রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৩ অপরাহ্ন

প্রস্তাবিত বাজেট গতানুগতিক

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২
  • ১১৭ বার

বাজেট তথ্য-উপাত্ত
প্রস্তাবিত বাজেট উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এমপি ও তার পরিবারের ১৩ পৃষ্ঠার স্তুতিসহ ৭৮৩ (সাত শ’ তিরাশি) পৃষ্ঠায় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত১ অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে। এই দীর্ঘ পরিসরের গ্রন্থ’টি চাণক্য চতুরতা এবং হয়রানি ও দুর্নীতির মূল দলিল ও বাহক।

ক. মূল কথা
প্রস্তাবিত ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের ৪২.৩ শতাংশ ব্যয় হবে সুদ পরিশোধে (১১.৯ শতাংশ), জনপ্রশাসনে ১৯.৯ শতাংশ, প্রতিরক্ষায় ৫.৯ শতাংশ এবং জন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪.৬ শতাংশ অর্থাৎ মোট ব্যয় ৮০,৩৭৫ (আশি হাজার তিন শ’ পঁচাত্তর) কোটি টাকা। বিনোদন, সংস্কৃতিতে মাত্র ০.৮ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর জন্য বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারাকাতের বিকল্প ভাবনা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রস্তাবগুলোর বিবেচনা দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। আয়কর ও অন্যান্য কর না দিয়ে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশে নেয়া অর্থ ফেরত না এনে কেবল ৭.৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে অবৈধ কাজকে বৈধ করা হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তবে অর্জিত অর্থের ন্যায্য আয়কর পরিশোধ করা হয়ে থাকলে এর ওপর ৭.৫ শতাংশ অতিরিক্ত আয়কর দিয়ে তার অর্থ বৈধ পথে বিদেশে স্থানান্তরের সুবিধা দেয়া অন্যায় হবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন তদবির সুস্পষ্ট।

কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার বাজেট আলাদা করে দেখানো উচিত। স্বাস্থ্যসেবা বরাদ্দ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ সাথে একত্রীভ‚ত করে দেখানো বাঞ্ছনীয়।

খ. প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে- শ্রম ও কর্মসংস্থান, শিল্প, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা, মহিলা ও শিশুবিষয়ক এবং আইন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দ কমানো। পরিসংখ্যান ও তথ্য মূল্যায়ন বিভাগের উন্নয়নকাজের ৮০ শতাংশ কেটে রাখা হয়েছে। মিথ্যা বা ভুল তথ্য সংগ্রহ করে কি লাভ? রোহিঙ্গা সমস্যা বিদ্যমান থাকাবস্থায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কমানো মারাত্মক ভুল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বরাদ্দ দ্বিগুণ করুন। সুষ্ঠু ভোট হয় না, সংসদে আলোচনায় আগ্রহী নয়, সম্ভবত তাই তাদের উন্নয়ন বাজেট বাড়েনি। বিচার বিভাগের উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানো হয়েছে।

গ. শান্তি ও সহিঞ্চুতা সৃষ্টির জন্য বরাদ্দ
দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনে আস্থা সৃষ্টির জন্য নিরপেক্ষ সরকার ও উন্নত মন সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি, সহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার, সংগ্রাম ও সাম্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টির নিমিত্তে দেশীয় সংস্কৃতি ও খেলাধুলার ব্যাপকতা বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া কল্যাণকর হবে। দলীয় সরকারের স্থলে নির্বাচনের একাধিক বছর আগে নিরপেক্ষ সরকার সৃষ্টিতে জনগণের আগ্রহ, প্রচার ও পরামর্শ সংগ্রহের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ আলাপ-আলোচনায় দেশে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হবে। জাতীয় সরকারের বিষয়টিও আলোচনায় নিতে পারেন।

ঘ. রফতানি আয়ে অগ্রিম আয়কর বৃদ্ধি
রফতানি আয়ে ০.৫ শতাংশের স্থলে ১ শতাংশ অগ্রিম কর ধার্য করা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে। রফতানিতে ০.৫ শতাংশের পরিবর্তে ১ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কর্তন সাম্যভিত্তিক। উল্লেখ্য, বাজেটে সব করপোরেট ব্যবসায়ীর কর হার ৩২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আন্দোলনের হুমকি না দিয়ে কৃতজ্ঞ হওয়ার অভ্যাস করুন। এক ব্যক্তি কোম্পানির করও কমানো হয়েছে। ব্যাংক ও বীমার আয়কর কমিয়ে দিন, তবে এসব সংস্থা দাতব্য কাজে ন্যূনতম ৫ শতাংশ দান করতে কাম্য। ক্ষুদ্রঋণ, এসএমই অর্জিত আয়কারী সম্পদ তৈরি প্রতিষ্ঠানের আয় করমুক্ত করা হয়েছে।

ঙ. বেসরকারি শিক্ষা ও সেবা প্রতিষ্ঠানে আয়কর প্রয়োগ ভুল সিদ্ধান্ত
কেবল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৫ শতাংশ আয়কর ধার্য হয়েছে, যা অত্যন্ত গর্হিত, ভুল, অনৈতিক ও শিক্ষা প্রসারে প্রতিবন্ধকও বটে। বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউজিসি বা অন্য কোনো সরকারি অনুমোদন ভর্তুকি নেই। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এরূপ কোনো কর নেই। এটি সংবিধানের পরিপন্থী। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির ওপর ধার্য বিভিন্ন শুল্ক ও অগ্রিম কর চিকিৎসাসেবার অন্যতম প্রতিবন্ধক। বড় হাসপাতালকে ১০ বছর আয় করমুক্ত করা হয়েছে। বারবার কর্তৃপক্ষের নজরে আনার পরও বিগত কয়েক বছর যাবৎ হাসপাতাল শয্যা, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির ওপর ১৫ থেকে ৫৮ শতাংশ বিবিধ শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর চালু রাখা হয়েছে। এ জাতীয় নিয়মাবলি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।

প্রস্তাবিত বাজেটে কর ও শুল্ক কিছু কমানোর পরও আমদানিকৃত বেশির ভাগ যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে ২০.৫০ থেকে ৫৮.৬০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে।

পরিবারভিত্তিক পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রপাতি,পয়ঃপ্রণালী পরিষ্কারক (Sewage Treatment Plant) যন্ত্রপাতির ওপর আমদানি কর ধার্য করা ভুল সিদ্ধান্ত। প্রিন্টিং প্লেট, ফিল্ম আমদানিতে ১ শতাংশ থেকে শুল্ক বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ করা সংবাদ ও মিডিয়ার কণ্ঠরোধের পূর্ব পদক্ষেপ। হাসপাতাল, মেডিক্যাল, ল্যাবরেটরি ও শিক্ষা উপকরণ আমদানিতে সব প্রকার শুল্ক, ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর রহিত করা হবে ন্যূনতম মৌলিক পরিবর্তন।

চ. একাধিক শুল্কস্তর হয়রানি দুর্নীতির দ্বার : ছয় স্তরের পরিবর্তে তিন স্তরবিশিষ্ট আমদানি ১ শতাংশ, ১০ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ শুল্ক করলে দুর্নীতি কমবে, জনগণের হয়রানি কমবে, সরকারের রাজস্ব বাড়বে।

ক্ষুদ্র খামারি ও শ্রমিকের প্রাপ্যতা ভুলে গেছেন
সরকারি ভাষ্যমতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের শ্রমিক সংখ্যা ছিল ছয় কোটি ৩৫ লাখ, ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ১.২০ কোটি যা ২০৪১ সালে ৩.১০ কোটির বেশি হবে। বাজেটে কোনো মৌলিক পরিবর্তনের নির্দেশনা নেই, গতানুগতিক বাজেট হয়েছে। ধনী ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থই বিবেচনা নেয়া হয়েছে। প্রান্তিক চাষি, খামারি, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও পুষ্টি বৃদ্ধির কোনো সুস্পষ্ট সুপারিশ ও প্রণোদনা নেই। তাদের কেবল সামাজিক সুরক্ষা ও আজীবন পেনশন মুলা দেখানো হয়েছে। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্য বীমার ক্ষেত্রে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান, শ্রমিক সন্তানদের বিনা টিউশন ফিতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন সুবিধা নিশ্চিত করুন। জীবনযাত্রার ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক বেতনভাতা দাবি ২০ হাজার টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা ও সর্বজনীন পেনশনের মুলা ঝুলানো হয়েছে। এটি যথেষ্ট নয়।

ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ নেই। বরং তাদের ক্ষুদ্রশিল্প হারে বিদ্যুতের পরিবর্তে বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। অধিক শুল্ক দিয়ে পোলট্রি, পশু ও মৎস্যখাদ্য আমদানি করতে হয়। তাদের বড় উৎপাদক ও সিন্ডিকেটের সাথে প্রতিনিয়ত অসমতল সংগ্রামে লিপ্ত হতে হচ্ছে।

আয়কর বহির্ভূত বার্ষিক আয়সীমা নির্ধারণ
আয়করবহির্ভ‚ত বার্ষিক আয়সীমা বৃদ্ধি যুক্তিসঙ্গত। আয়করবহির্ভ‚ত বার্ষিক আয় তিন লাখের স্থলে পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণ প্রয়োজন। তিন লাখ টাকায় স্থির থাকলে রিকশাচালক, ভ্যানচালক ও বেবিট্যাক্সি চালকদের কাছে আয়কর আদায়ের জন্য ধাওয়া করতে হবে। উল্লেখ্য, ১৮ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে সব নাগরিক/ক্ষুদ্র খুচরা ও ফুটপাথের হকার, খাবার দোকানদারদের কাছ থেকে মাসে (বছরে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা) আয়কর নিবন্ধন ফি বিবেচনা স্থির করুন। তবে পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের হয়রানি বন্ধ করা নিশ্চিত করতে হবে।

আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বিপরীতে জনগণতান্ত্রিক উন্নয়ন
স্বল্পসংখ্যক সুবিধাবাদী শ্রেণিকেন্দ্রীকতার সংস্কারের পরিবর্তে জাতীয় নিরাপত্তায় বিঘ্ন, অধিক ব্যয়, দীর্ঘসূত্রতা প্রভৃতি জুজুর ভয় দেখিয়ে বিকেন্দ্রীকরণ সুকৌশলে প্রতিহত করা হয়। নতুন করে অতিরিক্ত বিভাগ সৃষ্টি করা হচ্ছে পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করতে। অথচ ১৯৩৪ সালে ফ্লাউড কমিশন বিভাগ প্রথা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছিল। সুশাসন ও গণতান্ত্রিকায়নের জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশকে ১৫ বা ১৭টি প্রদেশ/স্টেটে বিভক্ত করে নিয়মিত সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে প্রাদেশিক/স্টেট ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। এতে জনগণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দেশে বহুলাংশে দুর্নীতিমুক্ত সেবার নতুন যুগ সৃষ্টি হবে। এই লক্ষ্যে এই বছরের বাজেটে অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা প্রয়োজন। বর্তমানে সরাসরি ঢাকা থেকে নিয়োগকৃত ব্যক্তিরা সার্বক্ষণিকভাবে নির্ধারিত কর্মস্থলে অবস্থান করেন না। তাদের কর্মস্থলে অবস্থান নিশ্চিত করতে জনপ্রতিনিধি ও পেশা প্রতিনিধি গঠিত সমন্বয়ে প্রাদেশিক কর্মকমিশন ও বিবিধ বিষয়ক কর্তৃপক্ষের (Authority) মাধ্যমে নিয়োগ, প্রমোশন ও নিয়ন্ত্রণ করলে সুশাসন সহজলভ্য হবে।

পদ্মা প্রজ্ঞার প্রতিফলন প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়
সেবার অনুপস্থিতি, অপচয় এবং পেশাজীবী ও রাজনীতিবিদদের চিন্তার দীনতা দেশের দারিদ্র্য নিরসন না হওয়ার কেবল অন্যতম প্রধান কারণ নয়, এটি স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনার বিস্তৃতি ও প্রসার ঘটায়।

ক. চিকিৎসাসেবার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবল
আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। এটা স্মরণ রেখে সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পাঁচ লাখ চিকিৎসক, ৪০ লাখ নার্স-টেকনিশিয়ান, এক লাখ দাঁতের চিকিৎসক (ডেন্টিস্ট), ১০ লাখ সার্টিফাইড ফার্মেসিস্ট, ২০ হাজার মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং দুই লাখ ফিজিওথেরাপিস্টের প্রয়োজন হবে। সাথে প্রবর্তন করতে হবে এমবিবিএস চিকিৎসক (General Practitioner Physician), পদ্ধতি ও হাসপাতালে রেফারেল প্রথা।

বিভিন্ন টেকনিশিয়ান ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেটধারী কোর্স চালু না থাকায়, আমদানিকৃত হাজার হাজার কোটি টাকার গুরুত্বপূর্ণ মেশিন কেবল প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে বাক্সবন্দী বা অকেজো হয়ে পড়ে আছে এবং থাকবে। ৫০টি জনবল প্রশিক্ষণ সংস্থাতে বছরে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে পর্যাপ্ত জনবলের প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হবে।

চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষাক্ষেত্রে অপচয় বন্ধ করা ও সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে সব সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস, বিডিএস, বিএসসি নার্সিং, বিফার্ম (ফার্মেসিতে ডিগ্রি), এমফার্ম বিএসসি/এমএসসি, মাইক্রোবায়োলোজি, অকুপেশনাল থেরাপি, বয়োবৃদ্ধ ও অন্যান্য বিভাগে সেবার শিক্ষাদানের জন্য ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট শিক্ষা চালু করার জন্য দ্রুত অনুমোদন ও বরাদ্দ প্রয়োজন। একই মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিবিধ প্রকার ডিগ্রি ডিপ্লোমা পড়িয়ে পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট দিন। সব মেডিক্যাল কলেজে বছরে ২০ হাজার ছাত্রকে এমবিবিএসে ভর্তির সুযোগ দিন। এতে সরকারের কোনো বিনিয়োগ লাগবে না, ছাত্ররা নিজ খরচে পড়বে।

খ. ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (UHEWC) পরীক্ষামূলক চিকিৎসাসেবা উন্নয়ন
বাংলাদেশে প্রায় অচল অব্যবহৃত, যা নড়বড়ে পাঁচ হাজার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে যা প্রায়ই বেলা ২টার পর খোলা থাকে না। ২৪ ঘণ্টা সেবা নিশ্চিত করার জন্য মাত্র ১০০টি (০.৫ শতাংশ) সেন্টারে সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ও ১০০টি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১০টি এনজিওকে পাঁচ বছর চালানোর জন্য বরাদ্দ দিন।

গ. সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সুলভ ও সহজ নিবন্ধন
সব সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন একই নিয়ম ও মানদণ্ডে তিন বছরভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ফি ৫০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

ঘ. গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন
বর্তমানে একটি ইউনিয়নে ৩০ থেকে ৫০ হাজার নাগরিক বসবাস করেন যা আগামী ২০ বছরে ৬০ থেকে ৮০ হাজারে পৌঁছবে । প্রায় সব ইউনিয়নে একটি দোতলা বিল্ডিংয়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে যার নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে পড়ছে, ইলেকট্রিক সাব-স্টেশন ও গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে।

সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে ঢাকা থেকে পাঠানো এমবিবিএস চিকিৎসক যান না, অবস্থান করেন না বিবিধ অজুহাতে। কিন্তু মাস শেষে নিয়মিত বেতনভাতা সংগ্রহ করেন। অনেকের সাধারণ মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি পরিচালনার জ্ঞানও নেই। সেসব শিখতে তিন মাসের বেশি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। চামড়ার নিচে ভেঙে যাওয়া মেরামত, এপেনডিক্স, সিজার অপারেশন, অবস্টেট্রিকেল আলট্রাসনোগ্রাফি, মৌলিক জেনারেল ও কাটামিন এনেসথেসিয়া প্রভৃতি ছয় মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন তরুণ এমবিবিএসকে প্রশিক্ষিত করা অত্যন্ত সহজ কাজ। ইউনিয়ন পর্যায়ে দুই বছর কর্মরত চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা পাসের পর জুনিয়র বিশেষজ্ঞ পদে উন্নীত করুন। তাদেরকে প্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়া হলে স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসক রাখা সম্ভব হবে।

মেডিক্যাল ছাত্ররা তিন প্রফেসনাল সময়কালে এক মাস করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে অবস্থান করে জ্ঞানার্জন করবে। এতে বছরে সরকারের মাত্র ২৪ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি হবে। বর্তমানে কেবল গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষাকার্যক্রমে নিবিড়ভাবে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক উচ্চ প্রশংসিত হচ্ছে।

ঙ. প্রধানমন্ত্রী সাহস করে সঠিক কাজ করুন
কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী সদ্য পাস চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপের মেয়াদ এক বছরের স্থলে দুই বছর স্থির করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। তরুণ চিকিৎসকরা প্রথম বছর নিজ নিজ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও দ্বিতীয় বছর ইউনিয়ন এবং উপজেলা হাসপাতালে কাজ করবেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের চাপে পরে এক মাসের মধ্যে প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করে নেন। দেশের সর্বত্র সমমানের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হলে চিকিৎসক ও অন্যান্য সেবাকর্মীর ২৪ ঘণ্টা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। পূর্বতন প্রজ্ঞাপনটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

চ. ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি উন্নতমানের সুলভ ওষুধের নিয়ামক
১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করলে দেশে প্রস্তুত ওষুধের বিক্রয়মূল্য (MRP) ৪০-৬০ শতাংশ কমে আসবে। কোম্পানিগুলোকে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতে দেয়া (Indicative Pricing) অনৈতিক এবং জনসর্বসাধারণকে প্রতারণার মাধ্যম মাত্র।

ছ. একটি সংস্কার দুর্নীতি কমাবে, কারাগার মানবিক হবে
প্রতিরক্ষা ও সশস্ত্রবাহিনীর জন্য উল্লেখ্যযোগ্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। আর্মি মেডিক্যাল সার্ভিস পরিচালিত ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালগুলোর সেবার সুনাম আছে। তাদের অধীনে পুলিশ হাসপাতাল ও কারাগার হাসপাতালের পরিচালনা ব্যবস্থা করুন। তাদের নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি সামরিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল আছে। অভিযুক্তদের অগঈ পরিচালিত হাসপাতালে সব প্রকর চিকিৎসা নেয়া উচিত।
প্রথম বছর এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ এক হাজার পরীক্ষামূলক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সংস্কার, মেরামত, নির্মাণের ও উন্নয়নের জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকা মূলধনীয় বরাদ্দ পর্যাপ্ত হবে। মেডিক্যাল, নাসিং ও অন্যান্য সহকারীর ট্রেনিং নিমিত্তে অবস্থান সময়ে আহার বাসস্থান বাবদ প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের প্রান্তিক ভাতা, শিক্ষকতা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, জুনিয়র বিশেষ ভাতা প্রভৃতি প্রণোদনার জন্য অতিরিক্ত ৯০০ কোটি টাকা প্রতি বছর বরাদ্দের প্রয়োজন হবে যাতে সহজলভ্য ও প্রাপ্য হবে আধুনিক সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা। প্রয়োজন মৌলিক পরিবর্তন। এ নিমিত্তে এই বছর থেকে সব মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রভর্তি দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। এরূপ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের ন্যূনতম ১/৫ অংশ বিদেশে কাজ করে সরকারের বিনিয়োগ অধিক ডিভিডেন্ট অন্যান্য উন্নত দেশগুলো থেকে বৈধ পথে দেশে পাঠাবেন। এমনকি জগএ থেকেও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা সমধিক।

অতিরিক্ত বরাদ্দ কোথা থেকে জোগাড় হবে : মদ, মাদকদ্রব্য, পান-জর্দা, বিড়ি ও প্রসাধনীর বর্ধিত শুল্ক থেকে। ভয়ানক ক্ষতিকর এসব দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি এসব সামগ্রীর ওপর এরূপ হারে বিভিন্ন কর, শুল্ক, অগ্রিম আয়, সম্পূরক কর, পরিবেশ বিধ্বংসী কর, স্বাস্থ্যসেবা অতিরিক্ত ব্যবহার, পান পিক দিয়ে রোগজীবাণুু বিস্তার রোধ প্রভৃতি কর আরোপ করা যায়।

তথ্যসূত্র :
১.
জাতীয় বাজেট বক্ততা ২০২২-২৩ : কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন, অর্থমন্ত্রণালয়। ৯ জুন ২০২২ ।
মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি, ২০২২-২৩ থেকে ২০২৪-২৫, ঐ
জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন ২০২২-২৩, ঐ
সম্পূরক আর্থিক বিবৃতি ২০২১-২২, ঐ
বাৎসরিক বাজেট ২০২২-২৩ : বাজেটের সংক্ষিপ্তসার, ঐ
বাৎসরিক বাজেট ২০২২-২৩ : বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি, ঐ
২. Bangladesh Customs Tariff Solution : ২০২১-২২

লেখক : ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র


নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com