আমি অতীতকালের শিরিন সম্পর্কে কথা বলতে প্রস্তুত নই। এটা আজকে না, হয়তো কখনোই না। শিরিন সাংবাদিক হয়ে কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি দখলদারিত্বের নিষ্ঠুরতার দিকটি বিশ্বের কাছে তুলে ধরছিলেন। এবার তাকেই ইসরাইলের রক্তাক্ত উন্মাদনার শিকার হতে হলো। ইসরাইলি বর্বরতা উন্মোচনের জন্য তিনি আজীবন পাগলের মতো কাজ করে গেছেন।
মিসেস আবু আকলেহ আরব বিশ্বের একটি পারিবারিক নাম। রাবাত থেকে রিয়াদ পর্যন্ত অগণিত বাড়িতে তার নাম উচ্চারিত হতো। একজন পাকা সাংবাদিক, তিনি ফিলিস্তিনের সেই সাহসী কণ্ঠস্বর যা বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত। যেখানে মৌসুমি সাংবাদিক আসে আর যায় সেখানে দিনের পর দিন বছরের পর বছর তার জন্মভ‚মির দখলদারদের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তিনি কণ্ঠস্বরহীন ফিলিস্তিনিদের আওয়াজ দিয়েছেন।
শিরিনের সেই স্থিরকণ্ঠস্বর ছিল একটি প্রশান্ত বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠ। সর্বদা শান্ত শীতল এবং এমনকি যখন তিনি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এবং রক্তাক্ত দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন তখনো তিনি ছিলেন ধীর স্থির যা প্রায়ই কল্পনা করা যায় না।
তিনি ফিলিস্তিনের রাস্তায় যেভাবে হেঁটেছেন এবং সেখানকার উদ্বাস্তু শিবিরের গলির মধ্য দিয়ে গেছেন তাতে মনে হয়েছে তিনি নিরহঙ্কার, বিনয়ী এবং তার মধ্যে যেন জাদুকরী শক্তি আছে। তিনি বিশ্বের সাথে বাগ্মিতা, স্পষ্টতা এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতেন। সব সময় তিনি বাস্তবভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ কথা বলতেন এবং হ্যাঁ, সবসময় তিনি পরিমাপ করে কথা বলতেন। কখনো তিনি উত্তেজিত হতেন না।
একজন যুদ্ধ সাংবাদিক, তবুও তার মধ্যে একটি পরোপকারী মনোভাব ছিল। অমানবিক পরিবেশের মাঝে অবিশ্বাস্যভাবে মানবিক। তিনি একজন উৎসাহী ও আবেগপ্রবণ প্রতিবেদক। যেখানে তার আবেগ তার নির্যাতিত নিপীড়িত স্বদেশের জন্য, ভালোবাসা এবং বেদনার একটি ঈর্ষণীয় মিলনের প্রতিফলন ঘটিয়েছিল।
এটা যথাযথ যে, শিরিনের জন্ম ফিলিস্তিনে কেন্দ্রস্থল জেরুসালেমে, ১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধ এবং ইসরাইলি দখলদারিত্বের ঠিক পরে। বেথেলহেমের খ্রিষ্টান পরিবার থেকে আসা, তিনি সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথমে ইউএনআরডবিøউএতে এবং পরে এমআইএফটিএএইচে কাজ করেছেন। ফুলটাইম সাংবাদিক বা পুরোপুরি সাংবাদিক হয়ে ওঠার আগে তিনি সংলাপ ও গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রচার নিয়ে কাজ করেন।
১৯৯৭ সালে শিরিন একজন নিবেদিত ও ত্যাগী প্রতিবেদক হয়ে ওঠেন। একজন ‘জাজিরিয়ান’, যিনি এক শতাব্দীর এক-চতুর্থাংশে অন্ধকার যুগকে আলোকিত করেছেন। তিনি তার সময়ের সাথে সবসময় উদার ছিলেন, কখনো পিছপা হননি। মিডিয়াদৃশ্যের একটি ফিক্সচার, পেশার দৈত্য বা অতিশয় ক্ষমতাবানদের মধ্যে তিনি আল-জাজিরাকে একটি স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছিলেন। আরব বিশ্বের হৃদয় বা কেন্দ্রস্থল থেকে আল-জাজিরাকে কভারেজ দেয়ার জন্য সহায়তা করেছিলেন। তিনি একজন যুদ্ধ প্রতিবেদক ছিলেন, তবে হ্যাঁ, কয়েক দশক ধরে শিরিন একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবেও বিভিন্ন অপরাধ দৃশ্য ধারণ, সংগ্রহ, প্রমাণ, ক্লু সংগ্রহ এবং অপরাধীদের প্রকাশ বা চিহ্নিত করে দেয়ার মতো ঘটনা, ইত্যাদি কাভার করেছেন।
পুরনো নিউজ রিল দেখা অবাস্তব, যাতে দেখা যাচ্ছে, তরুণ শিরিন শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলছেন এবং কিভাবে তিনি দখলদারিত্বের অধীনে এই বয়সে এসেছেন তার প্রতিফলন দেখানো হচ্ছেÑ আমি বলব, অবশ্যই আমার বলা উচিত একটি পেশার ওপরে একটি অমানবিক পেশা সেটা ইতোমধ্যে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এবং দৃশ্যত এর কোনো শেষ নেই।
আসুন, আমরা শিরিনের স্মৃতিকে তার মৃত্যু দিয়ে ক্লিশে এবং ষড়যন্ত্র দিয়ে বিশৃঙ্খল না করি। শিরিন ক্লিশে করেননি। কে বা কোন সৈনিক শিরিনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল সেটা বড় কথা নয়Ñ প্রকৃত ব্যাপার হলো, শিরিন ইসরাইলি দখলদারিত্বের নির্মম শিকার। যেন সকালে তাকে হত্যা করাই যথেষ্ট ছিল না, ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীকে বিকেলে তার বাড়িতে অভিযান চালাতে হয়েছে। কেন? কারণ তারাই তারা। আমাদের অবশিষ্টজনদের জন্য, তার অনুরাগী, বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারের জন্য আসুন, আমরা তাকে সম্মান করি; যেভাবে তিনি আমাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে, আন্তরিকভাবে এবং ভালোবাসার সাথে সম্মান করেছেন। আরবি ভাষায় শিরিন অর্থ ‘তাজা সৌন্দর্য।’ তিনি আজ তাই হয়েছেন। আজ আমরা শিরিনের জন্য শোক পালন করি। আগামীকাল আমরা তার খুনিদের ধরিয়ে দেবো।
লেখক : আল-জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আল-জাজিরার সৌজন্যে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার