কথিত আছে, ‘ভালোবাসা ও যুদ্ধে সব কিছুই বৈধ’। এখন এই দু’টির সাথে আরো একটি বস্তু যুক্ত হয়েছে। সেটি হচ্ছে নির্বাচনের ময়দান। যেখানে আপনি জনগণকে মূল বিষয় থেকে সরানোর জন্য উল্টাপাল্টা যা ইচ্ছা বলতে পারবেন। অথচ নির্বাচনী আচরণবিধি মোতাবেক নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় এমন কোনো বিষয় উত্থাপনের মোটেও অনুমতি নেই, যার কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আঘাত আসে। কিন্তু আপনারা দেখছেন, যখন থেকে সাম্প্রতিক বিধানসভার নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তখন থেকে মারাত্মকভাবে পরিবেশ নষ্ট করার যাবতীয় চেষ্টা চলছে। আর নির্বাচন কমিশন এটাকে বেশ শান্তভাবেই মেনে নিচ্ছে। এ কারণেই এখন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকারী কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে আচরণবিধির কোনোটাই প্রয়োগ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের এই গড়িমসির ফলেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভোটের ক্ষেত্র তৈরিতে কোনো ত্র“টি করা হচ্ছে না। এ কারণেই যে সময় উত্তরপ্রদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোট হচ্ছিল, তখন সেখানে হিজাব, অভিন্ন সিভিল কোড ও গাজওয়ায়ে হিন্দের মতো ইস্যুগুলোকে বেশ বাতাস দেয়া হচ্ছিল। এগুলোর মধ্যে কোনো ইস্যুই এমন নয়, যাকে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেছিল কিংবা গণকল্যাণের সাথে যার কোনো সম্পৃক্ততা আছে। তবে হ্যাঁ, এই ইস্যুগুলোর ভিত্তিতে জনগণকে ধর্মীয় শ্রেণিবিন্যাসে অনায়াসে বিভক্ত করা যায় এবং তাদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে শাসনের দণ্ডা ঘোরানো যায়। অথচ অনুভ‚তিসম্পন্ন জনগণ এই সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদী শক্তিগুলোর এই কৌশলকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এটাই যে, এ ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে এবার নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ কেন নিলো না?
আমি এক সপ্তাহ ধরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ঘুরে বেরিয়েছি। সেখানে দুই দফায় ভোট সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম দফায় রাজধানী দিল্লি সংলগ্ন ওই আসনগুলো ছিল, যেখানে সমাজবাদী পার্টি ও আরএলডি (রাষ্ট্রীয় লোক দল) জোটের প্রার্থীরা বিজেপির হেভিওয়েট নেতাদের সাথে তুমুল লড়াই করেছেন। দ্বিতীয় ধাপে ভোট হয়েছে রোহিলাখণ্ডের জেলা রামপুর, মুরাদাবাদ, আমরুহা ও বিজনুরে। এখানে সেই সব আসন রয়েছে, যেখানে মুসলিম ভোটার রয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। বরং কিছু আসন এমনও রয়েছে, যেখানে মুসলিম ভোটার রয়েছে অর্ধেকের বেশি। অর্থাৎ তাদের হাতেই রয়েছে চূড়ান্ত রায়ের চাবিকাঠি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আসনটি হচ্ছে রামপুর। এখানে মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ। এখান থেকে সমাজবাদী পার্টির নেতা আজম খাঁ ৯ বার বিধানসভার নির্বাচনে জিতেছেন। ২০১৯ সালে তিনি এখান থেকে লোকসভা নির্বাচনেও জয়লাভ করেন। তিনি এখন সীতাপুর কারাগারে রয়েছেন। তিনি কারাগার থেকে এবার তার প্রিয় নির্বাচনী এলাকা রামপুর থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। তার পুত্র আবদুল্লাহ আজম রামপুর শহরের পার্শ্ববর্তী সুয়ার আসন থেকে ভাগ্যের পরীক্ষা করছেন। মনোরম কথা হচ্ছে, রামপুরে আজম খাঁর বিপরীতে তার পুরনো প্রতিদ্ব›দ্বী নওয়াব কাজেম আলী খাঁ নির্বাচনে লড়ছেন। আর তার পুত্র হায়দার আলী খাঁ সুয়ারে আজম খাঁর পুত্র আবদুল্লাহর সাথে লড়াই করছেন। অপর বহু প্রার্থীর মতো তাদের ভাগ্য ইভিএম মেশিনে আটকে গেছে। ১০ মার্চ তেমনই ফায়সালা জানা যাবে।
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও রোহিলাখণ্ডের যে আসনগুলোতে ১০ ও ১৪ ফেব্র“য়ারি ভোট গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে এটি বলা জরুরি যে, ২০১৭ সালের নির্বাচনে এগুলোর বেশির ভাগ আসনেই বিজেপি জয়লাভ করেছিল। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনগুলোতেও বিজেপি প্রার্থী জিতেছেন। বিজেপি এবারো এই আশায় ছিল যে, তারা ২০১৭ সালে মুসলিম ভোটারদের অকেজো বানানোর যে কৌশল প্রস্তুত করেছিলেন, তা এবারো কাজে দেবে। কিন্তু এবার জনগণের প্রবল ঝোঁক দেখে অনুমান করা যাচ্ছে যে, পশ্চিম ইউপি থেকে বিজেপির আসন হাতছাড়া হয়ে যাবে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, পশ্চিম ইউপি ও রোহিলাখণ্ডের এই আসনগুলোতে কৃষকদের শক্তি রয়েছে। আর কৃষকদের আন্দোলন এখানে মুসলিম-জাট ভোটারদের এমনভাবে এক কাতারে নিয়ে এসেছে যে, এটাকে ভেঙে ফেলার সব ধরনের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে দেখা যাচ্ছে।
চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিম ইউপিতে মুসলমানদের ভোটগুলো যেভাবে নষ্ট হয়েছিল, তার ক্ষতিপূরণ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এভাবে হয়েছিল যে, এখানকার পাঁচটি লোকসভার আসনে এসপি (সমাজবাদী পার্টি) ও বিএসপির (বহুজন সমাজ পার্টি) মুসলিম প্রার্থীরা সফলতার পতাকা উড়িয়েছিলেন। সেখানে একদিকে সাহারানপুর ও আমরুহা থেকে বিএসপির হাজি ফজলুর রহমান ও কনুর দানেশ আলি জিতেছিলেন। অপর দিকে মুরাদাবাদ, রামপুর ও সম্ভল থেকে যথাক্রমে- ড. এসটি হাসান, আজম খাঁ ও ড. শফিকুর রহমান বারক জয়লাভ করেন। এবার পশ্চিম ইউপিতে ভোটের আবহাওয়া দেখে স্পষ্ট অনুমান হচ্ছে, এখানে জাট ও মুসলমান কৃষকদের ঐক্য রঙ ছড়াবে।
এখন আসুন ওই চেষ্টাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি, যা জাট-মুসলিম ঐক্যকে ভেঙে ফেলার জন্য করা হয়েছে। সর্বপ্রথম মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এ কথা বলেন যে, উত্তরপ্রদেশে মূল লড়াই শতকরা ৮০ বনাম শতকরা ২০ ভাগের মাঝে। এর স্পষ্ট ইঙ্গিত হিন্দু মুসলিম ভোটের দু’টি শ্রেণীর দিকে করা হয়েছে। কেননা, এ কথা সবাই জানেন, উত্তরপ্রদেশের ২২ কোটি জনসংখ্যার মাঝে মুসলিম জনসংখ্যা শতকরা ২০ ভাগের কাছাকাছি। এটি মূলত সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভোটারদের বিভক্ত করার প্রথম চেষ্টা। এরপর তারা কায়রানা এলাকার দিকে পা বাড়ান। ওখানে ২০১৫ সালে উত্তেজিত হিন্দুদের নামসর্বস্ব সমতল ইস্যু প্রকাশ পায়। এর দ্বারা যখন কাজ হলো না, তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তীর-ধনুক গুটিয়ে নেন এবং তিনি ২০১৩ সালের মোজাফফরনগর দাঙ্গাকে পশ্চিম ইউরোপি’র নির্বাচনের কেন্দ্রীয় ইস্যু বানানোর চেষ্টা করেন। এরপর শেষ অস্ত্র হিসেবে ৬৫০ বছর আগের জাট ও মোগলদের একটি যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে অমিত শাহ বলেন, ‘যেভাবে জাটরা মোগলদের সাথে লড়াই করেছিল, অনুরূপভাবে আমরাও লড়াই করছি।’ অবশ্য তিনি এ কথা বলেননি, নির্বাচনের ময়দানে মোগল কে?
নির্বাচনী ময়দানে হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করার জন্য হিজাব ইস্যুকে বাতাস দেয়া হয়েছে। আর গৃহপালিত মিডিয়া কর্নাটকের হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের বিরুদ্ধে হইচই শুরু করে দিয়েছে। এই ইস্যুতে এমআইএম প্রধান ব্যারিস্টার আসাদুদ্দীন ওয়াইসী বলেন, ‘হিজাব পরিধান করে আমাদের মেয়েরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রীও হবে।’ তার এই কথায় বিজেপি মহলে কম্পন ধরে গেছে। ব্যারিস্টার ওয়াইসীর এই বক্তব্যকে ‘গাজওয়ায়ে হিন্দ’-এর সাথে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টিকে ভারতের ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার আশঙ্কা পর্যন্ত টেনে নেয়া হয়েছে। অথচ এ কথা সবাই জানেন, সংবিধানের আলোকে এই দেশের প্রতিটি নাগরিক-তার ধর্ম, জাত, জীবনাচার যাই হোক না কেন- প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য। কিন্তু শাসকদল এই বক্তব্যকে একেবারে উল্টাভাবে উপস্থাপন করেছে এবং এটাকে অনাবশ্যকরূপে তর্কবিতর্কের বিষয় বানিয়েছে। বাহ্যত এটি পশ্চিম ইউপির নির্বাচনকে সাম্প্রদায়িকতার রূপ দেয়ার শেষ চেষ্টা ছিল, যাকে ভোটাররা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এখন এই প্রশ্ন উঠে যে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বক্তৃতা-ভাষণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সাম্প্রদায়িকতামূলক বক্তব্য ও উসকানি দেয়াকে প্রতিহত করতে এতে বেশ জোর দেয়া হয়েছে। তাহলে ইউপিতে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য কোনো রাজনীতিবিদকে কেন নোটিশ দেয়া হয়নি? অতীতে সাম্প্রদায়িকতামূলক বিদ্বেষ ছড়ানো ব্যক্তিদের লাগাম টেনে ধরা হতো। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হতো। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন নিজেদের এই দায়িত্বের ক্ষেত্রে পুরোপুরি চোখ বুজে রেখেছে। সম্ভবত এর কারণ হচ্ছে, শাসকদলের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে যাদের আচার-আচরণকে দেখেও না দেখার ভান করতে এখন রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো বাধ্য হয়ে গেছে।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব