দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০২০ সালের এই দিনে প্রথম দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তার ঠিক ১০ দিন পর করোনায় আক্রান্ত প্রথম রোগী মৃত্যুর কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। পরের দিন যত এগিয়েছে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও স্রোতের মতো বেড়েছে রোগীর সংখ্যা ও প্রাণহানি। এর মধ্যে সংক্রমণের অন্তত তিনটি বড় তরঙ্গ আঘাত হেনেছে এখানে। ২০২০ সালের প্রাথমিক ধাক্কার পর ওই বছরেরই শেষের দিক থেকে করোনার নয়া মারাত্মক ধরন ডেল্টার প্রকোপ বড় ধরনের পরীক্ষা নেয় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার।
২০২১ সালে একদিনেই ১৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয় ও প্রাণ যায় সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের। রোগী শনাক্তের হার গিয়ে ঠেকে ৩২ শতাংশের বেশি। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের দিকে সংক্রমণ একটু কমে এলেও বছর শেষে আবার আতঙ্ক নিয়ে হাজির হয় করোনার আরেক সংক্রামক ধরন ওমিক্রন। করোনার এসব তরঙ্গের ফেরে গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেশে মোট রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ৪৭ হাজার ৭০২ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৮৯ জন মানুষ। এখনো দেশে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ৭১ হাজারের বেশি। আশা কথা হলো- এখন পর্যন্ত করোনা থেকে দেশে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১৮ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি রোগী। করোনা থেকে রক্ষায় সরকার টিকাদানের গতি বাড়ানোয় সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কমছে হাসপাতালে ভর্তির হারও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে ২০২০ সালে করোনা মহামারী ছড়িয়ে পরার পর থেকে গত দুই বছরে ভাইরাস নিজেকে পরিবর্তন করেছে বারবার। কখনো আলফা, কখনো বিটা, কখনো গামা আবার কখনো ডেল্টা বা লেমডা রূপ নিয়ে চালিয়েছে দেশে দেশে তা-ব। শুরুর দিকে আলফা যেমন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে মহামারী ডেকে এনেছিল, পরে এটি ভয়ঙ্কর ডেল্টায় পরিবর্তিত হয়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে আবার উদ্ভূত হওয়া করোনার নয়া ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণের ক্ষিপ্রতা মানুষকে শ্বাস ফেলারও সময় দেয়নি। মানুষের জীবন বাঁচাতে দেশে দেশে দিতে হয়েছে লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সামনে দুটো সম্ভাবনা- হয় কোভিড পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যাবে, যেমনটি পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলা ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয়েছে। অথবা এটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘসময় সাধারণ সর্দি-কাশি, এইচআইভি, হাম, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো রয়ে যাবে। তেমনটি হলে মহামারী শেষের পরও কোভিডের সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে। যদিও অনেকে মনে করেন, নানা ধরনে বিভক্ত হয়ে পড়ায় ও টিকা আবিষ্কারের কারণে করোনা দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশ্বে লোকজনকে টিকা দেওয়ার কারণে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা। অর্থাৎ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, মহামারীর সময় ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তবে তার মানে এই নয় যে, কোভিড একেবারে চলে যাবে। কোনো সন্দেহ নেই যে কোভিড থাকবে, কিন্তু সেটি ‘প্যান্ডেমিক’ হিসেবে নয়, থাকবে ‘অ্যান্ডেমিক’ হিসেবে।
যুক্তরাজ্যে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলিয়ান হিসক্স আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বলতে পারেন মহামারী শেষ হতে শুরু করেছে। অন্ততপক্ষে যুক্তরাজ্যে। আমার মনে হয়, ২০২২ সালে আমাদের জীবন প্যান্ডেমিকের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। করোনা ভাইরাসের দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট-ওমিক্রন তার অন্যতম লক্ষণ। এই ভ্যারিয়েন্ট যত বেশি ছড়াবে, ভাইরাসটি ততই দুর্বল হয়ে পড়বে। এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সংকটের। যদিও ভিন্নমত পোষণ করেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর।
তিনি বলেন, আমরা মহামারীর শেষ প্রান্তে এখনই এ কথা বলার সময় আসেনি। ভাইরাস যে কোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে, তার ওপর নির্ভর করছে সামনের পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়। করোনা অ্যান্ডেমিক পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন বলা যাবে, যখন এটি স্বাভাবিকভাবে সংক্রমণ ঘটাবে না। এটি শীতে, গরমে বা শরতে সংক্রমণ ঘটাবে অথবা সারাবছর দু’একজন করে আক্রান্ত হবে। কিন্তু পৃথিবীতে এখনো প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। রোগতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে বলা যায়, ৫ লাখ মানুষ শনাক্ত হলেও ধারণা করা হয় যে, এর পাঁচগুণ মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত আছেন। তাই মনে হয় না যে, খুব শিগগির করোনা মহামারীর অবসান ঘটছে। গত ১০০ বছরে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ভাইরাসের প্যানডেমিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সব মহামারী এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
জানা গেছে, করোনা সংক্রমণের গতি রুখতে এখন পর্যন্ত ২০টি টিকা সারা পৃথিবীতে রয়েছে। এসব টিকার ৯৩০ কোটি ডোজ ইতোমধ্যে দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। এত বড় টিকার কার্যক্রম, আগে কখনো হয়নি। তবে কোনো আবিষ্কারের সুফল সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারে না, পারেনি। করোনা টিকার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। ধনী দেশগুলোর ৮০ শতাংশ মানুষ যখন টিকার আওতায়, তখন গরিব দেশগুলোর ৮০ শতাংশই মানুষ টিকা পাননি। যখন ধনী দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষ বুস্টার ডোজ নেওয়া শেষ করেছেন, তখনো অনেক দেশের অগণিত মানুষ টিকার একটি ডোজের জন্য প্রতিক্ষার প্রহর গুনছেন। অনেক দেশেই শিশুদেরও টিকার আওতায় আনা হয়েছে। তবে বৈষম্য রয়েছে সেখানেও। উচ্চআয়ের দেশগুলোতে শিশুদের টিকার আওতায় আনা হলেও অনেক দেশে এই কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আমাদের দেশেও ১২ বছরের নিচের শিশুরা এখনো টিকা নিরাপত্তার বাইরে।
এ বিষয়ে ড. আলমগীর বলেন, সরবরাহের ক্ষেত্রে এখনো যে বৈষম্য, তাতে সবাইকে টিকার আওতায় আনতে কতদিন লাগবে সেটি কেউ জানি না। আমেরিকা ও ইউরোপে প্রচুর টিকা দেওয়া হয়েছে। এশিয়াতে এই সংখ্যা কম, আফ্রিকাতে আরও কম। টিকার সমবণ্টন যদি হয়, একসঙ্গে যদি সবাইকে টিকা দেওয়া যায়, তা হলে হয়তো ভাইরাসটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু গুটিকয়েক দেশে বা অঞ্চলে টিকা দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করলেই মহামারী শেষ হয়ে যাবে না। এ জন্য সারা পৃথিবীতেই একসঙ্গে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই কমতে হবে।