বাংলাদেশে এ সময়ে দেশের সর্বনিম্ন অথচ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন চলছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। ইউনিয়ন পরিষদই বাংলাদেশের কথিত স্থানীয় সরকারের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ এই পরিষদের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের ভোটার এবং সাধারণ মানুষ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হাটে-মাঠে, গ্রামে-গঞ্জে ক্ষমতাবান যাদের সাধারণ মানুষ হাতের নাগালে পায়, তিনি হন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা মেম্বার। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদ বিদ্যমান। এ সংখ্যা প্রায়ই বাড়তে দেখা যায়। ক্রমেই ইউনিয়নগুলো ছোট আকারের হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রায় দশ কোটি ভোটার রয়েছে, তার মানে গড়পড়তা প্রতি ২১৯৫৯ জন ভোটারের জন্য একটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়েছে। পরিষদের নয়জন মেম্বারের গড়পড়তা ভোটার সংখ্যা ২৪৪০ জন। কাজেই এ কথা বলা সহজ যে, এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত বাড়ি, পরিবার এবং স্বজনভিত্তিক।
ইউনিয়ন পরিষদ প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো একটি প্রতিষ্ঠান, যদিও উপমহাদেশের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে ১৮৭০ সালে গ্রাম্য চৌকিদার আইন (ঠরষষধমব পযড়ঁশরফধৎ ধপঃ) দ্বারা তৎকালীন বাংলায় (ইবহমধষ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে কালের বিবর্তনে নাম বদলিয়ে এর নাম হয় ইউনিয়ন কাউন্সিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর অল্প কিছুদিনের মধ্যে নাম পরিবর্তিত হয়ে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত হয়। ১৯৭৩ সালের পর পুনরায় ইউনিয়ন পরিষদ নামে পরিচিত হলেও স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে আজও স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। তবে ১৯৭৬ সালে ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশের’ মাধ্যমে যে কাঠামো তৈরি হয় একজন চেয়ারম্যান ও নয়জন মেম্বার নিয়ে মূলত গঠিত হয় এই পরিষদ, পরে ১৯৮৩ সালে দুজনের জায়গায় ৩ জন মহিলা মেম্বার যুক্ত হয়। আরও পরে ২০০৯ সালে কিছু পরিবর্তন হয়, যার মাধ্যমে ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ‘লোকাল গভর্নমেন্ট কমিশন’ বিলুপ্ত করা হয় এবং সব স্থানীয় সরকার সরাসরি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পুনঃস্থাপিত হয়। বিদ্যমান আইন মোতাবেক প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় ইউনিয়ন পরিষদ।
আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিম বাংলায় অনুরূপভাবে তৎকালীন ইউনিয়ন কাউন্সিল পরিবর্তিত হয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত হিসেবে। এ পঞ্চায়েতের নির্বাচন এবং পরিচালিত হয় সংসদীয় কায়দায়। অপরদিকে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র থাকলেও স্থানীয় সরকারগুলো রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় নির্বাচন ও পরিচালিত হয়, যে কারণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মেয়র এবং ইউনিয়ন পরিষদের প্রধান হিসেবে চেয়ারম্যান দ্বারা পরিষদ পরিচালিত হয়। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠই মূলত কমিশনার বা মেম্বার কোটা গুরুত্ব বহন করে না। কাজেই নির্বাচন নিয়ে যত প্রচারণা-আলোচনা-সমালোচনা কথিত শীর্ষ পদ নিয়েই। এ পদকে ঘিরে মনে হয় নির্বাচনের সব প্রক্রিয়া চলমান। মেম্বারদের নিয়ে তেমন আলোচনা যেমন হয় না, নির্বাচনী আয়োজকরাও এক প্রকার নির্বিকার থাকে, যে কারণে বেশিরভাগ নির্বাচনী শ্ঙ্খৃলার ব্যত্যয় এই স্তরেই হয়ে থাকে।
অপরদিকে বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের পর্যায়ে শাসক দলের হঠাৎ দলীয় মার্কায় শুধু সব পর্যায়ের স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের পদের নির্বাচন একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনকে যেমন জটিল, প্রভাবিত এবং প্রায় জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে, যার কারণে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনগুলো শুধু জটিলই হয়নি, দারুণ সংঘাতের পথ খুলে দিয়েছে, যার জের গত নির্বাচনেও দেখা গেছে এবং বর্তমানে নির্বাচন রক্তাক্ত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। কেন ক্রমেই এই নির্বাচনগুলো রক্তাক্ত হচ্ছে তার কারণগুলো বিশ্লেষণের আগে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও বাধ্যবাধকতা নিয়ে কিছু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
সংবিধানের ১১৯ ধারায় নির্বাচন কমিশনের যে চারটি বাধ্যবাধকতামূলক কাজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নেই। তার মানে এই নির্বাচনগুলো নির্বাচন কমিশনের অনুষ্ঠিত করার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সংবিধানের ওই ধারার উপধারা অনুসারে সংসদ দ্বারা অনুমোদিত আইনের মাধ্যমে এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এ দায়িত্ব বহন করছে। কমিশন শুধু নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অনেকাংশে সংশ্লিষ্ট থাকে, যার কারণে নির্বাচন কমিশনকে সব ইউনিয়ন নির্বাচন শিডিউল নির্ণয় করতে বেগ পেতে হয়। যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংবিধান দ্বারা রক্ষিত নয়, সে কারণে প্রায়ই লক্ষ করা যায় যে, শিডিউল ঘোষণার পর নির্বাচনী প্রক্রিয়া আদালতের ঘোষণার দ্বারা বন্ধ বা কথিত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকে, যার পূর্বধারণা কমিশনের থাকে না। অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে দশ থেকে প্রায় সতেরো বছর পর্যন্ত অনেক নির্বাচন আইনি কারণে বন্ধ থাকে। এসব আইনি প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তির দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের ওপর বর্তায়।
অনেক দেশে, এমনকি ভারতেও এ পর্যায়ের নির্বাচনগুলো কেক্সদ˜ীয় কমিশন অথবা কমিশন নিয়োজিত সিইও-এর নয়। এসব নির্বাচনের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। প্রয়োজনে কমিশন রাজ্য চাইলে বিভিন্ন কারিগরি অথবা প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করে সাহায্য করে মাত্র। আমাদের দেশেও এসব নির্বাচন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হওয়া উচিত। তেমন হলে এত হানাহানি কমতে পারে।
এখন আসছি এবারের নির্বাচনে আনুপাতিক হারে অতীতের ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলো থেকে রক্তপাত, মৃত্যু এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা বেশি হয়েছে। অনেক জায়গায় নির্বাচন পরিচালিত হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি হস্তক্ষেপে বা তাদের হুমকি-ধমকির কারণে ভোটার ভীতির মধ্য দিয়ে। পত্র-পত্রিকার প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ওইসব জায়গায় নির্বাচন কমিশনকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনের নয়, প্রক্রিয়া চলেছে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির ইশারায়। কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে অস্ত্রের হুমকি দিয়েছে সংসদ সদস্য, আবার কোথাও কোথাও নির্বাচনের বদলে সিলেকশন করার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে প্রতিপক্ষ। বেশিরভাগই এক দলের, নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে যার কারণে কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ পরিষদ বিনা ভোটে কথিতভাবে নির্বাচিত হয়েছে।
ভোট ডাকাতি, জালিয়াতির প্রমাণ সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের ভালো ভোটের সনদ প্রদানের কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থার যে অবনতি তাতে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কর্মীরাও মহোৎসাহে ভোট ডাকাতিতে খোলাখুলি অংশ নিয়েছে। এর প্রমাণ পত্র-পত্রিকার তথ্য পর্যালোচনাই যথেষ্ট। বহু ৃকৃক্সদ˜ ৯৮ শতাংশ ভোট প্রদান হয়েছে বলে উদ্ধৃত হলেও নির্বাচন কমিশন নির্বিকার।
এত হানাহানি, প্রাণঘাত আর অব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশন বিব্রত হলেও সরকারের জন্য বেশ অস্বস্তির কারণ হয়েছে। এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ এবং পরে বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে আগামীর করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে (একটি জাতীয় দৈনিক, ১৯ নভেম্বর ২০২১)। মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা তাদের অসহায়ত্বের কথাও তুলে ধরেছেন। এক কথায় আইনের দৃষ্টিতে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেছে। এ ধরনের অব্যবস্থার কারণে মাঠ প্রশাসনও ছিল বিভ্রান্ত, যার কারণে এত বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে এতগুলো মানুষের প্রাণহানি হয়েছে আর নির্বাচন যা হয়েছে তার মানদø নিয়ে আলোচনার তেমন কিছু নয়।
মূলত এ পর্যায়ে হানাহানির মুখ্য কারণ দলীয় ভিত্তিতে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচন, যার কারণে দলের ভেতরে বিভাজন, যার বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। নমিনেশন দেওয়াটাই বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে, এ কথা শাসক দলের বহু নেতা বলছেন। বুঝতে পেরেছেন এ ব্যবস্থায় একদিকে যেমন মনোনয়ন বাণিজ্য বেড়েছে, তেমনি নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে বলে নিজেদের দলের মধ্যে হানাহানির পর্যায়ে পৌঁছেছে। অপরদিকে শাসক দল ছাড়া বিরোধী পক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ফলে কথিত ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের দল ভারী হয়েছে। হানাহানির মাত্রায় বিষয়টি যোগ হয়েছে।
পরিশেষে বলতে হয়, ইউনিয়ন কাউন্সিলসহ সর্বস্তরের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তন না করে এক দেশে দুই পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা (স্থানীয় সরকার রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি এবং জাতীয় পর্যায়ে সংসদীয় ব্যবস্থা) জগাখিচুড়ির সৃষ্টি করেছে। বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসন। এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর শুরু থেকেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হতে চলেছে। এ পর্যায়ের হানাহানি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে তুলছে। এ অবস্থা থেকে তৃণমূল পর্যায়ে পরিবর্তন করতে হলে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন অন্যথায় এ ধরনের প্রাণহানি এবং বিশৃঙ্খলা বাড়তেই থাকবে। এত প্রাণহানির দায়িত্ব কে নেবে?
তৃণমূল পর্যায়ের ঐতিহ্যবাহী এসব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে হলে আশু পর্যালোচনা ও কার্যকর এবং সুদূরপ্রসারী উন্নতির জন্য দৃঢ় পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)