সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় এলেন। ওই সফরে ব্রিগেডের ময়দানে তার ভাষণ লোকগাঁথার অংশ হয়ে আছে, তবে ওই একই যাত্রায় তিনি আর একটি অবিস্মরণীয় পদক্ষেপও নিয়েছিলেন।
তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কলকাতা থেকে ঢাকায় নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
যে কবির কবিতা ও গান পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার জন্য বাঙালিকে প্রেরণা জুগিয়েছিল সেই কবিকে ঢাকায় আনা হচ্ছে এ খবরে ঢাকার মানুষ ছিল উৎসাহে উদ্বেল।
মে মাসের ২৪ তারিখে সপরিবারে কবিকে বহনকারী বিমানের বিশেষ ফ্লাইট যখন ঢাকা বিমানবন্দরে নামল তখন বাইরে হাজার হাজার মানুষ।
যদিও এক সপ্তাহের জন্য তিনি এসেছিলেন ঢাকায়, কিন্তু তিনি আমৃত্যু ঢাকাতেই থেকে গিয়েছিলেন।
ঢাকায় কবির জন্মদিন পালনের প্রস্তাব
বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় রাখা হয়েছিল কলকাতার রাজভবনে, যেটা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তখন এ এল ডায়াস, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে কথাটা তার কাছেই পাড়লেন।
নজরুল গবেষক ও প্রাবন্ধিক বাঁধন সেনগুপ্ত সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
‘শেখ মুজিব ডায়াসকে বললেন, দেখুন আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। এই শহরেই থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি যেমন আপনাদের কবি, তেমনি আমাদেরও কবি।’
‘আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। কবি নিজেও আগে বহুবার ঢাকায় এসেছেন। তো এবারে আমরা চাই কবিকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ধুমধাম করে তার জন্মদিন পালন করতে।’
‘এ এল ডায়াস সব শুনে বললেন, অতি উত্তম প্রস্তাব। এমন তো হতেই পারে। আমরা না হয় পালা করে কবির জন্মদিন পালন করলাম, একবার ঢাকায় আর পরেরবার কলকাতায়!’
‘তবে দিল্লিই পারবে এই অনুমতি দিতে, ফলে আপনি বরং সরাসরি মিসেস গান্ধীর সাথেই কথা বলুন। পরদিনই মুজিবও ঠিক সেটাই করলেন, বলছিলেন বাঁধন সেনগুপ্ত।
শুধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা বলাই নয়, এরই মধ্যে রাজভবনে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের সাথেও দেখা করলেন শেখ মুজিব।
কবির দুই ছেলে, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধকেও তিনি জানিয়ে রাখলেন বাংলাদেশ সসম্মানে নজরুলকে নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দিতে চায়।
কবিকে নিয়ে কূটনীতি
এরপরই শুরু হল এক নজিরবিহীন কূটনৈতিক তৎপরতা। তিন দশক ধরে বোধশক্তিহীন, নির্বাক এক কবিকে ভিনদেশে পাঠানো নিয়ে চিঠি-চালাচালি, শলাপরামর্শ আর ভাবনা চিন্তা।
ফেব্রুয়ারি থেকে মে-এই কয়েক মাসে নজরুলকে বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আবদুস সামাদ আজাদ ও শরণ সিংয়ের মধ্যেও বেশ কয়েকদফা পত্রবিনিময় হয়েছিল।
তবে দিল্লি সেগুলো আজও ‘ডিক্লাসিফাই’ করেনি।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার মতামত চাইলেন পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ও তার অত্যন্ত আস্থাভাজন কংগ্রেসি নেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের।
কবি নিজে সিদ্ধান্ত নেয়ার অবস্থাতেই নেই, ফলে দূত পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বললেন কবির পরিবারের সদস্যদের সাথেও।
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রির কথায়, ‘শেষ পর্যন্ত মৈত্রী আর বন্ধুত্বেরই জয় হল। দুটো দেশের মধ্যে যে পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, সেটার ভিত্তিতেই শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ ভারত মেনে নিল।’
‘তবে এটাও ঠিক, দিল্লি ভেবেছিল কবির এই যাত্রাটা হবে সাময়িক – তিনি আবার কিছুদিন পরে ফিরে আসবেন।’
‘কাজী নজরুল ইসলাম বা তার পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হবে বা তাকে একদিন সেখানে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হবে-এগুলো কিন্তু তখন জানা ছিল না, আর ভাবাও হয়নি।’
তবে আজও নজরুলকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রীর সেরা নিদর্শন বলেই মনে করেন মিস সিক্রি, কারণ ‘নবীন একটি দেশে তার বন্ধু প্রতিবেশী একজন কবিকে পাঠাচ্ছে-এমন দ্বিতীয় কোনও নজির বিশ্বে আছে বলে আমার জানা নেই!’
ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্টারিয়ান ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায় আবার মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্তটাই ছিল এখানে আসল ব্যাপার।
সেই আমলের দাপুটে এই কংগ্রেস নেতা বলছিলেন, ‘ইন্দিরার সম্মতিটাই ছিল মূল কথা। উনি চেয়েছিলেন বলেই নজরুলকে ঢাকায় পাঠানো গিয়েছিল-এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। বাকি ফ্যাক্টরগুলো গৌণ।’
পরিবারের মধ্যে মতভেদ?
নজরুলকে ঢাকায় পাঠানো ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে কবির পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই মতবিরোধ ছিল বলে অনেক নজরুল গবেষকই জানিয়েছেন।
বর্ষীয়ান নজরুল বিশারদ ড. বাঁধন সেনগুপ্ত যেমন সরাসরি বলছেন, ‘কবির ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ চাননি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হোক। কিন্তু বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর আবার এ ব্যাপারে তুমুল উৎসাহ ছিল।’
স্ত্রী প্রমীলার মৃত্যুর পর (১৯৬২) কবি তখন থাকতেন কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকার ক্রিস্টোফার রোডে কাজী সব্যসাচীর পরিবারের সাথেই।
কাজী অনিরুদ্ধর কন্যা ও নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজীও কিন্তু অস্বীকার করছেন না যে তার বাবা ও জেঠু এই বিষয়টা নিয়ে ঠিক একমত হতে পারেননি।
অনিন্দিতা কাজী এখন থাকেন আমেরিকার নিউ জার্সিতে।
সেখান থেকেই তিনি বলছিলেন, ‘আসলে কী, আমার বাবা (কাজী অনিরুদ্ধ) ছিলেন একটু শান্ত, মিতবাক ও টিমিড প্রকৃতির মানুষ। উল্টোদিকে জেঠু (কাজী সব্যসাচী) ছিলেন দাপুটে মানুষ-আর বড় ভাই হিসেবে পরিবারে তার মতামতটাই প্রাধান্য পেত।’
‘অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা জাগতে পারে, মাত্র দিন সাতেকের জন্য ঢাকায় গিয়ে দাদু (কাজী নজরুল) কেন পাকাপাকিভাবে সেখানে থেকে গেলেন?’
‘আসলে কী হয়েছিল, দিনকয়েক পর শেখ মুজিব যখন জেঠুর কাছে জানতে চাইলেন তারা কী করবেন, তখন জেঠু বললেন কবি তো ঢাকায় বেশ ভালই আছেন, চিকিৎসাতেও বেশ সাড়া দিচ্ছেন মনে হচ্ছে – তো উনি থাকুন না কেন?’
‘আসলে ঢাকায় চিকিৎসার যে সুযোগ-সুবিধাগুলো পাওয়া যাচ্ছিল, কলকাতায় সেটা পাওয়া যাবে না বলেই জেঠুর মনে হয়েছিল’, বলছিলেন অনিন্দিতা কাজী।
উন্নত চিকিৎসাই আকর্ষণ?
নজরুল ইসলামের পরিবারের যে শাখাটি তার জন্মস্থান চুরুলিয়া বা তার আশপাশে এখনো বসবাস করেন, তারই একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সঙ্গীতশিল্পী সোনালি কাজী।
সোনালি কাজী মনে করেন, কবিকে ঢাকায় পাঠাতে তার পরিবার রাজি হয়েছিল প্রধানত উন্নত চিকিৎসার আকর্ষণে।
তিনি বলছিলেন, ‘একটা জিনিস ভাবুন, ৩০ বছর ধরে একটা মানুষ নির্বাক, তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। কলকাতার ডাক্তাররাও এক রকম জবাব দিয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থায় একটি নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন তারা যথাযোগ্য মর্যাদায় কবিকে নিয়ে যাবেন এবং ভালো করে চিকিৎসা করাবেন। তখন কবির পরিবার যদি তার কথায় আস্থা রাখে, তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়?’
তবে ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রদূত চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত আবার এই ব্যাখ্যার সাথে একমত নন।
সে সময় ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত দাশগুপ্ত বলছিলেন, ‘দেখুন সেই সত্তরের দশকে ভালো চিকিৎসার জন্য লোকে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসত। ফলে কলকাতার চেয়ে উন্নততর চিকিৎসা পাওয়া যাবে বলে কবিকে ঢাকায় পাঠাতে পরিবার রাজি হয়ে গেল, এটা ঠিক আমার কাছে বিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না’, বলছিলেন তিনি।
বাঁধন সেনগুপ্ত আবার মনে করেন, আর্থিক কারণটাও এখানে বড় ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে।
‘তিরিশ বছর ধরে নজরুলের তখন কোনও রোজগার নেই। ভারত সরকারের ৪০০ রুপি আর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ২৫০ রুপি মাসোহারাই ভরসা। এর ওপর অনেক বছর ধরে কবির আর তার স্ত্রীর চিকিৎসা, ওষুধপত্রের খরচ!
‘ফলে রাষ্ট্রীয় সম্মানে যখন কবিকে বন্ধু দেশ সব খরচ দিয়ে নিয়ে যেতে চায়, পরিবারের তাতে রাজি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক’, বলছিলেন বাঁধন সেনগুপ্ত।
কলকাতা ছিল নিরুত্তাপ
ঠিক ৫০ বছর আগে ক্রিস্টোফার রোডের ফ্ল্যাট থেকে ট্যাক্সিতে রওনা দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম যখন ঢাকার বিমানে চাপলেন, কলকাতায় সেদিন কিন্তু সত্যিই কোনো তাপ-উত্তাপ ছিল না।
‘আসলে ততদিনে শহরে নজরুল ক্রমশ বিস্মৃত হতে শুরু করেছেন। তার সৃষ্টি থেমে গেছে বহু বছর আগেই, তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকজনও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন’, বলছিলেন এই প্রজন্মের তরুণ নজরুল গবেষক ও গ্রন্থকার অর্ক দেব।
তিনি বলেন, ‘এমনকী, বাংলায় যে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সংহত করার ক্ষেত্রে নজরুলের বিরাট অবদান ছিল, সেই পার্টিও কিন্তু কবিকে কোনও স্বীকৃতি দিচ্ছে না। নজরুল আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদ ছিলেন কার্যত পার্টির জগাই-মাধাই। নজরুল স্তব্ধ হয়ে গেলেন-আর মুজফফর আহমেদ প্রয়াত হওয়ার পর কমিউনিস্টরাতো নজরুলকে পুরোপুরি ভুলেই গেল।
শহর কলকাতাতেও তখন চলছে একটা অস্থির পর্ব। খাদ্য আন্দোলন সবে থেমেছে, নকশালবাড়ির স্ফুলিঙ্গ মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে।
‘সময়টা কলকাতারও মধুমাস ছিল না – ফলে নজরুল থাকলেন না গেলেন তা নিয়ে শহরটার ভাববারও কোনও অবকাশ হয়নি’, অর্ক দেব বলেন।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ সৌগত রায়েরও স্বীকার করেন, ‘কলকাতায় কিন্তু তখন নজরুলকে নিয়ে উন্মাদনা অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। সেন্টিমেন্ট, আবেগগুলো থিতিয়ে এসেছে। ফলে তিনি যখন ঢাকায় গেলেন বা সেখানেই থেকে গেলেন, কলকাতায় কোনো হই-চই হয়েছিল বলে আমার আদৌ মনে পড়ে না!’
ঢাকায় বিপুল উৎসাহ
শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগ আর কূটনৈতিক তৎপরতার পর অবশেষে বাহাত্তর সালের চব্বিশে মে একটি বিশেষ ফ্লাইটে চড়ে কলকাতা থেকে সপরিবারে ঢাকায় এসে পৌঁছেন কবি।
তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে সেদিন হাজার হাজার উৎসুক জনতার ভিড়।
অনেকের মতো সেদিন বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন নজরুল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক রফিকুল ইসলাম।
তিনি ২০১১ সালে বলেছেন জনতার ভিড়ে কবিকে কীভাবে অতিকষ্টে বিমান থেকে নামাতে হয়েছিল। বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্পূর্ণ জনতায় ভরা আমার মনে আছে ২৪ মে সকাল বেলা। বিমান থেকে নামলেন, পরিবার ছিল , সব্যসাচী, তার স্ত্রী খিলখিল কাজী, মিষ্টি কাজী এরা সবাই ছিলেন। কিন্তু জনতার ভিড় এমন যে কবিকে বিমান থেকে নামানো যাচ্ছিল না’।
হাজারো মানুষের ভিড় ঠেলে কবিকে নেয়া হয় ধানমন্ডিতে তার জন্য নির্ধারিত বাড়িতে।
সরকারের বরাদ্দ করা সেই বাড়িটি এখন নজরুল ইন্সটিটিউট।
‘বহু কষ্টে কবি এবং কবির পরিবারকে বিমান থেকে নামিয়ে সোজা রাস্তা দিয়ে না, রানওয়ের অপরদিক দিয়ে ঘুরিয়ে এই বাড়িতে আনা হয়। এবং এই বাড়িতে তখন তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয়। এখানে প্রতিদিন সকালে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হত আবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় পতাকা অবনমিত করা হত’, বলেছিলেন রফিকুল ইসলাম।
বিদ্রোহী কবিকে এক নজর দেখার জন্য বহু মানুষ ভিড় করেছিলেন ধানমন্ডির সেই বাড়িতেও।
প্রয়াত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী খালিদ হোসেন ২০১১ সালের বলেন, কবি-ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মনে হচ্ছিল ‘স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিয়েছে। সেটি একটা রত্ন হাতে পাওয়ার মতো। প্রত্যেকে অত্যন্ত উৎসাহী ছিল তাকে পাওয়ার জন্য যেন এটা একটা আশাতীত প্রাপ্তি তার আসাটা’।
দেশান্তরী, তবু ব্যতিক্রমী
পৃথিবীর বহু বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিককে নানা কারণে স্বভূমি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তারা কেউ একদিন নিজের দেশে ফিরতে পেরেছেন, কেউ কখনোই পারেননি।
রাশিয়ার আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন, জোসেফ ব্রডস্কি বা বরিস পাস্তেরনাক, চেকোশ্লোভাকিয়ার মিলান কুন্দেরা বা চীনের বেই দাও – হাতের কাছেই এমন উদাহরণ অজস্র।
পশ্চিমবঙ্গের সুপরিচিত কবি ও নজরুল একাডেমির সভাপতি জয় গোস্বামী মনে করেন, বাহাত্তর সালে কাজী নজরুল ইসলামও এক অর্থে দেশান্তরী হয়েছিলেন-তবে অন্যদের সাথে তার দেশান্তরী হওয়ার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে।
জয় গোস্বামী বলছিলেন, ‘অন্যরা কেন দেশ ছেড়েছিলেন? কারণ তারা ভয় পাচ্ছিলেন রাষ্ট্র তাদের লিখতে দেবে না, পুরস্কার নিতে দেবে না, এমন কী প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে। জীবনের একটা পর্যায়ে নজরুলও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বহু লিখেছেন, তার রচনা নিষিদ্ধ হয়েছে-কিন্তু বাহাত্তরে যখন তিনি ঢাকা যাচ্ছেন তখন তার ক্ষেত্রে একথাটা সত্যি ছিল না। আর দ্বিতীয় বিষয়টা হল, অন্য কবিরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বা পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। নজরুলকে কিন্তু অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়ক প্রভূত সম্মান দিয়ে, বিরাট মর্যাদা দিয়ে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাচ্ছেন! তখন তার মেমোরি অব ওয়ার্ডস নেই, শব্দরা তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে, একটা লাইনও তিনি লিখতে পারেন না। তারপরও তাকে আপ্যায়নে, সম্মানে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তারা … আর এখানেই নজরুলের অনন্যতা।
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে যে নজরুল চর্চা পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও অনেক বড় ক্যানভাসে ও অনেক ভালোভাবে হয়েছে, সে কথাও নির্দ্বিধায় মানেন তিনি।
আর তার পেছনে অবশ্যই একটা বড় কারণ হিসেবে থেকে গেছে বাহাত্তরের ২৪ মে কবির ঢাকা যাত্রা, যেখান থেকে কোনো দিনই তার আর কলকাতায় ফেরা হয়নি।
সূত্র : বিবিসি