সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৪ পূর্বাহ্ন

পুঁজিবাজার শক্তিশালী করতে হবে

মো: মাঈন উদ্দীন
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২১
  • ২১৮ বার

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পথচলা ছয় দশকেরও বেশি। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। বয়স বিবেচনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিশ্বের অন্যান্য স্টক এক্সচেঞ্জের তুলনায় নবীন। তা ছাড়া এ দেশের অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজার তেমন এগোতে পারেনি। দেশের জিডিপির আকার ৩০০ বিলিয়নের বেশি অথচ পুঁজিবাজারের আকার জিডিপির ২০ শতাংশের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। কাক্সিক্ষত হারে এটি বাড়ছে না। করোনার কারণে পুঁজিবাজারে নির্জীবতা থাকলেও ইদানীং শেয়ার মার্কেটে মানুষ ফিরে আসতে শুরু করছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) আগের তুলনায় অনেক একটিভ মনে হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেশি। ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম, তা ছাড়া বাজারের কাঠামোগত দুর্বলতা তো রয়েছে। সাথে সাথে সুশাসনের ঘাটতিও লক্ষণীয়। তা ছাড়া পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন ও আধুনিকায়নের ঘাটতি রয়েছে দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই।

আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অবকাঠামোগত রূপান্তর ঘটছে। অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে এ খাতের অবদান ৩৫ শতাংশেরও বেশি। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিল্পায়নে পুঁজিবাজার খুব একটা ভালো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে শিল্পায়নে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পায়নে পুঁজিবাজারকে অর্থায়নের মূল উৎসে পরিণত করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে শিল্প মূলধনের বড় অংশ আসে পুঁজিবাজার থেকে। আমাদের দেশে তার উল্টো। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তারা ব্যাংকে ছোটেন। এ প্রবণতা বদলাতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যার্টআপ মানি, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, সিএমএসএমইতে স্বল্পমেয়াদে বিনিয়োগ করবে। এতে ব্যাংকের ঝুঁকি কমবে। আদায়ও ভালো হবে। আমানতদারিদের টাকা নিরাপদে থাকবে। ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ হ্রাস করতে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। ভারতের জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, চীনে ৩৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। এতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। কাঠামোগত সংস্কার করতে হয়েছে।

আমাদের দেশে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেশি। তাদেরকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পুঁজিবিনিয়োগ করতে হয়। এ খাতে কখনো লাভ ও কখনো লোকসানের কবলে পড়তে হয়। তাই বিনিয়োগের আগে কোম্পানিকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ এবং মৌল ভিত্তি যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেতে বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার নিশ্চিতে বিএসইসিকে কঠোর হতে হবে। যারা মার্কেটের সাথে জড়িত তাদেরকে সম্পন্ন কমপ্লায়েন্স মেনে কাজ করা উচিত। পুঁজিবাজার যাতে সূচক নিয়ন্ত্রিত বাজার না হয়। শেয়ারের দাম বাড়লে সূচক বাড়বে, দাম কমলে সূচক কমবে এটা স্বাভাবিক হওয়া উচিত। তবে লেনদেন বেশি কমলে তার কারণ দেখতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাবে বাজারে যাতে দুর্বল কোম্পানি আসতে না পারে সে দিকে নজর রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিসিইসির ভূমিকা পালন করা উচিত।

আমাদের প্রধান দু’টি শেয়ার বাজারের অগ্রগতির পেছনে বাধাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। কাঠামোগত কিছু সমস্যা তো রয়েছেই, তা ছাড়া পুঁজিবাজারের উন্নয়নও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিশ্বের পুঁজিবাজারে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে, তার দিকে সমন্বয় রেখে এগোতে হবে। নতুন প্রজন্মের বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করা ও বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের জন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশন ও অনলাইন ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সাথে সাথে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এক্সচেঞ্জ যেমন- চীনের সাংহাই ও শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জের অভিজ্ঞতা ও তাদের সহায়তা নিতে হবে।

শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগের কথা বললে বলতে হয় বিদেশী; বিনিয়োগকারীদের কিন্তু ধরে রাখা যাচ্ছে না। তারা যে পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ করেছেন তার চেয়ে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২১ থেকে সেপ্টম্বের ২০২১ এ শেয়ারবাজারে নিট বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে ছয় কোটি ১০ লাখ ডলার। এ সময় প্রবাসী বাংলাদেশীরা নিট বিনিয়োগ করেছেন তিন কোটি ২০ লাখ ডলার। যেখানে গত অর্থবছরে ছিল সাত কোটি ডলার। অক্টোবরে তালিকাভুক্ত ৩২ কোম্পানিতে বিদেশী ও প্রবাসী শেয়ার বেড়েছে। যার বাজারমূল্য ৬১ কোটি টাকা। বিপরীতে ৩৭টি কোম্পানি থেকে শেয়ার কমেছে, যার বাজারমূল্য ২৫০ কোটি টাকা। ব্রোকারেজ হাউজের তথ্য থেকে জানা যায়, বিদেশী বিনিয়োগ যাকে বলা হচ্ছে তার পুরোটা প্রকৃত বিদেশীদের নয়। তালিকাভুক্ত ১৫৩ কোম্পানির শেয়ার ও ফান্ডে বিদেশী বিনিয়োগ থাকার তথ্য মিললেও প্রকৃত বিদেশীদের বিনিয়োগ আছে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি শেয়ারে। বাকিগুলো প্রবাসীদের। আসলে বিদেশী বিনিয়োগ ডেকে আনার বিষয় নয়। তারা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের সুযোগ খোঁজেন। ভালো শেয়ার, ভালো ম্যানেজমেন্ট পেলে বিদেশীরা বিনিয়োগে আসবেই। বিনিয়োগ গ্রাহকদের আস্থা ও ভালো প্রতিষ্ঠানকে বাজারে আকৃষ্ট করতে এক্সচেঞ্জে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। সেকেন্ডারি বাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও বিনিয়োগে বুদ্ধিমত্তার সাথে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য দেশের বিনিয়োগ সম্মেলন ও রোডশোর আয়োজন করা হলেও এর সুফল প্রত্যাশার তুলনার নগণ্য। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা উচিত।

অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অবদান ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ এখানে এর আকার অনেক ছোট। মিউচ্যুয়াল ফান্ডে যারা বিনিয়োগ করেছে তাদের স্বার্থ ও মুনাফার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড আরো কিভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যান্য দেশে মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে নিরাপদ বিনিয়োগের মনে করা হলেও আমাদের দেশে তার অবস্থা ভিন্ন। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও এর ভিত্তি মজবুত করতে এবং দেশের বাণিজ্যকে এগিয়ে নিতে শক্তিশালী পুঁজিবাজার দরকার। দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলো যেভাবে এগোচ্ছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেভাবে চলছে, দেশের পুঁজিবাজারকে তার সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে। বাজারে নতুন নতুন পণ্য বিনিয়োগে রিটার্ন নিশ্চিত ও সুশাসন-জবাবদিহিতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। অবকাঠামো খাতে বিভিন্ন প্রকল্প ব্যয়ে সরকার বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা ও দেশীয় ফান্ড ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে দেশের শেয়ার মার্কেটকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। বড় বড় ব্রিজ, ফ্লাইওভার, বড় বড় রাস্তা নির্মাণে শেয়ারবাজারের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। কিভাবে শেয়ারবাজারে লেনদেন বাড়ানো যায়, কিভাবে মানুষকে বাজারমুখী করা যায়, কিভাবে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা যায় সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসহ সবার কাজ করা উচিত।

ডিএসই ও সিএসইকে আরো বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। পৃথিবীর সব ব্যবসাবাণিজ্যেই লাভ-ক্ষতি হয়। কেউ লাভ করবে, কেউ লস করবে- এটিই স্বাভাবিক। তবে প্রতারণা ও মিথ্যার আশ্রয় নেয়া জঘন্য অন্যায়। এ ক্ষেত্রে বাজারে যেন ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো হঠাৎ ধস না আসে সে দিকে বিএসইসিকে তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। তবে করোনা-পরবর্তী শেয়ারবাজারে লেনদেন বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎসাহ লক্ষ করা গেছে। ইক্যুইটি মার্কেটের বাইরে বন্ড, সুকুক (ইসলামী বন্ড), এসএমই খাতে বিনিয়োগে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। সরকারি-বেসকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে মানুষ বিনিয়োগ করুক, শিল্পায়নে পুঁজিবাজারকে অন্যতম উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হোক। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হ্রাস করে পুঁজিবাজারকে শিল্পায়নে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের উৎস হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার
ই-মেইল : main706@gmail.com.

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com