তাজমহলের নিচে মন্দির অনুসন্ধানকারীদের এলাহাবাদ হাইকোর্ট আইন দেখিয়ে এটা প্রমাণ করেই দিয়েছেন যে, এ দেশে অন্ধের জন্য সব কিছুই সবুজ নয়। বরং এ দেশে আজো এমন লোক আছেন, যারা সাদা-কালোর পার্থক্য করতে জানেন। কিন্তু এ মুহূর্তে বেনারসের একটি আদালত ঐতিহাসিক জ্ঞানবাপী মসজিদের ভিডিওগ্রাফি তদন্ত করার নির্দেশের চাপ প্রয়োগ করে অস্থিরতার কিছু ঢেউ অবশ্যই সৃষ্টি করেছেন। তবে এ কর্মকাণ্ডে উত্তেজনা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছে না।
আদালত মুসলমান পক্ষের আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে ভিডিওগ্রাফি অব্যাহত রাখার নির্দেশ শুনিয়ে দিয়েছেন, যার দ্বারা ফ্যাসিবাদী মহলে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। তারা এই ঐতিহাসিক মসজিদের পরিণামও সেটাই ভাবছে, যা বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে হয়েছে। জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীও তারাই, যারা নব্বইয়ের দশকে রামজন্মভ‚মি মুক্তি আন্দোলন শুরু করে দেশে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে। এসব কিছু এমন এক সময় হচ্ছে, যখন ভারতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, অরাজকতা ও দরপতন চ‚ড়ান্তরূপ ধারণ করেছে এবং মানুষ সরকারের কাছে তাদের মৌলিক তির্যক প্রশ্ন করছে। বাহ্যত সরকারের কাছে এই সব তির্যক প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তারা জনগণের চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য ধর্মের আফিম সেবন করাচ্ছে। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রতিদিন একটি করে পুঁতে ফেলা মড়া খাড়া করা হচ্ছে এবং দেশের পরিস্থিতি নোংরা করা হচ্ছে।
কিছু মানুষ এক বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তি পিএন ওকের একটি বই কোত্থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে এবং সেই মোতাবেক ঐতিহাসিক সত্যকে বদলানোর চেষ্টা করছে। পিএন ওক আজ এই ধরায় নেই, কিন্তু মনে হচ্ছে, তার আত্মা এই সব সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর অস্তিত্বে ভর করেছে, যারা এই সময় ভারতে পূর্ণ উগ্রতার সাথে তৎপর। যাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ভারত থেকে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে মিটিয়ে দেয়ার প্রতি ধাবিত হচ্ছে। এ কারণে মে মাসের শুরু থেকে মুসলিম শাসনামলে নির্মিত প্রতিটি স্থাপনার নিচে মন্দির অনুসন্ধানের অভিযান তুঙ্গে রয়েছে। নিজেদের এই চক্রান্তমূলক কর্মকাণ্ডকে সফল রূপ দিতে এই গোষ্ঠী আদালতগুলোর আশ্রয় নিচ্ছে। আর আদালতগুলোও জেনে হোক কিংবা না জেনে হোক, এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে গেছে। নতুবা এর কী কারণ রয়েছে যে, বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদের তোহাখানায় শৃঙ্গার গৌরি মন্দিরের অবশিষ্টাংশ অনুসন্ধানের জন্য ভিডিওগ্রাফি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আদালতের উচিত ছিল, এই আবেদনকে প্রথমেই খারিজ করে দেয়া।
এর সাথেই মথুরা শাহী ঈদগাহ সরিয়ে দিয়ে সেই ভ‚মি শ্রীকৃষ্ণ জন্মভ‚মি ট্রাস্টকে অর্পণ করার যে দাবি করা হয়েছে, সে বিষয়ে আদালতে শুনানি চলমান। এ মুহূর্তে রাজধানী দিল্লিতে কুতুবমিনারের বাইরে হনুমান চালিসা পাঠ করে সেখানে মন্দির নির্মাণের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনাইটেড হিন্দু ফ্রন্ট এবং রাষ্ট্রবাদী হিন্দুসেনার সদস্যদের বক্তব্য, কুতুবমিনার মূলত বিষ্ণুমন্দির। সুতরাং এর নাম বিষ্ণুস্তম্ভ রাখা উচিত। আটশত বছরের পুরনো কুতুবমিনারকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর এটাও বিশে^র আশ্চর্যসমূহের অন্যতম। কিন্তু এর ওপরও উগ্রবাদীদের কুনজর পড়েছে। এর আগে বিজেপির দাবি অনুযায়ী দিল্লির অন্যতম প্রাচীন গ্রাম মুহাম্মদপুর নাম পরিবর্তন করে মধুপুর করা হয়েছে।
দিল্লি প্রদেশ বিজেপির প্রধান আদেশ গুপ্ত মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের কাছে দিল্লির এমন চল্লিশটি গ্রামের নাম পরিবর্তনের সুপারিশমালা পাঠিয়েছেন, যা মুসলিম নামে ডাকা হয়। মোটকথা, মুসলিম শাসকদের নির্মাণ করা প্রতিটি স্থাপনাকে নিশ্চিহ্ন করা ও তাদের গড়ে তোলা জনপদগুলোর নাম মুছে ফেলাসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক মসজিদে একটি মন্দির অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা ওই সব লোকের কর্মকাণ্ড, যাদের কাছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে বিশ্বকে দেখানোর জন্য কিছুই নেই। বিশে^ ভারতের যেটুকু সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা রয়েছে, তা মুসলিম শাসনামলের গৌরবময় স্থাপনাগুলোর কারণেই রয়েছে। এই ভারতকে মূলত আমাদের পূর্বসূরিরাই গড়েছেন। আর এখানকার জাতিগুলোকে সভ্যতা ও সংস্কৃতি তারাই শিখিয়েছেন। মুসলমানদের আগমনের আগে এখানে সভ্যতা ও সামাজিকতা নামের কোনো কিছুই ছিল না। এ জন্য এ দেশের সাথে মুসলমানদের যে আবেগময় সম্পর্ক জড়িয়ে আছে, তা অন্য কারো হতেই পারে না।
জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহী ঈদগাহের বিরুদ্ধেও সে ধরনেরই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, যেমনটা বাবরি মসজিদের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল। যে সময় বাবরি মসজিদকে মন্দিরে বদলে দেয়ার আন্দোলন চলছিল, ওই সময়ই এ ¯েøাগান দেয়া হয়েছিলÑ ‘এ তো এক ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকী হ্যায়’ (এটা তো একটা ধাক্কামাত্র, কাশী মথুরা তো রয়েই গেছে।) কিন্তু কিছু মানুষের এ বিশ্বাস ছিল যে, বাবরি মসজিদের জমি রামমন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দেয়ার পর ভারতে মন্দির-মসজিদের রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এটা নিছক ওই মানুষগুলোর খামখেয়ালি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাবরি মসজিদের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী যে বিজয় অর্জন করেছে, তাতে তারা এতটাই অস্থির হয়ে গেছে যে, তারা প্রতিটি মসজিদের পরিণাম এটাই ভেবে নিয়েছে। নতুবা বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহী ঈদগাহের বিরুদ্ধে নতুন করে এবং আরো ভয়ঙ্কররূপে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার কী কারণ থাকতে পারে।
সংঘ পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট পাঁচজন নারী সিভিল জজ রবি কুমার দিবাকরের কাছে আরজি দাখিল করে আপিল করেছে, তাদের শৃঙ্গার গৌরি মন্দিরে প্রতিদিন পূজাপাটের অনুমতি দেয়া হোক। উল্লেখ্য, মন্দিরটি জ্ঞানবাপী মসজিদের আঙিনায় অবস্থিত। এর দেওয়াল মসজিদের দেওয়ালের লাগালাগি। সতর্কতাস্বরূপ এ মন্দিরে তালা লাগানো রয়েছে। এটাকে নবরাত্রির সময় খুলে দেয়া হয়। স্বয়ং স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য, এ মন্দির খুলে দিলে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। কিন্তু আদালত এ বিষয়টি উপেক্ষা করে জানি না কেন এই স্থানের ভিডিওগ্রাফির নির্দেশ জারি করেছেন। যার ফলে বিশেষ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাবরি মসজিদকে বিতর্কিত বানানোর জন্যও শুরুতে একই ধরনেরই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আজ আবারো দেশে এমনই পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, যাতে জনগণের দৃষ্টি আসল সমস্যাবলি থেকে সরে যায় এবং তারা বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অরাজকতা ও দরপতনের চ‚ড়ান্তরূপ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে।
অপর দিকে মথুরার শাহী ঈদগাহ নিয়েও উগ্রপন্থীদের কুদৃষ্টি রয়েছে। তারা ওই সমঝোতাকে বাতিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে, যে সমঝোতা বহু বছর আগে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণ জন্মস্থান সেবা সমিতি ও শাহী ঈদগাহ এন্তেজামিয়া কমিটির মাঝে সম্পাদিত হয়েছিল। ওই সমঝোতাকে সম্পূর্ণরূপে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উকিল রঞ্জনা অগ্নিহোত্রীসহ ছয়জন কৃষ্ণভক্ত আদালতে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সমঝোতা ও এ ব্যাপারে আদালতের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ডিগ্রি সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। কেননা উল্লিখিত কমিটির এমনটা করার কোনো আইনি অধিকার ছিল না। সুতরাং ওটা বাতিল করে শাহী ঈদগাহকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আর ওই সম্পূর্ণ জমিটি তার প্রকৃত মালিক শ্রীকৃষ্ণ জন্মভ‚মি ট্রাস্টকে দিয়ে দিতে হবে। এ দাবি এখন পর্যন্ত দুটি আদালত থেকে খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু গত বছর অক্টোবরে জেলা জজের আদালতে নতুন করে আরজি দায়ের করা হয়েছে। তার ওপর শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। আদালত ১৯ মে পর্যন্ত রায় মুলতবি ঘোষণা করেছিলেন।
লোকেরা বলে, ১৯৯১ সালে যখন এ আইন প্রণয়ন করা হলো যে, ১৯৪৭ সালে যে উপাসনালয় বা এবাদতের স্থান যে অবস্থায় ছিল, তাকে ওই অবস্থায়ই বহাল রেখে দিতে হবে। তাতে কোনো ধরনের সংস্কার, রদবদল ও বিলুপ্তির অধিকার থাকবে না। তাহলে এ ধরনের ইস্যু বারবার কেন উত্থাপন করা হচ্ছে? কিন্তু যারা সব কিছুর খোঁজখবর রাখেন, তারা এ কথাও জেনে থাকবেন যে, উগ্রপন্থীরা তাদের আন্দোলন শুরু করার আগেই এই আইনকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। সুপ্রিম কোর্টে এ সংক্রান্ত মামলার শুনানি চলছে। এ সব ষড়যন্ত্র মূলত ক্ষমতার মত্ততায় উন্মত্ত উগ্রপন্থীদের পক্ষ থেকে এ জন্য করা হচ্ছে যে, তারা মুসলমানদের হীন করে দেখাবে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে বাধ্য করবে। মুসলমানদের উচিত, জ্ঞানবাপীর ইস্যুতে তারা বাবরি মসজিদকেন্দ্রিক ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করবে না। নিজেদের আবেগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখবে। যাতে উগ্রপন্থী ও কুচক্রী মহলের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১৫ মে,
২০২২ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব