দেশের রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক পরিস্থিতি অব্যাহত আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি কমেছে ৬ দশমিক ২১ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে তৈরী পোশাক শিল্প খাত। পোশাক রফতানির কম আয় আলোচ্য সময়ের সার্বিক রফতানি হ্রাসের হারের তুলনায় বেশি। এ সময় সার্বিক রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। মূলত পোশাক রফতানির অব্যাহত ধসের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক রফতানি কমে চলেছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশের রফতানি বাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী খাতটিতে বিরাজমান নানা সমস্যার কারণে বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। এমতাবস্থায় জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থে পোশাক শিল্পের উন্নয়নে রফতানি মুদ্রার মূল্যবৃদ্ধি, কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিশ্ববাজারে এক হাজার ৯৩০ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ২ হাজার ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য। অর্থাৎ গত অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রফতানি কমেছে ১১৯ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ডলার বা ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির যে ধারা শুরু হয়, প্রথমার্ধ শেষেও তা অব্যাহত আছে। এ জন্য তৈরী পোশাক শিল্প খাতের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পোশাক রফতানি হয় ১ হাজার ৬০২ কোটি ৪০ লাখ ১০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ৭০৮ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার ডলারের পোশাক। এ হিসাবে ছয় মাসে পোশাক রফতানি কমেছে ১০৬ কোটি ডলারের বেশি তথা ৬ দশমিক ২১ শতাংশ।
ইপিবি জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তৈরী পোশাকের পাশাপাশি ১১ শতাংশ রফতানি কমেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের। হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ খাতে রফতানি কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পাট ও পাটপণ্যের রফতানি বেড়েছে ২২ শতাংশ। মোট ৫১ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য রফতানি হয়েছে এ সময়। গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪২ কোটি ডলার। কাঁচাপাট রফতানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশেরও বেশি।
গত পাঁচ অর্থবছরের প্রথমার্ধের রফতানি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছরই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল রফতানি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮-তে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রফতানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। জুলাই-আগস্ট দুই মাসে শুরু হয় নেতিবাচক ধারা। ওই দুই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। তিন মাস শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থবছরের পাঁচ মাস শেষেও রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
পোশাক খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, রফতানিতে নেতিবাচক চিত্র উঠে আসার প্রধান কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার অতিমূল্যায়ন। তারা জানান, প্রতিযোগী দেশগুলো ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রা অবমূল্যায়ন করেছে। এর ফলে তাদের মূল্য সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে না এসে প্রতিযোগী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। ক্রয়াদেশ ঘাটতিতে পণ্য রফতানি, বিশেষ করে তৈরী পোশাকের রফতানি কমছে। আগামী কয়েক মাসও ক্রয়াদেশ কম থাকবে আশঙ্কা প্রকাশ করে তারা বলেন, ক্রয়াদেশের ন্যায্য অংশ পাচ্ছে ভিয়েতনাম। এ ছাড়া পাকিস্তান এবং ভারতেও ক্রয়াদেশ সরে যাচ্ছে। সবগুলো দেশই এ খাতের রফতানিতে প্রণোদনা ও বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের দাবি, গত কয়েক বছরে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ৫১ শতাংশ। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল। বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স, পৌরকর এবং বন্দর খরচ। কিন্তু পণ্যের দাম সে তুলনায় বাড়েনি, উল্টো কমেছে। স্বাভাবিক কারণে কমেছে রফতানির পরিমাণও। অসম এবং অনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে রফতানিমূল্যও প্রতিনিয়ত কমছে। এসব কারণে রফতানি বাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী সম্ভাবনাময় তৈরী পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত ১৩০০ কারখানা। বাড়ছে শ্রমিক ছাঁটাই এবং অসন্তোষ। স্বল্প সংখ্যক বড় কারখানার কথা বাদ দিলে অধিকাংশ কারখানার জন্য কোনো সুসংবাদ নেই আগামী দিনের রফতানি আদেশেও।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছি। গত চার বছরে ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের মুদ্রা অবমূল্যায়ন করলেও আমাদের মুদ্রা এখনো শক্তিশালী। নীতিনির্ধারকরা বসে যদি কৌশল নির্ধারণ না করেন, তাহলে খাতটিকে গভীর সমস্যায় পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য শুধু নয় বরং দীর্ঘ মেয়াদে শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থেও কৌশল নির্ধারণ জরুরি মন্তব্য করে তিনি বলেন, এত বিপুল পরিমাণ ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট নিয়ে আমরা কম রফতানির ঝুঁকি নিতে পারি না। তাই আমাদের বিকল্প ও সৃজনশীল সমাধানে আসতে হবে।
অভিযোগ রয়েছে, পোশাক খাতের রফতানির এমন নেতিবাচক অবস্থার জন্য দায়ী সরকারের একটি সিদ্ধান্ত। চলতি অর্থবছরের বাজেটে পোশাকসহ সব খাতের উৎসে কর ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এতে করে হোঁচট খায় শিল্প। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার শেষ পর্যন্ত নিজ অবস্থান থেকে ফিরে আসে। এক শতাংশ থেকে কমিয়ে উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। গত ২১ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকেই তা কার্যকর করা হয়। যদিও তৈরী পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ চায়, সুবিধাটি যেন ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। তৈরী পোশাক খাতের চলমান দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) লেখা এক চিঠিতে বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক এ দাবি জানান। বিজিএমইএর ওই চিঠিতে রফতানি পোশাক খাতের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, দেশের প্রায় ৮৪ শতাংশ রফতানি আয় অর্জনকারী এই শিল্পটি বর্তমানে দেশ-বিদেশে নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বর্তমানে পোশাকশিল্প ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত দরপতন, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। তাই এই খাতকে সহায়তা দেয়ার অংশ হিসেবে উৎসে কর কমানো হয়েছে।
বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রফতানি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোট রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য। এই আয় তার আগের অর্থবছরে রফতানি হওয়া ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ডলারের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। তা ছাড়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ রফতানি বেশি হয়েছে বিদায়ী অর্থবছরে। এ বছর মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। সব মিলিয়ে বছরটিতে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। আর বিদায়ী অর্থবছরের পোশাক রফতানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। আবার পোশাক শিল্পের মধ্যে ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৭২৪ কোটি ডলারের। প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্য দিকে নিট পোশাক রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৬৮৮ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ।