আমাদের শেয়ারবাজারে অস্থিরতা লেগেই আছে। আজ শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তো, কাল আবার নিম্নমুখী। আজকে সূচক বাড়লে, কালকেই কমে। এ যেন তৈলাক্ত বাঁশে বানরের ওঠানামা। দীর্ঘ দিন ধরেই এই অবস্থা চলছে। হাজারো বিনিয়োগকারী শেয়ার মার্কেটে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। এরা অতীতে রাজপথে অনেক আন্দোলন করেছেন। অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে নিজেদের কপাল নিজেরাই পিটিয়েছেন। অনেকে অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছেন। কখন কোন শেয়ারের দাম বাড়বে আর কখন কমবে তার কোনো হিসাব নেই। এখানে কোনো অঙ্ক নেই, কোনো সূত্র নেই। চলছে উত্থান-পতনের লুকেচুরি খেলা। একটা তুঘলকি কাণ্ডের ভেতর দিয়েই শেয়ারবাজার তার দিন অতিক্রম করছে। অথচ শেয়ারবাজার একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং অর্থনৈতিক চিত্রে প্রতিফলন ঘটায়। তাই শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা দরকার। এ জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা, নীতিমালা ও গাইডলাইন।
শেয়ারবাজার নিয়ে আলোচনার আগে এর উৎপত্তি ও গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া দরকার। ইউরোপে শিল্প বিল্পবের সূচনালগ্নেই শেয়ারবাজারের উৎপত্তি। ইউরোপের কৃষিজীবী মানুষেরা যখন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় তখন শেয়ার প্রসঙ্গটির সূচনা হয়। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠায় অনেক টাকার প্রয়োজন হয়, যা একজন ব্যক্তির পক্ষে জোগান দেয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় যৌথ মালিকানার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ অনেক ব্যক্তি মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় অনেক অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হয়। এক-একটি অংশীদারিত্ব মানেই এক-একটি শেয়ার। একাধিক ব্যক্তির যৌথ মালিকানা বা শেয়ারের সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং এই শেয়ার হোল্ডাররা সবাই প্রতিষ্ঠানের মালিক। যার শেয়ার যতটুকু, তিনি প্রতিষ্ঠানের ততটুকু অংশের মালিক। এই মালিকানা আবার ইচ্ছে করলে পরিবর্তন করা যায়। কেউ যদি তার শেয়ারটি বিক্রি করে দেন তাহলে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হারান এবং যিনি ওই শেয়ারটি কিনে নেন, তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা অর্জন করেন। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচা হয়। এই পদ্ধতির আধুনিক সংস্করণ বর্তমান শেয়ারব্যবস্থা।
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা, স্থায়িত্ব ও বিকাশের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা একাধিক শেয়ারে বিভক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। কারণ একজন ব্যক্তির পক্ষে একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান সবসময় সম্ভব হয় না। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক যখন একজন হয়, তখন তার ইচ্ছাতেই ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর ভালো সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয়। ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার যোগ্য উত্তরসূরি ওই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরতে না পারলে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে যায়। অন্য দিকে যৌথ শেয়ার বা মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে মালিকদের সমন্বয়ে একটি পরিচালনা বোর্ড থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়। এক বা একাধিক মালিক-শেয়ারহোল্ডারের মৃত্যুর কারণে প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষতি হয় না। এ কারণেই শেয়ারবাজারের এত গ্রহণযোগ্যতা। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অবাধ ব্যক্তি মালিকানার কারণে সেখানে শেয়ারবাজার ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। যেখানে এই শেয়ারবাজারের কার্যক্রম চলে সেটাকে আমরা স্টক এক্সচেঞ্জ বলি। একটি প্রতিষ্ঠান তার প্রয়োজনীয় পুঁজি সংগ্রহের জন্য বাজারে শেয়ার বিক্রি করে। শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে জনগণ ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা অর্জন করে এবং প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার বিক্রি করে তার প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করে। প্রতিষ্ঠানটি বছরের ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব শেষে অর্জিত লাভের একটি অংশ শেয়ার হোল্ডারদের কাছে বণ্টন করে। এভাবে শেয়ার হোল্ডাররা ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগকৃত অর্থের জন্য মুনাফা অর্জন করে। আবার একজন ব্যক্তি তার শেয়ার অপরের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেও মুনাফা অর্জন করে, যা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যে কোম্পানির ব্যবসা ভালো, বণ্টিত মুনাফার পরিমাণ বেশি, সেই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বেশি এবং এর চাহিদাও বেশি।
এবার আমাদের শেয়ারবাজারের চিত্রটা দেখে নিই। দেশে বর্তমানে দু’টি শেয়ারবাজার রয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। শেয়ারবাজারকে কেন্দ্র করে অনেক ব্রোকারেজ হাউজ গড়ে উঠেছে, যাদের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা হয়। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় এই দেশের শেয়ারবাজারের চিত্র অনেকটা ভিন্ন। এখানে অনেকে তাড়াতাড়ি ধনী হওয়ার জন্য শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করে। অনেক সরকারি চাকরিজীবী তাদের অবসর বেনিফিটের পুরো টাকাই শেয়ারবাজারে ইনভেস্ট করেন। আবার অনেক ছাত্র পড়ালেখার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে জড়িত হয়। সবারই উদ্দেশ্য কিন্তু তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়া এবং সর্টকাটে টাকা কামানো। অনেকেই কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার সময় সেই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক চিত্র এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নেয় না। অনেক দিন ধরেই মুনাফা দিচ্ছে না এবং উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, এমন কোম্পানির শেয়ারও তারা কিনছেন। আবার এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধিও পায়। এই যে তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার প্রবণতা এটা কিন্তু আমাদের শেয়ারবাজারের উত্থান পতন, অস্থিতিশীলতা এবং ধ্বংসের জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। সুতরাং শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করতে হলে, বিনিয়োগকারীদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মনে করি ‘এ’ একটি কোম্পানি, যাহার একটি শেয়ারের আসল মূল্য ১০০ টাকা। প্রথম ব্যক্তি ১০০ টাকা মূল্য দিয়ে কোম্পানিটির একটি শেয়ার কিনল। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিটি ১০০ টাকা মূলধন সংগ্রহ করল। প্রথম ব্যক্তি ১১০ টাকা মূল্যে শেয়ারটি দ্বিতীয় এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করল এবং এতে প্রথম ব্যক্তি ১০ টাকা মুনাফা অর্জন করল। দ্বিতীয় ব্যক্তি ১২০ টাকা দিয়ে শেয়ারটি তৃতীয় এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করল এবং এতে সেও ১০ টাকা মুনাফা অর্জন করল। এভাবে ক্রমাগত দাম বাড়ল এবং প্রত্যেকেই মুনাফা অর্জন করল। মনে করি শেষ ব্যক্তি শেয়ারটি ২০০ টাকা দামে ক্রয় করল এবং এ অবস্থায় শেয়ারটির দাম না বেড়ে কমা শুরু করল। ফলে শেষের ব্যক্তি সরাসরি ক্ষতির মুখোমুখি হলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শেয়ারটির দাম দ্বিগুণ হলো কেন? কারণটা হচ্ছে কারসাজি আর কিছু লোক না বুঝে হুজুগে লাভের আশায় শেয়ারটি কিনেছেন। তা ছাড়া একটি পক্ষ নিজেরাই এই শেয়ারটির দাম বাড়িয়েছে এবং নিজেদের লোকেরাই তা কিনেছে। এভাবে দাম বাড়িয়ে বাজারে শেয়ারটির কৃত্রিম চাহিদা এবং ইমেজ সৃষ্টি করেছে। আর তা শেষোক্ত ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে নিজেরা সটকে পড়েছে। এখানে শেয়ারের কাগজটা হাতবদল হয়েছে। এতে কোম্পানির কোনো মূলধনও বাড়েনি এবং দেশের অর্থনীতিরও কোনো উপকার হয়নি। শেয়ারটির দাম দ্বিগুণ হলেও, কোম্পানির মূলধন কিন্তু ১০০ টাকাই রয়ে গেছে। মাঝখানে কিছু লোক শেয়ারটা হাতবদল করে কিছু পয়সা কামিয়েছে আর শেষোক্ত ব্যক্তি লোকসান দিয়েছে। মূল্য বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে শেষের ব্যক্তিটি শেয়ারটা আর বিক্রি করতে পারছে না এবং সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বর্তমানে শেয়ারবাজারে যারা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন তারা সবাই কিন্তু শেষোক্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
এ দিকে কোম্পানিগুলো যখন বাজারে শেয়ার ছাড়ে, তখন অনেক কোম্পানির পরিচালকদের কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। মনে করুন, একটি কোম্পানির ১০ কোটি টাকা মূলধন প্রয়োজন। পরিচালকরা যদি কোম্পানির জন্য ওই টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে ব্যাংকের কাছে কিছু জমি জামানত হিসাবে বন্ধক দিতে হবে। এই ঋণ ঠিকমতো পরিশোধ না করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোম্পানির পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা করবে এবং বন্ধকি জমি বিক্রি করে ঋণ আদায় করবে। আর কোম্পানি ঠিকমতো ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করলেও তাকে বর্তমানে ৯% সুদ প্রদান করতে হবে। কিন্তু কোম্পানি যদি ওই ১০ কোটি টাকা শেয়ার মার্কেট থেকে সংগ্রহ করে তাহলে তাকে কোনো জমি জামানত দিতে হচ্ছে না। কোম্পানি যদি প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ১০০০ টাকা নির্ধারণ করে তাহলে এক লাখ শেয়ার হবে এবং কমপক্ষে কয়েক হাজার মানুষ এই শেয়ারগুলোর মালিক হবে। কোম্পানি যদি বছর শেষে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংগৃহীত টাকার বিপরীতে ৫% লভ্যাংশ ঘোষণা করে তাহলেও কোম্পানির ৪% টাকা অতিরিক্ত লাভ হলো। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ৯% সুদ দিতে হতো। অন্যদিকে কোম্পানি যদি মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং শেয়ার হোল্ডারদেরকে কোনো লভ্যাংশ না দেয় তাহলেও কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যাওয়ার বা মামলা করার সুযোগ কম। কারণ কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের সংখ্যা কয়েক হাজার, যারা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং যাদের কোনো ঐক্যবদ্ধ ফ্লাটফরম নেই। এমনকি কেউ কাউকে চেনেও না। তাই তারা কোম্পানির বিরুদ্ধে একত্র হওয়ার সুযোগ পান না। আবার তারা ১০০০ টাকা বা এর গুণিতক সংখ্যক শেয়ার মূল্যের জন্য বা এর লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য মামলা করতে যায় না। তারা এই ক্ষতিটাকে স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই সুযোগে কোম্পানিটি লভ্যাংশ প্রদান না করেও পার পেয়ে যায়। এই প্রবণতাও আমাদের শেয়ারবাজারে কমবেশি বিদ্যমান। শেয়ার বাজারের অস্থিরতার জন্য এটাও কিন্তু অনেকাংশে দায়ী।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ একটি পক্ষ কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ফাঁকতালে মুনাফা করে শেয়ার মার্কেট থেকে বেরিয়ে পড়ছে। এ কারণে শেয়ারবাজারকে গতিশীল করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার স্বার্থেই পুঁজিবাজার গতিশীল করতে হবে। ফটকাবাজদের হাত থেকে একে রক্ষা করতে হবে। কেউ যাতে কোনো অবস্থাতেই বাজারকে কৃত্রিমভাবে ম্যানুপুলেট করতে না পারে, সেজন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।
শেয়ারবাজার পুনর্গঠন করতে হবে। আর যারা বিনিয়োগ করছেন, তাদের উচিত এ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা। তাদের তাড়াতাড়ি ধনী হওয়ার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। বিনিয়োগ করতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। আজকে একটি কোম্পানির শেয়ার কিনলাম আর কয়েক মাস পরই তা বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করব, এটা কখনো শেয়ার ব্যবসার টার্গেট হতে পারে না। কারণ একটি কোম্পানির ব্যবসায় কিন্তু রাতারাতি প্রবৃদ্ধি হয় না। আর কোম্পানির যদি অতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি না হয় তাহলে তো সেই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য অতি দ্রুত বৃদ্ধি হবে কেন? সেই কোম্পানি বেশি মুনাফা কোত্থেকে দেবে? আর বেশি মুনাফা না দিলে শেয়ারের দাম বাড়বে কেন? যেখানে ব্যাংকে ডিপোজিটের বিপরীতে প্রদত্ত সুদের হার ৫-৬%, সঞ্চয়পত্রে প্রদত্ত সুদের ৯-১০% এবং দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬-৭%, সেখানে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগের কয়েক গুণ বেশি মুনাফা হবে কেন? এটা তো কখনো হবে না এবং এটা তো একটি সিম্পল ম্যাথ। অথচ শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারে দ্রুত সময়ে বেশি বেশি মুনাফা করতে চান, যা কখনো সম্ভব নয়।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক