সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন

করোনার ঊর্ধ্বগতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২২
  • ১৬৬ বার

করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এ ক্ষতির রেশ এখনো কাটেনি। শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের চিন্তা কাজ করছে। কেউ কেউ মনে করেন শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যেই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে বড় রকমের শর্ত রয়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

করোনার সংক্রমণ ৫ শতাংশ বা তার নিচে চলে আসার পর অনেকের মধ্যেই দেখা গেছে শৈথিল্যের ভাব। করোনার অতিমারি এখন পর্যন্ত পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, এ সত্যটি অনেকেই উপলব্ধি করতে পারছে না। অনেকের চালচলনে যে ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায়, তা থেকে মনে হচ্ছিল করোনার সংক্রমণ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। করোনা নিরীহ কোনো ভাইরাসের নাম নয়।

এ ভাইরাসটি প্রতিনিয়ত মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। এদের নতুন রূপ অতীতের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। সম্প্রতি ওমিক্রন নামে পরিবর্তিত ধরনের একটি ভাইরাস দেখা দিয়েছে। এ ভাইরাসটি অতীতের ভাইরাসগুলোর তুলনায় কম প্রাণসংহারক হলেও এর সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি। রাতারাতি হাজার হাজার মানুষের মধ্যে এর সংক্রমণ ঘটে। কাজেই এ ভাইরাসটির ব্যাপারে নিশ্চুপ বসে থাকার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশে এর আগে যে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল, তার ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক নামিদামি মানুষ কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ থেকে বেঁচে উঠতে পারেননি। তাদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে। এ মানুষগুলো ছিলেন দেশের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। তাদের হারিয়ে জাতি উচ্চতর চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে দরিদ্র হয়ে গেছে। কোভিড-১৯-এর কারণে কলকারখানা বন্ধ থাকার ফলে অনেকে চাকরি হারিয়েছে।

অনেকে অনানুষ্ঠানিক সেবা খাত থেকে ছিটকে পড়েছে। রাজধানী ঢাকায় এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বিশাল। তারা বাধ্য হয়েছে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে। এ ধরনের মানুষরা ঢাকায় এসেছিলেন শহরের আয় গ্রামের আয়ের সঙ্গে যোগ করে একটু ভালো থাকার জন্য। তারা গ্রামে ফিরলে তাদের আপনজনরা তাদের ওপর থেকে মুখ ফেরাতে পারেনি।

সুনির্দিষ্ট আকারের হাঁড়িতে যেটুকু রান্না হতো, সেটাই তারা ভাগ করে খেয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পরিবারের গণ্ডিতে ভাগাভাগি করে খাওয়ার রীতি বহু পুরোনো। নৃ-বিজ্ঞানীরা এটাকে বলেন Income sharing practice. কোভিড-১৯-এর পুরো সময়টি সমাজবীক্ষণের জন্য অতি উত্তম সময়।

তবে এ সময়ে মানবিকতার যে বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি তার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে খুন-খারাবি ও ধর্ষণসহ নানা সামাজিক অপরাধে। মেয়েশিশুরা অনেকেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। বাল্যবিবাহের কবলে না পড়লে তাদের জীবনটা হয়তো কিছুটা আনন্দদায়ক হতে পারত।

প্রথমেই উল্লেখ করেছি, কোভিড-১৯-এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। স্কুল বন্ধ থাকার ফলে শিশুরা, বিশেষ করে শহুরে শিশুরা একঘেয়ে জীবনের গ্লানি ভোগ করেছে। স্বাভাবিক সময়ের মতো পড়তে বসার তাগিদ হারিয়ে ফেলেছে। এর সঙ্গে যখন যুক্ত হলো অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা না করার নিষেধ, তখন তাদের জীবনটা হয়ে উঠল ইটের গাঁথুনির সংকীর্ণ ছিদ্র পথে কীটপতঙ্গ যেভাবে জীবনযাপন করে অনেকটা তার মতো।

বলা যায়, Insect like existence. কোভিড সংক্রমণের প্রকোপ হ্রাস পাওয়ার পর মনে হচ্ছিল সব যেন ঠিক হয়ে গেছে। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। বহু স্কুল-কলেজ খোলেনি। যেগুলো খুলেছে সেগুলো স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার জন্য পুরোদমে ক্লাস চালাতে পারেনি। এসএসসি পরীক্ষাটি হলো সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। পরীক্ষার ফল বেরোবার পর দেখা গেল দেশে জিপিএ-৫-এর বন্যা। এতে শিশুরা সাময়িকভাবে উৎফুল্ল হলেও স্থায়ীভাবে উৎফুল্ল থাকার কোনো ভিত্তি ছিল না।

অনেক শিশুর মধ্যে মিথ্যা অহংবোধের সৃষ্টি হয়েছে যা মনস্তাত্ত্বিকভাবে তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও জানা গেছে কোভিডের সময়ে ধনীরা অনেক বেশি ধনী হয়েছে এবং গরিবরা আরও গরিব হয়েছে। বিশ্ব পরিসরে জাকারবার্গ ও মিলিন্ডার মতো ১০ জন ধনী দ্বিগুণ ধনী হয়েছে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ঘটে যাওয়া এ মেরুকরণ নতুন ধরনের সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সভ্যতার ইতিহাস পাঠে জানা যায়, প্রতিটি অতিমারির পর পৃথিবীতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। এখন শুরু হয়েছে ওমিক্রনের ঢেউ। বাংলাদেশে ওমিক্রনের ঢেউ প্রবল বেগে আছড়ে পড়েছে। প্রতিদিনই সংক্রমণের হার বাড়ছে।

দেশে যখন শিক্ষাঙ্গনগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল। রহস্যজনকভাবে সেই উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। দৈনিক সমকাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সম্পর্কে শিরোনাম করেছে ‘ক্যাম্পাসে অস্থিরতার পেছনে শিক্ষক রাজনীতি’।

এই পত্রিকায় ছাত্র বিক্ষোভের যে ছবি ছাপানো হয়েছে, তার সম্মুখভাগে ব্যানারে প্রতিবাদের ভাষায় লেখা হয়েছে, ‘শাবিপ্রবি বন্ধ ঘোষণার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বাতিল এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দালাল ভিসিকে অপসারণ করতে হবে, হামলাকারী পুলিশ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বিচার করতে হবে, বিক্ষোভ সমাবেশ। ব্যানারের ভাষা থেকে যতদূর বোঝা যায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে রূপ নিয়েছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীদের কিছু দাবির বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সহানুভূতিশীল সাড়া দিতে বিলম্ব হওয়ায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তবে এর পেছনে শিক্ষক রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে বলে ক্যাম্পাস অভ্যন্তরের সংশ্লিষ্টরা জানান।

এক পর্যায়ে অবরুদ্ধ উপাচার্যকে মুক্ত করতে লাঠিচার্জসহ পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ আরও বড় অসন্তোষের জন্ম দেয়। আন্দোলনের মূল দাবিকে পেছনে ফেলে এখন দাবি উঠেছে উপাচার্য ফরিদউদ্দিন আহমদের অপসারণ। করোনাকালীন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ সামলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হওয়ার পর হঠাৎ অস্থিরতা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপাচার্য মনে করেন দাবি পূরণ সত্ত্বেও তাকে অবরুদ্ধ করাসহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়বহির্ভূত শক্তির ইন্ধন রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট জাফরিন আহমদ লিজার অসদাচরণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে হলের ছাত্রীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। শুক্রবার থেকে ছাত্রীরা সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেও কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ আছে।

এ নিয়ে আলটিমেটাম দিয়েও কাজ না হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সেদিন সন্ধ্যায় উপাচার্যকে মুক্ত করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ক্যাম্পাসে পুলিশের এরূপ অ্যাকশন কখনো দেখা যায়নি। এ কারণে উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে। সাধারণ দাবি-দাওয়ার আন্দোলন থেকে আন্দোলনটি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়।

উপাচার্য মনে করেন, এ আন্দোলনে বহিরাগতদের ইন্ধন রয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। কিছু শিক্ষার্থী হল ত্যাগ করলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এ আদেশ অমান্য করছে।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়ই উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা যায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি যদি নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তাহলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া হয় ডেপুটেশনে অন্য কোনো পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্য থেকে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৫-২০ বছর অতিক্রম করে, তাহলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের মধ্য থেকে উল্লেখিত পদে নিয়োগের জন্য আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। এই আকাঙ্ক্ষার ফলে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তারই ফল হিসাবে দেখা যায়, সরকার নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অধ্যাপকদের বিরোধের একটি স্বাভাবিক ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আঞ্চলিকতা এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের পার্থক্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অথবা বিচার বিভাগ থেকে অথবা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সরকার উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্য ও যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ার ফলে এদের নিযুক্তি তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চমৎকারভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছে।

দেশে অঢেলসংখ্যক পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তির দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু তারা খুব কম ক্ষেত্রেই পাণ্ডিত্য ও প্রশাসনিক দক্ষতায় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসাবে বরিত হন না। এসব লোকের হাতে পড়ে দেশের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দলীয় রাজনীতির অপচর্চায় পড়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন সব ব্যক্তিকে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার পদে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যারা বিতর্কিত হয়েছেন।

ইদানীং আরেকটি দুঃখজনক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ প্রবণতা হলো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে যদি কোনো আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে, তাহলে সেই আন্দোলনকে বল প্রয়োগ করে থামিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন।

এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্কেও ক্ষত সৃষ্টি হয়। এই ক্ষত সহজে অপসারণ করা যায় না। আমাদের প্রবৃদ্ধির হার যতই হোক না কেন, আমরা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, তাহলে শেষ বিচারে কোনো মেগা প্রকল্পই আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। আমাদের উন্নয়ন কখনোই টেকসই হবে না।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com