প্রতিবছর আগস্ট মাস এলেই আমরা ফিরে যাই ১৫ আগস্টে। কারণ, ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আমরা হারিয়েছি। সে কারণে আগস্ট আমাদের কাছে এক অভিশপ্ত মাস। শোকের এ মাসে আমরা আনন্দ আয়োজনের অনেক কিছুই পালন করি না। আমরা ঘৃণা করি, যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ঘৃণিত হত্যাকারীদের কেউ কেউ আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমরা দেখেছি, কীভাবে হত্যাকারীদেরই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াসহ সব ধরনের দায় থেকে মুক্তি দিতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছে। হত্যাকারী ও তাদের দোসররা এ দেশ শাসন করেছে। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে বেশি দিন দেশ শাসন করতে দেয়নি। তারপরও সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় চীনের চেয়েও বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা আলো থেকে এক অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমাদের পশ্চাৎমুখী যাত্রা হয়। আমরা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য হারিয়ে পাকিস্তানমুখী হই। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে বটে, কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। সে কারণে আমরা ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে প্রায় একই ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে; আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু তারা ষড়যন্ত্রে সফল হয়নি। যদিও সেদিনের ঘটনায় আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী প্রাণ হারান। বস্তুত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট এক সূত্রে গাঁথা। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হলেও ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। সেই ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হওয়া আজ জরুরি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা করেছে; সেখানে হত্যাকারীদের বিচার যেমন হয়েছে; একই সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীরাও বিচারের আওতায় এসেছে। সে জন্য দেশে দেশে নানা কমিশন গঠন করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার বিচার হয়েছে, তেমনি তাঁর হত্যার ষড়যন্ত্র উন্মোচনের জন্য গঠন করা হয়েছে ওয়ারেন কমিশন। ভারতেও মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন হয়েছে; পাশাপাশি হত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র উন্মোচনেও তদ্রূপ একটি কমিশন গঠন আজ জরুরি। কীভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতে ট্যাঙ্ক নেওয়া হয়েছে; এভাবে আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যার ষড়যন্ত্র উন্মোচন হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ নামক এই প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের দিকগুলো জনগণের জানার অধিকার আছে। সে জন্য অতিদ্রুত একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। সেই তদন্ত কমিশন ষড়যন্ত্রের একেবারে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সার্বিক বিষয়টি যেন তুলে ধরে। জনগণ জানতে চায়- কারা কারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে জড়িত। এগুলো বিচারিক আদালতে বিচার ও শাস্তি হওয়ার একটি বিষয়। কিন্তু এখানে জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকে জড়িত। এসব বিষয় উন্মুক্ত হওয়ার জন্য একটি কমিশন গঠন প্রয়োজন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্যই এ ধরনের একটি কমিশন প্রয়োজন।
১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, সেদিন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের মধ্যে এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য ছিল। বঙ্গবন্ধু আসবেন; আমরা তাঁকে দেখব, তাঁর ভাষণ শুনব। অন্যদিকে ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বোমা বিস্ম্ফোরণ ঘটানো হয়। যারা এ বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়েছিল, তারাও নিশ্চয় বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানত। এখন ২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেক বছর কেটে গেছে। ষড়যন্ত্রের অনেক আলামত হয়তো বিনষ্ট হয়ে গেছে। তার পরও খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। এখনও যদি বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করে; আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার দেশি-বিদেশি অনেক প্রমাণ রয়েছে। তখন বিদেশি সাংবাদিকরা ছিলেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাঁরা অনেক কিছুই লিখেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র বস্তুত শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে- রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে বিচার করা হবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র জানার পরপরই তাঁর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু যেটা বলার বিষয়, ইয়াহিয়া খান ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সে সময় তারা সফল হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের এদেশীয় দোসররা সে ঘৃণ্য কাজ করেছিল।
বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন এবং সারাজীবন মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি বৃদ্ধ মা-বাবা কিংবা পরিবারের কাছে যাননি। তিনি সেদিন সেই রেসকোর্স ময়দানে জনগণের কাছে ফিরে আসেন, যে মযদানে ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন- তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। বঙ্গবন্ধু সেদিনও জনসমুদ্রে তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা চলে গেলেও তাদের দোসররা রয়ে গেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা যে রয়ে গেছে- তা বঙ্গবন্ধুও আঁচ করতে পেরেছিলেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলেও সেদিন তাঁর কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানি থাকায় বেঁচে যান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পর দেশে ফিরে আসেন। তিনি দেশে ফিরে বলেছিলেন, আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরছি- এমনটা নয়; বরং মানুষের মুক্তিই আমার লক্ষ্য। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সেই দেখানো পথে অবিচল থেকেছেন। তাঁর হাত ধরেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের শিখরে পৌঁছেছে। মাঝখানে আমরা যে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, শেখ হাসিনা সেখানে আলোকবর্তিকা হিসেবে এসেছেন। পদ্মা সেতুর মতো আমাদের দেশেরও মাথা তিনি উঁচু করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র তাঁর হাত ধরেই উন্মোচিত হোক। বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করুক- শোকাবহ আগস্টে এটাই প্রত্যাশা।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়