আজ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। আনন্দের দিন। বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন আজ। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়ন অংশীদার এবং বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন ‘আমরা পারি’। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিবাদন। সুকান্ত ভট্টাচার্য পদ্মার উচ্ছ্বাসের ভেতরে আবিষ্কার করেছিলেন বাংলার অপরাজেয় বিদ্রোহী সত্তা। ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ/কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,/সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ।/জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অপরিসীম সাহসিকতায়, বিপুল আত্মবিশ্বাস, সততা ও দৃঢ়তায় বাংলাদেশের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করলেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সেতু নিছক স্টিলের কাঠামো নয়, এটি আমাদের আবেগ, জাতীয় অহংকার এবং অনমনীয় অসীম সাহস। সক্ষমতার প্রতীক এই পদ্মা সেতু। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। সাহসী নেতৃত্বের এক কালজয়ী পরম্পরার ফসল। এই সেতু দেশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সঙ্গে যুক্ত করবে। যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প, পর্যটন এবং অনেক ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে। ভুটান, ভারত, নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য ও পর্যটনের ক্ষেত্রে সংযোগ স্থাপনে বিশেষ সহায়তা করবে।
নিজস্ব অর্থায়নে ৬.১৫ কিলোমিটারের এ সেতুটি রাজনৈতিক, কারিগরি ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আজ তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা আর সাহস পদ্মা সেতুকে বাস্তবে পরিণত করেছে। সব প্রতিকূলতা জয় করে সফল হওয়ার সংস্কৃতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকেই। ১৯৫২ সালে নয়াচীনের সংগ্রামী মানুষের সাহসী কর্মযজ্ঞ দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছিলেন, ‘যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে, তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা’ (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৪)। বঙ্গবন্ধু সেই সূত্র মেনেই পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখে দুর্বার গতিতে দেশ গড়ার লড়াইয়ে নেমেছেন। তাঁর এই সংগ্রামী অভিযাত্রারই ফসল স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
২০০১ সালের ৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে মাওয়া ফেরিঘাটের কাছে এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন পাশে ছিল বিশ^ব্যাংক ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা। পরবর্তীকালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে একে একে সবাই সরে যায়। এ অবস্থায়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস ও মনোবল হারাননি। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন নিজস্ব অর্থায়নে সেতু গড়ার। বিশাল চ্যালেঞ্জের সামনে তিনি ইচ্ছা, দৃঢ়তা, মানসিক শক্তি সর্বোপরি নিরন্তর পরিশ্রমে আজ সার্থকতা খুঁজে নিয়েছেন। বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে মোকাবিলা করতে হয়েছে অনেক আর্থিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সঙ্গে কারিগরি চ্যালেঞ্জও কম ছিল না। আমাজনের পরে সবচেয়ে খরস্রোতা পদ্মায় পিলার বসানো ছিল অনেক চ্যালেঞ্জের। স্থাপন করতে হয়েছে বিশ্বের গভীরতম (১২২ মিটার) পিলার। বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনতে হয়েছে। বদলাতে হয়েছে নকশা। এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে গৌরবের পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক মুক্তির এক মাইলফলক। এ সেতুর কল্যাণে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে নিশ্চিতভাবে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ২১ জেলার আর্থ-সামাজিক অবস্থায় আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় কাঁচামাল সংগ্রহ করে এলাকায় গড়ে উঠবে শিল্প-কলকারখানা। ইতোমধ্যে বেসরকারিভাবে ঘোষণা আসছে আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার। অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, সিটি হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকারও। অর্থাৎ বিশাল কর্মসংস্থানের হাতছানি রয়েছে পদ্মা সেতু ঘিরে। অর্থনীতিবিদরা মডেলিং করে হিসাব করছেন, এই সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ২.৫ শতাংশ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপি বাড়বে প্রায় ১.২৩ শতাংশ। ট্রান্স এশিয়ান রেল ও সড়ক এ সেতুর মাধ্যমে যুক্ত হবে। রেলের প্রভাবে জাতীয় জিডিপিতে আরও এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হবে। ঢাকা মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ও যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে ব্রিজসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প সম্পূর্ণ হলে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি মানবের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করছি।’ সেই অদম্য লড়াকু মনের উত্তরসূরি দেশরত্ন শেখ হাসিনাও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান।
জীবনযুদ্ধ মোকাবিলায় তার সাহসী নেতৃত্ব জনগণকে ইতিবাচক পথ দেখায়। আত্মনির্ভরশীলতায় ঋদ্ধ করে। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে শেখায়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো চ্যালেঞ্জ গ্রহণেও পিছপা হয় না। আর তাই শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে নিজেদের সক্ষমতার প্রতীক দাঁড়াতে পারে মাথা উঁচু করে। গড়ে ওঠে আমাদের পুঞ্জীভূত আত্মশক্তির সমাহারে আত্মপ্রত্যয়ের এক অসাধারণ স্বপ্নের মিনার। কবিগুরু যথার্থ বলেছেন, ‘আমাদের বাঁচিবার উপায় আমাদের নিজেদের শক্তিকে সর্বতোভাবে জাগ্রত করা’ (আত্মশক্তি, রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খ-, পৃ. ৬৪৪)।
বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের সেই ভরসার বাণীই শুনিয়েছেন অন্তরের অন্তস্তল থেকে- ‘পদ্মা সেতু আমরা নিজেদের সম্পদেই গড়ব।’ তিনি তার অঙ্গীকার পূরণ করেতে পেরেছেন। সব চ্যালেঞ্জ তুচ্ছ করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ দেশের দীর্ঘতম সেতু গর্বিত সৌন্দর্যে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও দক্ষ নেতৃত্বগুণের এক অপূর্ব স্বাক্ষর। এর মাধ্যমে পুরো জাতির মনে তিনি বুনে দিয়েছেন আত্মনির্ভরশীলতার জয়টিকা। জয়তু পদ্মা সেতু। জয়তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।