বিশ্ববিবাদ যেন আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে যাচ্ছে। নানান অনুষঙ্গ ধরে বিচার-বিশ্লেষণে গেলে সে রকম একটি পরিবেশ ও পরিস্থিতি ঘনিয়ে আসছে বলেই মনে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন দুই সপ্তাহ আগে তার ন্যাটো সদস্যদের বলেছে, অচিরেই ইউক্রেনে অভিযান চালাতে পারে রাশিয়া। কেন রাশিয়া সে দেশে অভিযান চালাতে পারে এ ধারণার কোনো ব্যাখ্যা নেই বা দেয়া হয়নি। ২০১৪ সালে ইউক্রেনভুক্ত ছোট দ্বীপ ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। রাশিয়া যে তার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে গেল তার প্রমাণ দিয়েছে মহাকাশে স্যাটেলাইট বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে। পুতিনের দেশ রাশিয়া সোভিয়েত আমলের একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস করেছে ওয়ারহেড বহনকারী রকেট হামলা চালিয়ে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রাশিয়া মহাকাশে তার সামরিক শক্তির প্রমাণ দিলো। এটুকু ভাবলেই কেবল হবে না, সেই শক্তির ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মনে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রকেই যে তটস্থ করার জন্য এটা করেছে রাশিয়া তা নয়, সহযোগী ন্যাটোকেও জানান দিলো তার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে রাশিয়া মহাকাশে যে ভাসমান বর্জ্য সৃষ্টি করল, তার ঝুঁকি কিন্তু কম নয়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের ৭ জন বিজ্ঞানী ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভয়ে তাদের ক্যাপসুলে ঢুকে পড়ে। অর্থাৎ যদি স্যাটেলাইট বর্জ্য এসে হামলে পড়ে গবেষণা কেন্দ্রের কোনো অংশে, তাহলে তারা মারাও পড়তে পারতেন। কিন্তু এতটা ভাবেননি পুতিন। উল্লেখ করা উচিত যে, ওই গবেষণা গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাশিয়ারই একজন বিজ্ঞানী। মহাকাশ গবেষণায় ওই বর্জ্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে গবেষণার বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। না, শুধু রাশিয়াই নয়, এরকম ঝুঁকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতও সৃষ্টি করেছে আগেই। অর্থাৎ সামরিক ক্ষমতাবানরা পৃথিবীর বুকে যেমন সৃষ্টি করে চলেছে নানান রকম মানববিরোধী পারমাণবিক ও কার্বনিক বর্জ্য, তেমনি মহাকাশেও সৃষ্টি করে চলেছে স্যাটেলাইট বর্জ্য। সর্বত্রই তারা মানববিরোধী বর্জ্যরে উৎপাদক এবং তা মানুষের বসবাসের জন্য মারাত্মক হতে বাধ্য। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বণ নিঃসরণ যে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে চলেছে, সে সত্য তারা স্বীকার করলেও তা প্রতিরোধের যে অঙ্গীকার করেছে ইতোমধ্যেই জলবায়ু সম্মেলনে, তা পালন করছে না। কিংবা সীমিত আকারে করছে।
এসব অপকর্মের বাইরে প্রকাশ্যে ও গোপনে চলছে মানুষ হননের রাজনৈতিক ও সামরিক চক্রান্ত। রাশিয়ার মনের ভেতর ‘সাবেক ক্ষমতা’র জিলকানি চলছে। পরাশক্তি হয়ে সে আবারো দাপট দেখাতে চায়। এমনিতেই সে কর্তৃত্ববাদী সরকারি আচরণে অভ্যস্ত, তার ওপর যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক টক্কর দিতে যায়, তাহলে স্নায়ুযুদ্ধের সেই পুরনো কাসুন্দিই ফিরে আসবে বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে। সে রকম একটি পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি হতে চলেছে। রাশিয়ার কাছে থেকে এস-৪০০ নামের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অস্ত্র কিনেছে ভারত। আগামী ডিসেম্বরের যে সময়টায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারত সফরে আসবেন, তার আগেই ওই অস্ত্রের প্রথম চালানটি (দুটি ইউনিট) ভারতে পৌঁছে যাবে এবং সম্ভবত ওই অস্ত্র ভারত-চীন সীমান্তে মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের ধারণা, চীন তাকে মহাকাশ থেকে আক্রমণ চালতে পারে। চীনের সঙ্গে তার বৈরিতা বহু পুরনো। তবে মূলত তিব্বত দখল করে নেয়ার পর, হিমাচলকে চীনের অংশ দাবি করায় ভারত-চীন দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। সেই সাথে সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যেমন তেমনি চীনের সাথেও বিরোধ তুঙ্গে।
আরো নানা সত্য নিহিত আছে দেশ দুটির রাজনৈতিক বিরোধের কানাগলিতে। পারস্পরিক রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের সাথেও রয়েছে মনোলিথিক বিরোধ। এ-দুটি দেশেই কোটি কোটি মানুষ, মানবেতর জীবনযাপন করে। তাদের একটি বড় অংশ অর্ধভুক্তই কেবল থাকতে বাধ্য হয় না, সরকারের সহায়তাও পায় না। অথচ সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে পরমাণু বোমার অধিকারী হয়েছে। লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয় করে সামরিক শক্তিকে হিমালয় সমান বানিয়েছে। কিন্তু তাদের কানে পৌঁছে না ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না। এ রকম সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশেও রয়েছে, তবে তার সংখ্যা অনেকটাই কম।
আগামী ডিসেম্বরে ভার্চুয়াল ডেমোক্র্যাসি সম্মেলনের আয়োজন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ৯-১০ তারিখে সেই সম্মেলন হবে। পৃথিবীর ১১০টি দেশ অংশ নেবে। সেই দেশগুলোর রাজনৈতিক স্ট্যাটাস গণতান্ত্রিক ও মানবতার পক্ষের কি না, সে বিতর্ক থাকলেও জো বাইডেন তাদের অংশ নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চীন ক্ষেপেছে তাকে তো ওই সম্মেলনে ডাকেইনি, উপরন্তু তাইওয়ানকে দাওয়াত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ডাক পেয়েছে ইসরাইল, ইরাক, পোল্যান্ড, নাইজার, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ এমন কিছু দেশ যাদের ক্ষমতার উৎস কর্তৃত্ববাদিতায় পূর্ণ। এরদোগানের তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্র ওই সম্মেলনে রাখেনি বা ডাকেনি। দেশটি ন্যাটোর সদস্য। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্দান দাওয়াত পায়নি।
বোঝাই যাচ্ছে বাইডেন একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভেতরে চিরুনি অপারেশন চালানোর চেষ্টা করছেন। ওই সম্মেলনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সুরক্ষা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো রাষ্ট্রগুলোর সাথে মতামত যাচাই করে একটি সমন্বিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। বোঝাই যায়, একটি নতুন প্রণোদনাকে সামনে রেখে এই সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী সরকারকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে ওই সম্মেলনে। ইসরাইলের মতো একটি কর্তৃত্ববাদী দেশকে যেখানে ডেকেছে, সেখানে চীনের মতো সংস্কারপন্থী সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর দেশকে কেন দাওয়াত দেয়নি? বিপরীতে চীন যে দেশটিকে নিজের ভূখণ্ডের অংশ মনে করে সেই তাইওয়ানকে দাওয়াত দেয়ার পেছনকার অভিপ্রায় কী?
তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ চলছে দিন কয়েক আগে। তারা বলছে, এটা তাদের নিয়মিত টহল। শুধু তারাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার যুদ্ধজাহাজও ওই তাইওয়ান প্রণালীতে টহল দিয়ে চলাচল করছে। চীন ও তাইওয়ানকে বিভাজনকারী তাইওয়ান প্রণালীকে আন্তর্জাতিক জলসীমা মনে করে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্ররা। অন্যদিকে চীন মনে করে ওই এলাকা তারই অংশ। গত ১৫ নভেম্বর জো-বাইডেন ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে যে ভার্চুয়াল মিটিং হয়েছে, তাকে ম্লান করে দিতেই বোধহয় চলতি সপ্তাহে তাইওয়ানকে যুদ্ধবিমান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা যে স্পষ্ট উসকানি, চীনকে শক্তি প্রদর্শনের পেছনে যে সামরিক ও রাজনৈতিক ছক তারই পূর্বাভাস? চীনকে ঘেরাটোপের মধ্যে রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়।
চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রকাশ্য হুমকি যদি সামরিক বিবাদের তুঙ্গে উঠে যায় তাহলে কী উপায় হবে? কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে একত্র হওয়ার যে আয়োজন, তাকে কর্তৃত্ববাদিতারই গর্জন বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তার গণতান্ত্রিক স্বভাব ও শাসনব্যবস্থাটাই কর্তৃত্ববাদিতায় পূর্ণ। সেটা সাদা চোখে বোঝার উপায় নেই। তার আন্তর্জাতিক নীতি-আদর্শ ও তার প্রায়োগিক পদক্ষেপ তারই নমুনা। আজকে চীনের বিরুদ্ধে ‘অকাস, কোয়াড, ন্যাটো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক বলয় নির্মাণ করেছে, তা চীনকে চিড়েচ্যাপটা করে দেয়ার চেষ্টা। একে অপচেষ্টা বলাই ভালো। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মনের ভেতরে ‘মানুষ’ নেই, আছে কেবল ক্ষমতার রোষ, যা মানবতা, মানবহিতৈষণা ইত্যাদিকে দূরে ঠেলে দেয়। এই চিন্তা ও চেতনার ‘ঘোর’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এবং অবশ্যই চীনকেও সরে আসতে হবে। কারণ চীনের কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভারতেও কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবনের ঘেরে বন্দী। মানবসম্পদ উন্নয়নের বিপরীতে সামরিকায়নকে আমি অপরাধ বিবেচনা করি। আশা করতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনই কেবল নয়, পৃথিবীর সব দেশের রাষ্ট্রনায়করাই যেন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা পরিহার করে মানবসেবা ও মানবতা উদ্ধারের জন্য মনোনিবেশ করেন। কেবল কথায় নয়, তাদের সর্বাংশে মানব উন্নয়নে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু সম্মলনে যেসব অঙ্গীকার করেছে শিল্পোন্নত দেশগুলো তা কার্যকর করলেই মানুষ বাঁচতে পারে। এ পথেই মানবতার মুক্তি, সামরিক বা হুমকির পথে নয়।