হরিণ’ ধরা কি চাট্টিখানি কথা! মনে ভর করে তাই রাজ্যের দুশ্চিন্তা। লেখাপড়া শেষ করে কোনো চাকরি পাবেন তো? এর মধ্যেই একদিন জানতে পারেনÑ পুলিশের চাকরি পেতে এখন আর কোনো টাকা-পয়সা লগে না। তাই আবেদনপত্র পূরণ করে লাইনে দাঁড়ান। যাচাই-বাছাইয়ে মেধা ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণও হন। ৪ নভেম্বর চূড়ান্ত ফল ঘোষণায় নিজের নাম শোনার পর চোখ অশ্রুতে ভরে যায় সানজিদা ও তার বাবার। তদবির ও কোনো ঘুষ ছাড়া চাকরি পেয়ে তারা অনেক খুশি।

সানজিদার বাবা কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন আইজ। বিনাপয়সায় আমার মাইয়ার চাকরি হইছে। মাগনা চাকরি হয় এইড্যা আইজই দেখলাম।’ সানজিদা বলেন, ‘চাকরিটা হওয়ায় সংসারের হাল ধরতে পারব এখন।’

আরেক উত্তীর্ণ ফুলবাড়িয়ার বিদ্যানন্দ গ্রামের লাভলী আক্তার। দুই ভাই-বোনের মধ্যে বড়। তার বাবা আব্দুল হামিদ একজন আটোভ্যানচালক। বিনাটাকায় চাকরি হওয়ায় তিনি মহাখুশি। তবে চাকরি হবে কিনা এ নিয়ে ছিলেন দোটানায়। পরে পুলিশ লাইন্স মাঠে পুলিশ সুপারের বক্তব্য শুনে টাকা-পয়সা লাগবে না বুঝতে পারেন। যোগ্যতার পরীক্ষায় টিকে গেলেই চাকরিটা হয়ে যাবে। লাভলী আক্তার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করার। বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য হতে পেরে আমি আজ গর্বিত। জীবন বাজি রেখেই কাজ করার অঙ্গীকার আমার।’

ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া গ্রামের দিনমজুরের ছেলে আলমগীর হোসেন। পুলিশে চাকরির স্বপ্ন ছিল তারও। তবে সেই স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল দারিদ্র্য। বাবা বিল্লাল হোসেনের যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা সেখানে চাকরি পাওয়া তো ছেঁড়া কাথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন! তবে আলমগীর একসময় জানতে পারেন, পুলিশে চাকরি পেতে লাগে না কোনো বাড়তি টাকা। মেধা ও যোগ্যতা থাকলেই মাত্র ১৩৩ টাকা খরচ করেই মিলবে পুলিশের চাকরি। পরে আবেদন ফরম পূরণ করে লাইনে দাঁড়ান। সব বাছাইয়ে মেধা ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণও হলেন। এখন আলমগীর বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য।

পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ পুলিশকে উন্নত দেশের উপযোগী করার লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। এবারের কনস্টেবল নিয়োগ সে প্রক্রিয়ারই অংশ। এ জন্য আমরা নিয়োগবিধি সংশোধন করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জব মার্কেট থেকে মেধা এবং শারীরিকভাবে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করছি। নতুন নিয়োগবিধি অনুযায়ী, অধিকতর যোগ্য প্রার্থীরাই এবার কনস্টেবল পদে নিয়োগ পাচ্ছেন।’ আগামীতে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও মেধা ও শারীরিকভাবে যোগ্যরা নিয়োগ পাবেন বলে যোগ করেন আইজিপি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com