সরকারিভাবে স্বীকার করা হোক বা নো হোক এটাই সত্য যে, দেশে দরিদ্র মানুষের হার বাড়ছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সরকার যেসব আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ দিচ্ছে, তা কিছু মানুষের জন্য উপকার বয়ে আনলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাতে খুব একটা উপকৃত হচ্ছে না।
বরং সরকারের কোনো কোনো পদক্ষেপ দরিদ্র মানুষের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। একটি শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে চলেছে। কিন্তু সরকার কোনোভাবেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করছে না
আর অস্তিত্ব স্বীকার না করার অর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হবে না। এ সুযোগে বাজারে পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রে আগুন জ্বলছে। সাধারণ মানুষ কীভাবে আছে ক্ষমতাসীনদের তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। বরং কোনো কোনো মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটকে আরও উৎসাহিত করছে বলা যায়।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জন্য নিত্যপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করছে। প্রতিদিনই টিসিবির ট্রাক সেলের লাইন বড় হচ্ছে। কিন্তু অনেকটা হঠাৎ করেই টিসিবি পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে স্থানীয় বাজারে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। দুটিরই দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। কিছুদিন আগেও প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হতো ৬৫ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি লিটারে দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। ফার্নেস অয়েলের দাম প্রতি লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৩ টাকা।
আগে বিক্রি হতো প্রতি লিটার ৫৯ টাকায়, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকায়। রান্নার কাজে ব্যবহার্য ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপি গ্যাসের দাম এক মাসের মধ্যে দুবার বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে পরিবহণ ভাড়া। এর বোঝা বহন করতে হবে যাত্রীদের, যাদের গণপরিবহণ ছাড়া দীর্ঘযাত্রায় পথ চলার কোনো উপায় নেই। বস্তুত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সব ধরনের পণ্যের মূল্য আরও এক দফা বাড়বে। ডিজেলের ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে সেচের জন্য। কাজেই সেচের ব্যয় বাড়বে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে সরকারি কর্তৃপক্ষ যে যুক্তি প্রদর্শন করেছে, তা প্রশ্নাতীত নয়। সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা না হলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বিপুল পরিমাণ লোকসান দিতে হবে।
এ ছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি না করা হলে পার্শ্ববর্তী দেশে জ্বালানি তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কী অদ্ভুত যুক্তি! পার্শ্ববর্তী দেশে জ্বালানি তেল পাচার হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকলে সেই পাচার কার্যক্রম বন্ধ করা হলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এজন্য জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে কেন? জনগণ তো আর জ্বালানি তেল পাচারের সঙ্গে যুক্ত নয়।
যে সামান্য সংখ্যক মানুষ জ্বালানি তেল চোরাইপথে পাচার করার চেষ্টা করতে পারে, তাদের প্রতিরোধ করলেই তো হতো। চোরাচালানিদের নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যর্থতার দায়ভার কেন জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে? জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা না হলে বিপিসির সম্ভাব্য লোকসানের বিষয়টিও সঠিক যুক্তি নয়। কারণ বিপিসি গত পাঁচ মাস ধরে লোকসান দিচ্ছে। কিন্তু এর আগে সাত বছর তারা মোট মুনাফা করেছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য যখন কম ছিল, তখন তো স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়নি। তাহলে এখন আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে কেন স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হবে?
জ্বালানি তেল এমনই এক উপকরণ, যা ছাড়া কোনো উন্নয়ন কর্ম সাধিত হতে পারে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৩২ শতাংশ জ্বালানি তেলনির্ভর। কাজেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে কর্তৃপক্ষ এক সময় বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে বাধ্য হবে। সেই সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির বোঝাও সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের পণ্য পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এর বোঝাও সাধারণ মানুষকে বইতে হবে। এমনিতেই সাধারণ মানুষ করোনার কারণে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তারা কোনোভাবেই আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পারছে না। দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তারা বাজারে গিয়ে কোনো নিত্যপণ্য ক্রয় করতে পারছে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাও এখন মুখ ঢেকে টিসিবির ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়াচ্ছে।
সরকার উন্নয়নের ফিরিস্তি গাইতে ব্যস্ত। কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। দুঃসহ যন্ত্রণায় মানুষ এখন বিপন্নপ্রায়। কীভাবে আগামীতে বেঁচে থাকবে সেই চিন্তায় তারা অস্থির। করোনা এবং মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে সাধারণ মানুষ এখন বড়ই আতঙ্কগ্রস্ত। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) যৌথভাবে গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, করোনার কারণে দেশে অন্তত ৩ কোটি ২৪ লাশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে।
চলতি পঞ্জিকা বছরের এপ্রিল মাসে তারা ঠিক একই রকম জরিপ করেছিল। সেই সময় জরিপে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, দেশে করোনার কারণে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছিল। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে আরও ৭৯ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। প্রতিষ্ঠানদ্বয় দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান ও অবস্থা সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করে। প্রাথমিকভাবে জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে দারিদ্র্যের কারণে ২৮ শতাংশ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে আবার ১৮ শতাংশ শহরে ফিরে এসেছে। কিন্তু ১০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রাম থেকে শহরে আসতে পারেনি।
তারা আগামীতে আর কখনোই শহরে আসতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়, করোনার কারণে শহরের মানুষের আয় করোনা-পূর্বকালের চেয়ে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। করোনায় গ্রামের মানুষের তুলনায় শহরের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের আয় কমে গেছে ১২ শতাংশ। করোনার আগে শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৭ শতাংশ। বর্তমানে তা ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়েছে ৪ শতাংশ। করোনার আগে শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের মাথাপিছু খাদ্যে ব্যয় ছিল ৬৫ টাকা। এখন তা ৫৪ টাকায় নেমে এসেছে। একইভাবে গ্রামের মানুষের মাথাপিছু দৈনিক খাদ্য ব্যয় ৬০ থেকে ৫৩ টাকায় নেমে এসেছে। মানুষ শুধু যে খাদ্যের ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে তা নয়, তারা অন্যান্য খরচও কমিয়ে ফেলেছে। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি খাতের ব্যয়ও অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। তারপরও তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী চলতে পারছে না।
গত মার্চ মাসে শহরের বস্তিতে বাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় হতো ৯৩৬ টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৪৭ থেকে ৭৭৭ টাকায়। জীবনযাত্রার এ বাড়তি ব্যয় মেটানোর জন্য শহর ও গ্রাম উভয় স্থানের দরিদ্র মানুষকে ধার করতে হয়েছে। শহর ও গ্রামের দরিদ্র মানুষ দোকানির কাছ থেকে বাকিতে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। গ্রামের ৬২ শতাংশ দরিদ্র মানুষ দোকানির কাছ থেকে ধার নিয়েছে। শহরের ক্ষেত্রে এ হার ৬০ শতাংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেখানকার ৩৬ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
এ অবস্থায় নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের জন্য কার্যকর সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যারা শহর থেকে গ্রামে চলে গেছে, সবার আগে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সামগ্রিকভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে ভর্তুকি দিয়ে হলেও পণ্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে।
মানুষ যেখানে বিপন্নপ্রায়, সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের চিন্তাকে কোনোভাবেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত হবে না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মালিক দেশের প্রত্যেক নাগরিক। সেই নাগরিকদের কষ্টে রেখে মুনাফা অর্জনের কোনো মানে থাকতে পারে না। তাই জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের পাশাপাশি বাজারে পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বিডিবিএল; অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক