যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে কারখানা স্থাপন, প্রশস্ত রাস্তাঘাটের অভাব, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষার অভাব, ইন্স্যুরেন্সের টাকা হাতানোর মতলবসহ বিভিন্ন কারণে গাজীপুরে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ড। গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে জেলায় অন্তত ১০৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা। এদিকে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ ও সম্পদহানি দিন দিন বাড়ছে। অনেকে আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করছেন।
অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের পর জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো কমিটির সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি। আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশকিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। আবার দুএকটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে ছোট বড় মিলিয়ে ২ হাজার ৭২টি শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার অধিকাংশই তৈরি পোশাকের। কারখানাগুলোতে রয়েছে নিটিং, ডাইয়িং, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন সেকশন। জনবহুল এলাকায় কারখানাগুলো স্থাপনের সময় অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয়নি সরকারি নিয়মনীতি। পুকুর ও নালা ভরাট করে যত্রতত্র গড়ে ওঠা অনেক কারখানার নেই প্রশস্ত রাস্তা। ফলে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনস্থল পর্যন্ত যেতে পারে না। ফলে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের টঙ্গী, মিলগেট, চেরাগ আলী, কোনাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ঝুটের গুদাম। এসব গুদামে প্রায়ই ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। পুড়ছে মূল্যবান সম্পদ, অনেকের বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
কোনাবাড়ির আমবাগ এলাকায় ১০ বছর ধরে ঝুট ব্যবসা করেন দুলাল মিয়া। তিনি বলেন, গত ২৫ নভেম্বর আমবাগ এলাকায় ঝুটের গুদামে আগুন লাগে। এতে স্থানীয় মনিরের ঝুট গুদাম ও মালামাল পুড়ে যায়। মাঝখানে একটি খালি ঘর থাকায় অল্পের জন্য আমার ঝুটের গুদামটি বেঁচে যায়। পরের দিন দেওলিয়া বাড়ি এলাকায় আবার ঝুটের গুদামে আগুন লাগে। বারবার আগুনের ঘটনায় আমরা ব্যবসা নিয়ে শঙ্কিত। এসব আগুন কেউ ইচ্ছে করে লাগিয়ে দিচ্ছে, না কি নাশকতা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে অগ্নিকাণ্ডে অনেক ঝুট ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
গত ২৭ নভেম্বর টঙ্গীর মাজার বস্তি এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। চোখের সামনে পুড়ে যায় পাঁচ শতাধিক ঘর। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভায়। ঘটনাস্থলে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্যের অভিযোগ, আগুনের খবর পাওয়ার পর পানিবাহী গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলে কিছু লোক গাড়ি প্রবেশে বাঁধা দেন। এ ছাড়া ভুল তথ্য দিয়েও বিভ্রান্ত করা হয়।
গত ৩০ নভেম্বর গাজীপুরের জরুন এলাকায় রিপন নিটওয়্যার কারখানার ফেব্রিক্সের গুদামে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তার আগেই পুড়ে যায় বিপুল পরিমাণ ফেব্রিক্স ও অন্যান্য মালামাল।
এ ছাড়া সম্প্রতি শ্রীপুর উপজেলার মুলাইদ এলাকায় আজিজ কেমিক্যাল গ্রুপের এএসএম কেমিক্যাল কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি একই কারখানায় আগুন লাগে। এতে পুড়ে মারা যান তিনজন এবং অন্তত ১০ জন আহত হন।
ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গেল অক্টোবর মাসে গাজীপুরে ৪৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এগুলোর মধ্যে জয়দেবপুরে ১৬টি, টঙ্গীতে ৭টি, শ্রীপুরে ৫টি, কালিয়াকৈরে ১১টি, কালীগঞ্জে ১টি, কাশিমপুরে ৪টি অগ্নিকাণ্ড রয়েছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ৬২ লাখ টাকা। ১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করছে ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া নভেম্বর মাসে ৬৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যেখানে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, একটি কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা স্বাভাবিক, দুর্ঘটনায় আগুন লাগতেই পারে। আমরা দেখেছি বেশিরভাগ সময়ে ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে আগুন লেগেছে। কারণ বৈদ্যুতিক সিস্টেম যেভাবে মেইনটেইন (রক্ষণাবেক্ষণ) করার কথা, একজন অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে নিয়মিত চেক করার কথা, সেভাবে মেইনটেইন করা হয় না। ফলে ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিং, ওভারলোডসহ নানা কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ঝুটগুলো যখন প্রক্রিয়াকরণ করা হয় তখন তুলার মধ্যে লোহার কনা, পাথর কনা থাকে। যখন মেশিনে ভাঙানো হয় তখন ঘর্ষণে লোহার কনা উত্তপ্ত হয়ে তুলাতে আগুন ধরে যায়। এ জন্য ঝুটের গুদামে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতি লাভের আশায় মালিকপক্ষে অবহেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের প্রাণহানি বাড়ছে। নানামুখী চাপে দুএকটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই। তাই উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের সাজার নজির সৃষ্টি করতে হবে।