শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন

উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী ৭২ ঘণ্টার ডেডলাইন

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১
  • ১৪১ বার

রাজধানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে- ‘ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন ধর্ষণের কোনো মামলা না নেয়। কারণ ৭২ ঘণ্টা পর মেডিক্যাল পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। এ ধরনের মামলার মাধ্যমে আদালতের শুধু সময়ক্ষেপণ হয়।’ ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোসা. কামরুন্নাহার গতকাল এ পর্যবেক্ষণ দেন। বিচারিক আদালতের এ পর্যবেক্ষণকে হাস্যকর ও অযৌক্তিক বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে এই পর্যবেক্ষণ উচ্চ আদালতের সম্প্রতি দেওয়া রায়ের পরিপন্থী। এমনকি এটি প্রচলিত আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করার ক্ষেত্রে বেশি দেরি হলে তদন্ত ও প্রমাণ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায়। ধর্ষণের মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- ফরেনসিক এভিডেন্স, যেটি আসে ভিকটিমের মেডিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে। সে জন্য ঘটনার পর অতিদ্রুত অভিযোগ দায়ের এবং মেডিক্যাল টেস্টের পরামর্শ দেওয়া হয় ভিকটিমদের। তবে ৭২ ঘণ্টা পার হলে মামলা না নেওয়ার পরামর্শটা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। এমনকি বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও।

এই পর্যবেক্ষণকে হাস্যকর ও অযৌক্তিক দাবি করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, কোনোভাবেই এ পর্যবেক্ষণ মেনে নেওয়া যায় না। ধর্ষণ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। অনেক ঘটনা থাকে এক দু-বছর পরও প্রকাশ হতে পারে। ধর্ষণের পর একজন নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তার ভেতরে এক ধরনের ট্রমা কাজ করে। পরিবার চাপে রাখে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। ধর্ষকরা অনেক সময় ধর্ষণের শিকারকে আটকে রাখে। প্রভাবশালী মহল থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রভাব খাটায়। নানা কারণে মামলা বিলম্ব হতে পারে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ ধর্ষকদের উৎসাহিত করবে।

সালমা আলী আরও বলেন, ধর্ষণের পর অনেক নারী তাড়াতাড়ি গোসল করে ফেলে, কাপড় ধুয়ে ফেলে। নানা কারণে আলমত নষ্ট হয়ে যায়। তাই বলে কি ধর্ষণের শিকার নারী বিচার পাবে না? হাইকোর্টও তো সম্প্রতি এক রায়ে বলেছেন- স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট না থাকলেও পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনায় প্রমাণিত হলে সাজা দেওয়া যাবে। এ রায় ছাড়া আরও অনেক রায় রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে- মামলা দায়েরে বিলম্ব কোনো বিষয় নয়। হাইকোর্ট যে রায় দেন, তা মেনে চলা সবার জন্য আইন। বিচারিক আদালতের গতকালের দেওয়া পর্যবেক্ষণ হাইকোর্টের ওই রায়ের পরিপন্থী বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

গত ১৩ অক্টোবর হাইকোর্ট এক ধর্ষণ মামলার রায়ে বলেছেন, ‘বিলম্ব মানেই কোনো মামলা মিথ্যা নয়। শুধু মেডিক্যাল রিপোর্ট না থাকার কারণে ধর্ষণের মামলা অপ্রমাণিত বলে গণ্য হবে না। ভুক্তভোগীর মৌখিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ হলেও তার ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেওয়া যেতে পারে। তাই মেডিক্যাল রিপোর্ট না থাকার কারণে যে আসামি ধর্ষণ করেনি মর্মে খালাস পেয়ে যাবে, এই অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। ভুক্তভোগী দেরিতে মামলা করলেও তা মিথ্যা নয় উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী যেন বিচার না পায় সে জন্য খুলনার দাকোপ থানাপুলিশ সেই সময় সব চেষ্টা করেছিল।’

মেডিক্যাল রিপোর্ট না থাকলেও খুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ধর্ষণের মামলায় আসামি ইব্রাহিম গাজীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। পরে ওই আসামির আপিল খারিজ করে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এ রায় দেন। গত ১৩ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে ওই রায়ের ১৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়।

জানতে চাওয়া হলে ঢাকার বিচারিক আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী বলেন, বিজ্ঞ বিচারিক আদালত একটি রায়ের পর্যবেক্ষণে ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেওয়ার জন্য পুলিশকে একটি পরামর্শ দিয়েছেন। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে এটি জেনেছি। এই পর্যবেক্ষণ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর মামলার সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেওয়ার পরামর্শসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের অংশটুকু আইনসিদ্ধ নয়। কেননা কোনো মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানে অর্পিত ক্ষমতাবলে যে কোনো মতামত ও নির্দেশনা দিতে পারবে এবং সেটি আইনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিচারিক আদালতকে এ ধরনের পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

নারী নির্যাতনের বিভিন্ন মামলা নিয়ে আদালতে লড়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা। তিনি বলেন, ধর্ষণের কিছু আলামত থাকে। মেডিক্যাল টেস্ট করাতে দেরি হলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আদালত সাজা দেয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। তার মানে এই নয় যে ৭২ ঘণ্টা পর মামলা নেওয়া যাবে না। ডিএনএ টেস্ট করলে ৭২ ঘণ্টা কেন ৭২ দিন পর হলেও অপরাধ প্রমাণ করা যায়। তা ছাড়া ফৌজদারি মামলায় কোনো সময়সীমা নেই। আদালতের পর্যবেক্ষণটি সঠিক নয়।

তবে ভিকটিমের শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অপরাধীর সাজা দেওয়া সহজ হয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান। ‘ফরেনসিক এভিডেন্সকে বলা যায় কনক্লুসিভ প্রুফ। অন্য কিছু দিয়ে প্রমাণ করার চেয়ে ফরেনসিক রিপোর্ট দিয়ে অপরাধ প্রমাণ করা সহজ হয়ে যায়। মামলাটা নিষ্পত্তি করতেও সহজ হয়ে যায়। তবে যে কোনো অপরাধ প্রমাণে ফরেনসিক এভিডেন্স একমাত্র বিষয় নয় বলে উল্লেখ করেন পুলিশের সাবেক এ শীর্ষ কর্মকর্তা। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে অপরাধের ধারাবাহিকতা সাজিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে আদালতের সামনে উপস্থাপন করা যায়। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে অনেক দক্ষতার পরিচয় দিতে হয় বলে উল্লেখ করেন মোখলেসুর রহমান।

বাংলাদেশে ধর্ষণের অভিযোগে যত মামলা হয়, তার মধ্যে সাজা হয় হাতে গোনা কিছু। বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ বলছে, তারা এক গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয় জেলায় ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। এই সময়ে ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচজনের। এই গবেষণাটি পরিচালনার জন্য সংস্থাটির তরফ থেকে থানা, হাসপাতাল ও আদালত- এ তিনটি জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাতেমা রেজিনা। তার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- নারীদের অনেকে জানেনই না যে ধর্ষণের শিকার হলে কীভাবে অগ্রসর হতে হবে। তা ছাড়া শারীরিক ও মানসিক ধকল সামাল দিতে তার সময়ের প্রয়োজন হয়। সামাজিক লজ্জার ভয়ে অনেকে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন। একজন রেপ ভিকটিম শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকে। ভিকটিমের পরিবার বিষয়টি প্রকাশ করতে চায় না। তারা বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে চায়। মেয়েটি কি চায় না যে ধর্ষকের শাস্তি হোক? নিশ্চয়ই চায়। কিন্তু সে তার পরিবারের কথা চিন্তা করে। তখন ব্যাপারটি তার চেপে যেতে হয়। তবে ধর্ষণসহ অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে নারীরা যেন দ্রুত আইনের আশ্রয় নিতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশে বিভাগীয় শহরগুলোয় পুলিশের একটি বিভাগ রয়েছে, যেটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। সে জন্য ঘটনার পর পরই দ্রুত অভিযোগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com