আজকাল এ রকমটা বেশ দেখা যাচ্ছে। কোনো শপিংমল হোক কিংবা পাড়ার যে কোনো মুদির দোকানে দাঁড়ালেই ভিক্ষুকরা ঘিরে ধরছে। সবজির দোকানে পাঁচ মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। আগে এসব শ্রেণির মানুষের পোশাক-আশাক প্রায় একই রকম হলেও ইদানীং ভিন্ন ভিন্ন লুকে দেখা যাচ্ছে। পাড়ার গল্পটিই বলি আগে। পাড়ায় বেশ বড় একটি দোকান হয়েছে- যেখানে প্রায় সবই পাওয়া যায়। একদিন দোকানের একোনা থেকে ওকোনায় জিনিস দেখতে দেখতেই দুজন পরিষ্কার শার্ট-প্যান্ট পরা লোককে ফাইল হাতে মেয়ের বিয়ের জন্য ক্যাশে বসা ভদ্রলোকটির কাছে সাহায্য চাইতে দেখলাম। দুই-তিন মিনিট পরই আমার দিকে সাহায্যের দৃষ্টিতে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলাম, ফাইলে কী আছে? বলল, একটি হাসপাতালে মেয়ের ট্রিটমেন্ট চলছে। ট্রিটমেন্টের জন্য টাকা দরকার। সাহায্যপ্রার্থী সব মানুষের এটা পুরনো স্টাইল আমি জানি। অবাক হয়ে তাদের নতুন যে সংযোজনটির কথা শুনলাম, সেটি হলো মেয়ে সুস্থ হলেই তার বিয়ে দিতে হবে। এ জন্য সাহায্য ছাড়া উপায় একেবারেই নেই! একেবারেই নেই! ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়ের বয়স কত? বলল, চোদ্দ। শুনে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, চোদ্দ বছরের মেয়ের বিয়ে? আগে দেখি ওর কী কী প্রবলেম আছে- যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে? শুনে দুজনই ফাইল খুলে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলে আমি কড়া ভাষায় বললাম- তার চেয়ে মেয়েটি মরে যাক! হ্যাঁ, এভাবেই বললাম। চোদ্দ বছরের একটি মেয়ে- যার চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে, তাকে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো! বললাম, এসব ভাবনা আসে কোথা থেকে? অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেয়েই অন্যের বাসার দাসী হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া উত্তম! এই শ্রেণির মেয়েদের ভবিষ্যৎ তো ওটাই। একমাত্র উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ছাড়া কম-বেশি সব মেয়েরই ভবিষ্যৎ ওটাই! আজকাল কিছুটা পরিবর্তন এসেছে- যা সংখ্যায় হাতে গোনা। কাজ করেই সবাইকে খেতে হবে, আমি তার বিরুদ্ধে বলছি না। কিন্তু বলছি প্রক্রিয়াটির বিষয়ে।
শুনতে খারাপ লাগে। কিন্তু কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হলে কড়া ভাষা প্রয়োগ করা হলো ডিম থেরাপি দেওয়ার শামিল! আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ফাইল গুটিয়ে লোক দুটি হাঁটতে শুরু করেছিল। পুরো কথা শোনেনি। অবশ্য শেষের কয়েকটা কথা মনে মনে বলেছিলাম। প্রথম কথাগুলো শুনেই দোকানের কর্মচারীরা সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বললাম- শোনেন, ভিক্ষা তো একদমই আমাদের দেওয়া উচিত নয়। তার পর আবার অল্পবয়সের মেয়েদের বিয়ের জন্য সাহায্য চাওয়ার নামে ভিক্ষা! ক্যাশে বসা ভদ্রলোক বিগলিত হাসি দিয়ে বললেন- জি জি, ম্যাডাম! এর আগেও অনেকবার গিয়েছি ওই দোকানে, কখনো ম্যাডাম সম্বোধন শুনিনি! এর পর যে কদিন ওই দোকানে গিয়েছি, কর্মচারীরাসহ ক্যাশের ভদ্রলোকও সমীহ করে জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়েছেন। আসলে বেশিরভাগ মানুষই কথা বলতে চায় না। কোনো অন্যায় ঘটতে দেখলেও পাশ কাটিয়ে চলে যায়- যেন কথা বলতেই শেখেনি! ঠিক সময়ে উচিত কথা বলাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি অনেকেই বোঝে না বা বোঝার চেষ্টা করে না। সময়ে উচিত কথা বলা খুব জরুরি, আওয়াজ তোলা খুব জরুরি।
কিছুদিন পরই একটা বড় শপিংমলে গিয়েছিলাম (পড়বি পড় মালির ঘাড়ে। সে ছিল গাছের আড়ে!)। ভালো একখান চেয়ার দখল করে কেবল কাপড়চোপড়ে চোখ রাখতে শুরু করেছি। দেখতে-শুনতে বেশ একজন ওখানেও হাজির হয়ে বলা শুরু করল, মেয়ের বিয়ে দতে হবে সাহায্য করেন কিছু। বুঝুন! সটাং ঘুরে বললাম, বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে মেয়েকে কাজ করতে শেখান- যেন কিছু রোজগার করতে পারে। তার পর পছন্দমতো নিজেই বর খুঁজে নিতে পারবে। আপনাদের ভিক্ষা করে বিয়ে দিতে হবে না! সেলসম্যান দুজন কাপড় রেখে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। তার মানে, এ রকমভাবে কাউকে বলতে শোনে না ওরা। হয়তো দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়, নয়তো পাঁচ-দশ টাকা দিয়ে বিদায় করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় কথাগুলো কেউ বলার প্রয়োজন মনে করে না। সবাই যদি ঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো ব্যবহার করেন, তা হলেও কিছুটা কাজ হবে বলে মনে করি। হাত পাতাদেরও তো অনুভূতি আছে, নাকি! আজকাল গরিব ঘরের মেয়েদের নিয়ে নানা টেনশনে থাকেন পিতা-মাতারা! জন্মের পর থেকেই টেনশনে ভোগেন তারা। আর সব টেনশনের সমাধান খুঁজে পান বিয়ে দিয়ে! ডিউটি শেষ! কেন বাবা, তোমার যেটুকু সামর্থ্য- সেভাবেই বিয়ের আয়োজন করো না কেন? না, তা করা যাবে না। হাত পেতে বিয়ের আয়োজনের জোগাড় করতে হবে। কী একটা সংস্কৃতি! বিয়ের পর থেকে মেয়েটির যে জীবন শুরু হয়, তার খোঁজ রাখা ফরজ-নফল কোনোটার ভেতরই পড়ে না। তাই টেনশনমুক্ত! বিয়ে দেওয়া ফরজ কাজ। ব্যস, ছুট্টি! মেয়ে, এখন তুমি যেমনে পারো বর সামলাও, বরের বাড়ির সব সামলাও। প্রচ- পেটব্যথা নিয়েও গনগনে আগুনে ভাতের হাঁড়ি বসাও!
বিয়ের কথা বলে শুধু যে গরিব মানুষই হাত পাতে, তা অবশ্য শতভাগ ঠিক নয়। আজকাল হাত পেতে নানা কায়দায় পকেটে টাকা ঢোকানোর প্র্যাকটিসটা বেড়ে গেছে। এটিই এখন কালচার! অফিস-আদালতে ঘুসের টাকা পকেটে ঢোকানো ওপেন সিক্রেট, ব্যবসা-পাতিতে দুই নম্বরি করার বিষয়টিও একেবারে খোলা জানালার মতো। হুড়মুড় করে বাতাস ঢোকে! রোজা-রমজান মাসে, নুরানি চেহারা শো-অফ করে তেলের বোতল লুকিয়ে সংকট তৈরি করা কোন ধরনের ব্যবসা? এসব করে ওনারা ঘুমান কেমন করে, তা খুব জানতে ইচ্ছা করে। এ রকম বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। এগুলো অবশ্য ভিক্ষার সংজ্ঞায় পড়ে না, ডাকাতির সংজ্ঞায় পড়ে। তবে ভিক্ষাই হলো এখন সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবসা। মুখ করুণ করে হাত পাতলেই হলো! না দিলে দেখবেন করুণ মুখের ভাষা বদলে কেমন হিং¯্র একটা লুক দিয়ে বকবক করতে করতে হনহন করে হাঁটা দেয়। বিদেশে তো তাও গিটার বাজিয়ে কিংবা ছবি এঁকে ভিক্ষা তোলার একটা সংস্কৃতি ও ভব্যতা আছে, আমাদের এখানে ডিরেক্ট হাত পাতা।
রাস্তাঘাটে যারা হাত পাতে, তাদের ধরনটা বোঝা যায়। কিন্তু অফিস-আদালত কিংবা আরও বড় কোনো জায়গায় থেকে যারা হাত পাতে, তাদের ধরন বুঝতে কিছুটা সময় লেগে যায়। বোঝার পর আত্মস্থ করতে আরও খানিকটা সময় লাগে। এই ধরনের মানুষের মনোজগতে প্রবেশ করা চাট্টিখানি কথা নয়! তার পরও খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই প্রক্রিয়ার উপার্জনে তারা কোন ধরনের আনন্দ উপভোগ করে! সেই আনন্দের ভাগীদার অন্যরাও, নাকি একাই! বাকি থাকে ফেরেকবাজি! এখানেই ক্যারিশমা দেখাচ্ছে অনেকে। মাথার নিউরনে কোষের সংখ্যা তো কম নেই, কাজে লাগানোও উচিত। তো ফেরেকবাজি মন্দ কী! এই যে সুন্দর পরিপাটি হয়ে হাতে রোগীর ভুয়া ফাইল হাতে ভিক্ষা চাওয়া- এটি এক ধরনের ফেরেকবাজি। আরও কত ফেরেকবাজির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের, তা লিখে শেষ করা যাবে না।
যে কথাটি আসলে বলতে চাই- তা হলো সঠিক সময়ে সঠিক কথা বলা, আওয়াজ তোলা। ম্যান্দা মেরে ঘাড় হেলিয়ে এড়িয়ে চলা প্রকৃত মানুষের কাজ নয়, সুবিধাবাদী মানুষের কাজ। অবশ্য উচিত কথা বলা অনেকেই নিতে পারেন না, হজমও করতে পারেন না। রাস্তার ভিক্ষুকরাও নিতে পারে না। দুনিয়ার আগড়ুম-বাগড়–ম কথা বলেন আপত্তি নেই, শুধু উচিত কথা বলতে পারবেন না! উচিত কথা বললেই বড়রা বেয়াদব বলবেন, তা আপনার বয়স যতই বাড়–ক না কেন। আর বন্ধু শ্রেণিরা শত্রুর ভূমিকা নেবে। আজকাল বন্ধুদের উচিত কথা বলা তো নিষিদ্ধপ্রায়। কিচ্ছু বলতে পারবেন না। কিন্তু আগে আমরা বলতাম। এখন আর বলা যায় না। এখন আমাদের হজমশক্তি কমে গেছে! তাই হাত পাতার বিষয়টি কখন কার পেশা থেকে নেশায় পরিণত হয়েছে, তাও ঠাওর করতে পারি না।
আনোয়ারা আজাদ : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক