মেগা প্রকল্প গ্রহণে অগ্রাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়া ও স্থান নির্বাচনে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেওয়ায় শতাব্দীর প্রাচীনতম নৌরুট নগরবাড়ী-আরিচা-দৌলতদিয়া ভূগোলের পাতা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক ঈর্ষাপরায়ণতার বিষয়টিও জড়িত।
গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত জেনারেল এরশাদ রংপুর যাওয়ার পথে ফেরি বিভ্রাটে পড়ে দীর্ঘসময় আরিচা ঘাটে আটকা পড়েছিলেন। তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে আরিচা ঘাটের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয়। যা এখনও চলছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন (অব:) আব্দুল হালিম চৌধুরী। শিবালয় হরিরামপুর নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-২ আসন ছিল তার নির্বাচনী এলাকা। ১৯৫৪ সাল থেকে মানিকগঞ্জ-২ আসনটি সিলেট-১ আসনের মতো মর্যাদাবান আসন বলে বিবেচিত হতো। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য হিসেবে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়েছিলেন মরহুম আব্দুল লতিফ বিশ্বাস যিনি সাবেক মন্ত্রী মরহুম এম কে আনোয়ারের শ্বশুর ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভায় তিনি খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। মানিকগঞ্জ সদর আসনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত এমএনএ মরহুম মোসলেমউদ্দিন খান হাবু মিয়া ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে উপনির্বাচনে এই আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম প্রথমে আইনমন্ত্রী পরে উপরাষ্ট্রপতি হন। বেগম খালেদা জিয়ার আমলে এই আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত এমপি মরহুম হারুন অর রশীদ খান মুন্নু মিয়া দফতরবিহীন মন্ত্রী হন। অথচ অবৈধ ফখরউদ্দীন-মইনউদ্দিন সরকারের নিয়োগকৃত ড. এ টি এম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে গ্রামের জনগণকে বঞ্চিত করে পল্লী অঞ্চলের যে ১০টি আসন বিলুপ্ত করে ঢাকাকে সাতটি, চট্টগ্রামকে দুটি ও গাজীপুরকে একটি আসন উপহার দিয়েছিলেন তার মধ্যে মানিকগঞ্জ-২ আসনটিও ছিল। মানিকগঞ্জ-২ আসনটি বিলুপ্ত করে শিবালয় উপজেলাকে মানিকগঞ্জ-১ আসনের ঘিওর-দৌলতপুরের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং হরিরামপুরকে মানিকগঞ্জ-৩ সিঙ্গাইরের সাথে সংযুক্ত করায় আসনটি পাটুরিয়া ঘাটের তিন কিলোমিটার ভাটি থেকে শুরু হয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। ফলে শিবালয় ও হরিরামপুর উপজেলা থেকে গত তিনটি নির্বাচনে কেউ জয়ী হতে পারেননি। রাষ্ট্রপতি জিয়া ১৯৭৮ সালে খাল খননের মাধ্যমে সেচ দিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনের যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তার শুভ উদ্বোধন হয়েছিল আরিচাঘাট থেকে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশের খাদসমূহ সংস্কার করে খালে রূপান্তর ঘটিয়ে আরিচাঘাটে ১৫-২০টি শক্তিশালী পাম্পের সাহায্যে যমুনা নদী থেকে পানি উত্তোলন করে খালে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন। আরিচার ২ কিলোমিটার ভাটিতে কাসাদহ খাল পুনঃখনন করে একইভাবে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে কয়েক হাজার একর জমিতে সেচের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল ইরিধান চাষের ব্যবস্থা করে তিনি হাজার হাজার কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর পাম্পের মুখে নদী ড্রেজিং করে পানিপ্রবাহ চালু না রাখায় তা বন্ধ হয়ে গেছে।
ভবিষ্যতে আরিচা-নগরবাড়ী পয়েন্টে যমুনা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনায় ১৯৭৯ সালে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তায় যমুনা নদীর মধ্যে টাওয়ার বসিয়ে ইস্ট-ওয়েস্ট গ্রিড লাইনের সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল।
যমুনার ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ১৯৮৫ সালের জুলাই থেকে তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যাংকিং লেনদেন, বিদ্যুৎ গ্যাস, টেলিফোন বিলসহ সব ধরনের বিলের ওপর ৫% সারচার্জ আরোপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যমুনার ওপর সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে আরিচাঘাটে আটকে পড়ার বিষয়টিও বলেছিলেন। তাকে ক্ষমতা দখলে সহায়তাকারী বিচারপতি সাত্তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজগঞ্জের সন্তান ডা: আব্দুল মতিনকে পুরস্কৃত করতেই জেনারেল এরশাদ যমুনা সেতু নির্মাণে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য স্থান আরিচা-নগরবাড়ী পয়েন্টকে গুরুত্ব না দিয়ে ১০০ কিলোমিটার উজানে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে স্থান নির্বাচন করেছিলেন। ঠিক যেমন আওয়ামী লীগ ও জাপাকে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় নিতে সরকারি কর্মচারীদের বিদ্রোহ ঘোষণার নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। তেমনি এক-এগারো ঘটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৬৫ আসন দখলে সহায়তাকারী জেনারেল মইনকে বিডিআর বিদ্রোহের কারণে পুরস্কৃত করা সম্ভব না হলেও তার দক্ষিণহস্ত রক্ষীবাহিনীর সাবেক ডেপুটি লিডার জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে জাপার কোটায় এমপি করা হয়েছে। আবার বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ে ক্ষমতায় থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে পারায় তাকে অবসর গ্রহণের পর ১০ বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান করে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
জেনারেল এরশাদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় দীর্ঘদিন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন দক্ষিণবঙ্গের পিরোজপুরের কৃতী সন্তান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও মাদারীপুরের কৃতী সন্তান সৈয়দ আবুল হোসেন; তারা উভয়ে দক্ষিণবঙ্গের সন্তান হওয়ার কারণে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্ট থেকে ১০০ কিলোমিটার ভাটিতে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর স্থান নির্বাচন করেছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয়ে স্থান নির্বাচনে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেওয়ায় মানিকগঞ্জ ও বৃহত্তর ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা এবং রাজশাহীবাসী যেমন ১০০ কিলোমিটারের ফাঁদে পড়ে বঞ্চিত হয়েছে তেমনি সেতু ও রেললাইন নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। কলকাতা থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত রেললাইন থাকায় শুধু টঙ্গী থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত রেলসড়ক নির্মাণ করলেই চলত। এতে শুধু বাংলাদেশ উপকৃত হতো না, সিলেটের তামাবিল হয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ সহজতর হতো। পদ্মা সেতু, মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে করায় জাজিরা থেকে দক্ষিণে মাদারীপুর-বরিশাল মহাসড়ক পর্যন্ত ও পশ্চিমে শিবচর-ভাঙ্গা-মকসুদপুর গোপালগঞ্জ হয়ে যশোর, খুলনা পর্যন্ত নিচু বন্যাপ্রবণ এলাকা দিয়ে রেললাইন নির্মাণের কারণে প্রকল্প ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা ও সেতু প্রকল্পে ৩০ হাজার কোটি টাকা একুনে ৮০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বিএনপি সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগাযোগমন্ত্রী থাকায় তার নির্বাচনী এলাকার পাশে মাওয়াঘাট হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালে পদ্মা সেতুর মাওয়ার যে স্থানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সেটা কিছুটা পশ্চিমে তার নির্বাচনী এলাকায় সরিয়ে নেয়ার চেষ্টায় এর মাটি পরীক্ষা করতেই পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন। পদ্মা সেতু পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে করলে রেলপথ নির্মাণে যত টাকা সাশ্রয় হতো তা দিয়ে ২০২৩ সাল থেকে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সড়ক সেতু নির্মাণ করা যেত। প্রকল্পের অগ্রাধিকার বিবেচনা না করে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে পূর্ববর্তী সরকারের প্রতি ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে ও ইচ্ছাপূরণ এবং নাম ফুটানোর জন্য প্রকল্প গ্রহণ ও স্থান নির্বাচনের মাশুল দিতে হচ্ছে অবহেলিত এলাকার জনগণকে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন থাকা সত্তে¡ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে রেলব্রিজ না করে বঙ্গবন্ধু সেতুর এক কিলোমিটারের মধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পৃথক রেল সেতুর কাজ শুরু করা হয়েছে। চট্টগ্রাম শহর ডুবতে বসেছে অথচ সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর তিনটি সেতু থাকা সত্তে¡ও অপর পাড়ে আনোয়ারায় আধুনিক চট্টগ্রাম শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। আগে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন ছিল বিদ্যমান চট্টগ্রাম শহর রক্ষা প্রকল্প। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন পদ্মার ওপর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করলে চর পড়ে নদী মরে যাবে। তাই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নয় টানেল করা হবে। গত ১৩ বছরে সড়কপথ উন্নয়নের ওপর যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে রেলপথ উন্নয়নে তা না দেওয়ায় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সরকার সমর্থক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ১৩ বছরে ৬০০টি একনেকের সভায় যে ৭০-৮০ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে তাতে দ্বিতীয় যমুনা ও পদ্মা সেতু বা পদ্মা টানেলের মতো প্রকল্প স্থান পেয়েছে বলে জানা যায় নাই।
জনগণের ভোট ছাড়া একটানা ক্ষমতায় থাকার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে জনগণকে। বাজেট বাস্তবায়নে প্রতি বছর দুই লক্ষাধিক কোটি টাকা ঋণ করতে হচ্ছে। বছরে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ৭০ হাজার কোটি টাকা অচিরেই যা এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাবে, মাথাপিছু যা চার হাজার ৫০০ টাকা।
চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ে দেউলিয়া হতে চলেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা। সেখানে মাথাপিছু জিডিপি আমাদের দেশের দ্বিগুণ। ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। চীনা ঋণে বিআরআইর আওতায় হামবান টোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হয়েছিল। কলম্বো সমুদ্রবন্দরের কাছে চায়না সিটি নির্মাণ করা হয়েছে। বন্দর ব্যবহারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকায় বন্দরের আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি চীনের কাছের লিজ দেয়ায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কোপানলে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। সমুদ্রবন্দর, চায়না সিটি ও কয়েকটি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে যথাযথ মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ না করায়, শ্রীলঙ্কা চীনা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে। আমাদের পায়রা বন্দরের অবস্থা হয়েছে অনুরূপ। ড্রেজিং করে জাহাজ চলাচলের দীর্ঘ চ্যানেল চালু রাখার সক্ষমতা বাংলাদেশের নাই। তদুপরি প্রতিটি প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।
যে হারে চীনা ও বিদেশী ঋণ গ্রহণ করে মেগা ও ইচ্ছা পূরণের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চলছে তাতে আগেভাগেই সাবধান না হলে আমাদের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।