হতাশা দিয়েই বছর শুরু করেছিল দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর যে হতাশার সূত্রপাত বছর শেষেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা। দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদার জিয়া কারাগারে থাকায় দলের সামনে যে সুদিন আসছে, তেমন কোনো ইঙ্গিতও নেই।
খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই দলকে পুনর্গঠন করে সরকারকে নতুন করে নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনের চিন্তা করেছিলেন বিএনপির নীতি নির্ধারকরা। কিন্তু দলটি বছরজুড়ে মূলত আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল এবং সংবাদ সম্মেলনের মতো অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, নেতৃত্বের সংকট, কার্যকর কর্মসূচির অভাব, রাজনৈতিক কৌশল এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দলের সিনিয়র নেতাদের জনগণের সাথে সম্পৃক্ততার অনিচ্ছার কারণে বিএনপি সারা বছর ধরে ব্যর্থতার চক্রটি ভেঙে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।
বিশ্লেষকরা আরো মনে করেন, রাজনীতিতে প্রায় ১৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির পুনর্জীবিত হওয়া আগামী বছরগুলোতে আরো কঠিন হবে। কারণ তাদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘২০১৯ সালে বিএনপির কোনো সাফল্য নেই। কারণ এই সময়টাতে তাদের রাজনীতিতে ফিরে আসার কোনো লক্ষণই আমার চোখে পড়েনি।’
বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে সরকারের ওপর কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি। তারা লন্ডনে থেকে নেতার আদেশ পাওয়া এবং সভা সমাবেশে ফাঁকা বক্তবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন।
যেভাবে গেল ২০১৯
বছরের শুরুতে বিএনপি নেতারা গতবছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কারণ তারা মাত্র ছয়টি আসন পেয়েছিল এবং জোটের শরিক দল গণফোরাম পেয়েছিল দুটি আসন।
৩ জানুয়ারি বিএনপি ও জোটের শরিকরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন করে নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনে একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। ৬ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেন।
৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারের প্রথমবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে নেতারা খালেদাকে মুক্ত করে আনা, দলকে পুনর্গঠিত করা এবং সরকারকে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করার ঘোষণা দিয়েছিল।
১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৮০ জন প্রার্থী নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা করেন। কিন্তু তারা এই আইনী লড়াইয়েও হেরে যান।
২২ ফেব্রুয়ারি, বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতির আসল দৃশ্য’ দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে দেখানোর জন্য ‘গণশুনানি’র আয়োজন করে।
৫ মার্চ বিএনপির সিনিয়র নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে দেখা করে খালেদার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানান।
পরে ১ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) স্থানান্তর করা হয়। এখনো তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।
ঐক্যফ্রন্ট সংসদে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিলেও ৭ মার্চ গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর একাদশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ নেন। এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া জোটের অন্য সাংসদরাও শপথ নেন। বিএনপির সাংসদদের শপথ গ্রহণও ২০১৯ সালে একটি আলোচিত ঘটনা ছিল।
খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সরকারের সাথে সমঝোতা হয়েছে এমন সিদ্ধান্তে বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছিল বলে তখন জনমনে চাওর হয়েছিল।
এরপর বিএনপির সংসদ সদস্যরা খালেদাকে প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে চেষ্টা করেন এবং তারা ২ অক্টোবর বিএসএমএমইউতে তার সাথে দেখা করেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তাদের প্রস্তাবে রাজি হননি।
দলীয় নেতারা খালেদাকে মুক্ত করার জন্য আইনী লড়াই চালিয়েছিল, কিন্তু জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় উচ্চ আদালতে বিএনপি প্রধানের জামিন নাকচ হওয়ায় আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালেদাকে মুক্ত করার সুযোগ স্পষ্টতই শেষ হয়ে গেছে।
সংগঠনকে পুনর্গঠিত করার পদক্ষেপের অংশ হিসাবে বিএনপি তার ৪০টি জেলা ইউনিট এবং এর বেশিরভাগ সহযোগী সংস্থার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে, তবে দলটি এখনও এই প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি এবং জাতীয় কাউন্সিলেরও প্রস্তুতি নিতে পারেনি।
১৯ জুন দলের অনেক সিনিয়র নেতাদের উপেক্ষা করে দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়।
ছাত্রদলের কমিটি, পদত্যাগ, নিহত:
বিএনপির সহযোগী ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলনের মুখোমুখি হয় দলের নীতিনির্ধাকরা।
যদিও, ১৮ অক্টোবর সকল প্রতিকূলতাকে পরাভূত করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কাউন্সিলের মাধ্যমে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি এবং ইকবাল হোসেন শামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এরপর লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের নেতৃত্বে নাখোশ হয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান দল থেকে পদত্যাগ করেন।
৪ নভেম্বর দলটি তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকে হারায়। যিনি ৬৭ বছর বয়সে নিউইয়র্কে একটি হাসপাতালে মারা যান। বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল ২১ এপ্রিল মারা যান, এছাড়াও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহও এবছরের ১৭ এপ্রিল মারা যান।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০১৯ সাল শুধু বিএনপির জন্য নয়, সমগ্র জাতির জন্যই খারাপ বছর ছিল।
‘এই বছরের শুরুতে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে অবৈধভাবে একটি সরকার ক্ষমতা দখল করেছে। বর্তমান সরকার বারবার আমাদের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে জামিন পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অপকর্ম এবং ব্যাপক দুর্নীতিও এই বছরে প্রকাশিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে, এটি দেশের মানুষের জন্য খুব খারাপ বছর,’ বলেন তিনি।
এ বছর তাদের দলের অর্জন কি এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, সরকার বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে তাতে দলীয় কোনো রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনের সুযোগ নেই। ‘সরকার সর্বদা দমনপীড়ণ আচরণ করে রাজনীতি থেকে আমাদের নির্মূল করার চেষ্টা করছে। তারপরও, আমাদের দল ঐক্যবদ্ধ এবং আমরা আমাদের অস্তিত্ব এবং জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, এটিই আমাদের সাফল্য।’
খালেদাকে জেল থেকে মুক্তির ব্যর্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বছর যে অনেক কিছু অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তার জন্য দলের নেতারা দায়ী নন। ‘আমরা সরকারের অপব্যবহারের কারণে ব্যর্থ হয়েছি, আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছে।’
তিনি আশাবাদী যে, তার দল ২০২০ সালে অনেক কিছু অর্জন করতে সক্ষম হবেন। ইউএনবি।