একটি দেশ কত উন্নত তা বোঝার জন্য পরিবেশবিদ্যা পড়তে হয় না; দেশটির রাজধানীর চিত্র দেখলে অনুধাবন করা যায়, দেশটি কত উন্নত কিংবা কত দূষণমুক্ত। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশুমার উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ উন্নয়ন কার স্বার্থে? নিশ্চয় জনগণের স্বার্থে। কিন্তু উন্নয়নের ছোঁয়ায় যখন জীবনের প্রদীপ নিভে যায় তখন তো আর দুঃখের সীমা থাকে না। যে উন্নয়ন জীবনের আশার প্রদীপকে নিভিয়ে দেয় তাকে কী করে ‘উন্নয়ন’ বলি?
মেগা প্রকল্প উন্নয়নের গল্প শুনলে মনে হবে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছি। কিন্তু পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালে দেখা যায়, বাতাসে ভাসছে বিষ। তখন কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারি না। মনে হয় পত্রিকার রিপোর্ট ভুল। কিন্তু সব পত্রিকায় রিপোর্ট তো আর ভুল ছাপতে পারে না। ভুল হলে প্রতিবাদ হতো। কিন্তু সেরকম কোনো খবর চোখে পড়েনি। স¤প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ারের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন মারফত জানতে পারলাম, বিশে^র ১১৭টি দেশের মধ্যে দূষণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। আইকিউআরের প্রতিবেদন আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে দিলেও সংশ্লিষ্ট মহলের ঘুম ভাঙতে পারেনি। ২০১৮ সাল থেকে বিশে^র সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। টানা তিনবার দূষণের শীর্ষস্থানে অবস্থান করলেও প্রতিকার মেলেনি। বারবার একই জায়গা কাটলে যেমন অনুভ‚তি থাকে না তেমনি দূষণের শীর্ষে বারবার তকমা লাগায় আমাদের বিবেকও জাগ্রত হয় না।
আমরা বিশেষজ্ঞ নই! তবে মানুষের নাক, কান, মুখ ও চোখ দেখেই বোঝা যায়Ñ রাজধানীর ঢাকার বায়ুমান কেমন? উন্নয়নের নামে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। ধূসর হয়ে উঠছে রাজধানীর পরিবেশ। হাওয়ায় ভাসছে বাতাসে বিষ। সেই বিষ অবাধে আমাদের শরীরে ঢুকছে। ফলে নগরবাসীর গড় আয়ু কমছে। বাড়ছে মরণব্যাধি ক্যান্সার, কিডনি, হাঁপানি, হৃদরোগ নিউমোনিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, অকাল গর্ভপাতের পরিমাণ, অপুষ্টিজনিত শিশুর জন্ম, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, শিশুর মানসিক বিকাশের দুর্বলতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা ও বন্ধ্যত্বের সংখ্যা। এসব কিছু দূষিত বাতাসের কারসাজি। বাড়ছে ডাক্তারের সিরিয়ালের দীর্ঘ লাইন। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে এখন পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে হয়তো ৩০-৪০ বছর পর বিশাল উন্নয়ন হবে। কিন্তু এ উন্নয়ন উপভোগ করার মতো সুস্থ জাতি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। অথচ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
স¤প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ক্যাপসের গবেষণায় শিউরে ওঠার মতো খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটিতে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার নাগরিকরা গত ছয় বছরের মধ্যে মাত্র ৩৮ দিন ভালো বায়ু গ্রহণ করেছেন, যা গত ৬ বছরের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ। বায়ুদূষণ শুধু ঢাকায়; তা কিন্তু নয়! দেশের ৫৪টি জেলা বায়ুদূষণের শিকার! নির্মল বায়ুর চেয়ে দূষিত বায়ুর পরিমাণ দ্বিগুণ। বায়ু দূষণের কারণগুলো হচ্ছেÑ অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাস্থ্যকর ইটভাটা, যানবাহনের নির্গত কালো ধোঁয়া, রাস্তার যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, শিল্পকারখানার নির্গত ধোঁয়া এবং বর্জ্য। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) ভাষ্যমতে, বিশ^ব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণে মারা যায়। বায়ুদূষণ বিশে^ মানুষের গড় আয়ু এক বছর আট মাস কমিয়েছে। সে হিসেব অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় তিন (২.৯৬) বছর মানুষের গড় আয়ু কমছে। এমনকি চীন, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বায়ুদূষণের কারণে বেশি কমছে। ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হাইকোর্ট এ ব্যাপারে কয়েকবার দায়িত্বশীল কৃর্তপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং রুল জারি করেছেন। কিন্তু তবু বায়ুদূষণ থামছে না।
প্রতিনিয়ত অসহনীয় যানজট, শব্দদূষণ,বায়ুদূষণ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি নগরবাসীর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। বিষাক্ত বাতাস আমাদের মানব দেহকে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ প্রতিকার মিলছে না। বিষাক্ত বাতাস ও শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বীকার করেছেন। বিশ^ স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, শব্দদূষণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়ায় জটিল রোগ হচ্ছে। যত্রতত্র বিল্ডিং নির্মাণের কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিলোত্তমা ঢাকা গড়ে উঠেনি। উল্টো তীব্র যানজট, একটুখানি বৃষ্টি হলে কোমর সমান পানি, গাড়ির হর্ন, ধুলা এমন হাজারো কষ্টের শহর এখন ঢাকা। তিলোত্তমা ঢাকা তো দূরের কথা, সবুজ ঢাকার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। অথচ দুই নগর পিতা সবুজ ঢাকা, ক্লিন ঢাকার স্বপ্ন দেখান। কিন্তু ঢাকার জলাভ‚মি কিংবা বনায়ন রক্ষা করতে পারেন না তারা। যত্রতত্র অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে,পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হচ্ছে না। একই রাস্তা কখনো ডেসা, কখনো তিতাস, কখনো ওয়াসা কাটছে। সকালে ওয়াসা বিকেলে ডেসা কাটছে। এ যেন টাকা কামানোর মেশিন।
বাতাসের প্রয়োজন আছে, জানি। কিন্তু দূষিত বাতাস কার প্রয়োজন? ঢাকার বাতাসে স্বস্তির নিঃশ^াসটুকু ফেলা কঠিন। নিঃশ্বাসের সাথে বিষাক্ত বাতাস বের হচ্ছে। অথচ আমরা বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি। কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ি। বৃক্ষরাজি অক্সিজেন নিঃসরণের মাধ্যমে বাতাসকে সজীব ও নির্মল রাখে। কিন্তু প্রকৃতির বাতাসে এখন শুধুই বিষের হাতছানি। দূষিত বায়ুর কারণে গাছপালার ফলন ও পশুপাখিদের আনাগোনা কমে গেছে। গাছে ফল এলেও অকালেই ঝরে পড়ছে। গাছপালার ওপর নির্ভরশীল, পশুপাখির জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাণীর যেমন খাদ্যের প্রয়োজন হয় তেমনি গাছপালারও খাদ্যের প্রয়োজন রয়েছে। দূষিত বায়ুর কারণে গাছগুলো প্রয়োজনমাফিক সালোকসংশ্লেষণ (সবুজ উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির রাসায়নিক বিক্রিয়া) গ্রহণ করে খাবার তৈরি করতে পারছে না। এটা গাছপালার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। এ ব্যাপারে কিছু নীতিমালা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির ময়লা টানার মেশিন ক্রয় করা যেতে পারে। সুইপার যখন রাস্তা পরিষ্কার করেন তখন ঝাড়–র ধুলা আবার বাতাসে উড়ে রাস্তায়, মানুষের গায়ে, গাছপালার উপর পড়ছে। এ জন্য পানি ছিটানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পরিবেশবোদ্ধাদের মতামত ও মাসিক সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে। বিশে^র অন্যান্য দেশ কিভাবে রাস্তাকে ধুলামুক্ত করেছে তার দৃষ্টান্ত কাজে লাগানো যেতে পারে। রাস্তায় যেসব মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল করে, সেগুলো যেকোনো মূল্যে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সরিয়ে ফেলতে হবে কালো ধোঁয়া নির্গত বাস, মিনিবাস ও লেগুনা। খোলা ট্রাকে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পরিবহন করা নিষিদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন নির্মাণ কাজের সামগ্রী রাস্তার পাশে খোলা অবস্থায় রাখা বন্ধ করা দরকার। মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া এবং বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। আদালতের এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হলে বিষাক্ত বাতাসের ছোবল থেকে আমরা বেঁচে যেতে পারি। আশা করি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল উদ্যোগী ভ‚মিকা পালন করবে।