আগামীকাল বাংলাদেশের মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে সমকালের পাঠক, লেখক, শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে আমরা জানাই ঈদ মোবারক। আমরা জানি, ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ কোরবানি। বস্তুত প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে মহান আল্লাহর নির্দেশে কোরবানির পরীক্ষায় যেভাবে হজরত ইবরাহিম (আ.) উত্তীর্ণ হয়েছেন, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মুসলমানরা সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানির মাধ্যমে এ ঈদ উদযাপন করে থাকেন। তাই ত্যাগ ও আনুগত্যের নিদর্শন এ ঈদ উদযাপনের মধ্যে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় উদ্দেশ্যই হাসিল হয়। কোরবানির মাংস ও পশুর চামড়ার অর্থ পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেও ব্যক্তির ত্যাগ প্রস্ম্ফুটিত হয়। গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়ানো এই কোরবানি আমাদের সহমর্মিতার শিক্ষাও দেয়।
বলাবাহুল্য, ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করা হয় রূপক অর্থে। কোরবানি তথা উৎসর্গ যেমন পশুকে করা হয়, তেমনি আমাদের মনে সকল পাপ-পঙ্কিলতা ধুয়েমুছে সাফ করাও এর বাইরে নয়। সৎ পথে উপার্জিত অর্থে কেনা পশুর মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। কোরবানির পশু ক্রয় নিয়ে সমাজে যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে, তা দুঃখজনক।
এবার এমন এক সময়ে ঈদুল আজহা এসেছে যখন সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের অন্তত ১৬টি জেলার মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ি-বাসস্থান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে অনেকের। বন্যার্তদের অনেকেরই এবার কোরবানি দেওয়া তো দূরের কথা, উৎসবের সাধারণ আয়োজন করার সামর্থ্য নেই। কোরবানির ত্যাগ ও সহমর্মিতার শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা মনে করি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। তা ছাড়া কোরবানির মাংস ও পশুর চামড়ার অর্থও ওই অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করা যায়।
প্রতি ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি যায় মানুষ। মানুষের স্বস্তি ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রতিবছরই নানা বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। এবারও ঈদযাত্রা স্বস্তি হলো না বলে শুক্রবারের সমকালে প্রকাশ। পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে কিছুটা স্বস্তি আনলেও যানজটে নাকাল যাত্রীরা। উত্তরের পথেও মহাসড়কে যানজট আর ট্রেনে ভিড় ও ভোগান্তি। সব মিলিয়ে ঢাকা ছাড়তেই তীব্র ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। অব্যবস্থাপনা দূর করাসহ ঈদযাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারকে দৃষ্টি দিতেই হবে।
ঈদুল আজহা আরবি জিলহজের ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়; যখন সারাবিশ্বের মুসলমান পবিত্র হজ পালনে আল্লাহর ঘরে সমবেত হন। করোনা দুর্যোগের কারণে গত দুই বছর সীমিত পরিসরে হজ পালিত হলেও এবার অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। এবার বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬০ হাজার ব্যক্তি হজে অংশগ্রহণ করেছেন। লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাত ময়দানের কলরব প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা বাংলাদেশ থেকেও শুনতে পাই।
কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে কয়েক বছর ধরে যে নৈরাজ্য আমরা লক্ষ্য করছি, তা হতাশাজনক। সমাজের অসহায় মানুষের অধিকার হিসেবে কোরবানির চামড়ার বাজার রক্ষা করা জরুরি বলে আমরা মনে করি।
চামড়ার বাজার নিয়ে চলা অস্থিতিশীলতার অবসান ঘটাতে হবে। এ বছর এরই মধ্যে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। গত বছরের তুলনায় চামড়ার দাম বাড়লেও তা থেকে ওই অসহায় মানুষ কতটুকু উপকৃত হবেন, তা নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে। আমরা জানি, সারা বছর দেশে যে পরিমাণে পশু জবাই হয়, তার প্রায় অর্ধেক হয় কোরবানির ঈদে। ‘গরিবের হক’ হিসেবে বিশেষ করে কোরবানির সময় চামড়ার দামের বিষয়টিতে প্রশাসনের যথাযথ ভূমিকা প্রত্যাশিত।
কোরবানির পশু জবাই, মাংস ও পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই। এবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আগের মতো জবাইয়ের স্থান নির্দিষ্ট করা না হলেও পশুর বর্জ্য অপসারণ তদারকিতে প্রশাসন মাঠে থাকবে। আমরা প্রত্যাশা করি, কোরবানিদাতারা যেমন এ ব্যাপারে সচেতন থাকবেন, একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের তৎপরতায় দ্রুত শহর পরিচ্ছন্ন হবে। তাঁদের সহযোগিতা করা উচিত সবার। আমাদের অসচেতনতার কারণে আনন্দের ঈদ যেন নিরানন্দ না হয়।