এ দেশে বহুকাল ধরেই লাফিয়ে লাফিয়ে, দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে চাল, ডাল, মাছ, গোশত, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা ওষুধপত্র ইত্যাদির দাম। শুধু তাই নয় বরং নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষগুলোর প্রিয় খাবার ডিম। সেই ডিমের দাম আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি হিসাবেই মোটা চালের কেজি এখন ৪৮ টাকা হয়েছে। বাজারে যা কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৫০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমান বাজারে নিত্যপণ্যের দামের কথা যদি বলি তাহলে দেখা যাবে, খোলা সয়াবিন তেল ১৯০, পামঅয়েল ১৫০, দেশী পেঁয়াজ ৫৫ , আমদানি করা পেঁয়াজ ৫০, ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের হালি ৬০ টাকা এবং প্রতি শাকসবজিতে ১০-১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষরা একটু ডাল-ভাত কিনে খাবে সে উপায় নেই। শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ছোট্ট ধারণা দেয়া যাক। পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন পরেশ রায় নামে এক ব্যক্তি। তার কাছে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলে, বাজারে এখন আগুন লেগেছে। সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চালের দাম বেড়েছে সেটি না হয় মেনে নিলাম; কিন্তু ডিম আর কাঁচামরিচের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কষ্ট পেয়েছি। আগে ভর্তা আর কাঁচামরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে নিতাম। এখন এরও উপায় নেই। তাই বলা যায়, নিম্ন আয়ের মানুষের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তারা অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে। এ দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া মানেই দরিদ্র ব্যক্তিদের পক্ষে বজ্রাঘাততুল্য। ফলে গরিব মধ্যবিত্তরা জীবনযাত্রার ব্যয় সঙ্কুলান করার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। জনগণের আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো মিল নেই।
ভয়াবহ সঙ্কটে ভুগছে চা-শ্রমিকরা। দেশে বর্তমান চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। যার মধ্যে সর্বোচ্চ মৌলভীবাজার জেলায় ৯২টি চা-বাগান। চা-শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। অর্থাৎ, মাসিক তিন হাজার ৬০০ টাকা বেতন। এই সীমিত আয় দিয়ে বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের যে দাম সেই তুলনায় এই টাকা কিছুই না। তাদের দিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনিতে প্রতি বছর চা-শিল্পে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে। ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছে ৯৬ মিলিয়ন কেজি চা, যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড। চা-শিল্পের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে তারা; কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে আন্দোলন চলছে, ধর্মঘট হচ্ছে। ফলে চা-শিল্পের উন্নয়েন বাধাবিপত্তির আশঙ্কা দেখা দেবে। কাজেই এখনই সময় চা-শিল্পের উন্নয়নে, শ্রমিকদের চাওয়া পাওয়া নিয়ে ভাবা আর তাদের দাবি বাস্তবায়ন করা।
আমাদের দেশে একটি বৃহৎ অংশ ছাত্র। তাদের মেস কিংবা ভাড়াবাসায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। বেশির ভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ফলে তারা তাদের পড়াশোনা এবং নিজ খরচ পরিচালনা করার জন্য টিউশনি কিংবা যেকোনো পার্ট টাইম জব করে থাকে। কিন্তু তাদের এই সীমিত আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো মিল নেই। কারণ বর্তমান সময়ে দেশের বাজারের দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা এতে ব্যাচেলরদের জীবনযাপনে চরম শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছে। বলা যায়, অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে। সমাজে প্রচলিত একটি কথা আছে, ডিম-ডাল হচ্ছে ব্যাচেলরদের প্রিয় খাবার। আসলেই তাই। কিন্তু বর্তমান সময়ে ডিম-ডালের যে হারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছ ব্যাচেলরদের জীবনে এই খাবারটি জুটে কি না সেই বিষয়ে সন্দিহান। এতে করে ছাত্রসমাজ বা শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার বিষয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে তাদের এই বিলাসবহুল শহরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে তা আর কমার নজির নেই।
আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে পেট্রল, এলপি গ্যাস ও ভোজ্যতেলের দাম কতবার বেড়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কমার খবর প্রকাশ হলেও দেশের বাজারে তা কমার কোনো খবর নেই। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ জনগণ প্রতিদিনের খাদ্যসামগ্রী কিনতেই প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। তাই সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে টিসিবির বুথ বাড়িয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে ৮-১০ বছর আগেও টিসিবির পণ্য কিনতে ১০-১৫ জনের বেশি লোক দেখা যেত না। আর এখন সর্বত্র টিসিবির পণ্য কিনতে শত শত লোক দীর্ঘ লাইন ধরছে একটু সাশ্রয়মূল্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য। প্রাসঙ্গিকতায় বলতে হচ্ছে, যে পরিবারের সদস্যরা টিসিবি পণ্য লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে হবে স্বপ্নেও ভাবেনি তারাও আজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে, বছরখানেক আগেও বাজারে বাজার করতে গেলে দুই-একজন ভিক্ষুক সাহায্য চাইতেন। আর এখন বাজার করতে দাঁড়ালে সামনে-পেছনে, ডানে-বামে সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা অন্তত ৮-১০ জনে উন্নীত হয়েছে। তাদের এমন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দেশটা মহাসঙ্কটের দিকে চলছে। এখন কথা হচ্ছে, এসব কিসের আলামত? উন্নয়নশীল দেশে এমন তো হওয়ার কথা নয়।
মুখে আমরা যতই বলি দেশ উন্নত হচ্ছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আসলে কি দেশ উন্নত হচ্ছে? শুধু যাতায়াতব্যবস্থা বা আনুষঙ্গিক যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলোর উন্নতি সাধন করলেই কেবল উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে ওঠা যাবে না। বরং সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় সেগুলো বাস্তবাযন করতে পারছে কি না তা নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল দেশ উন্নত হিসেবে বিবেচিত হবে।
মুদ্রাস্ফীতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। প্রতি বছর যদি ৫ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয় তাহলে অবশ্যই দ্রব্য উৎপাদনের খরচ বাড়বে ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া পৃথিবীজুড়ে উৎপাদিত দ্রব্য ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অনুপাতে সমান নয়। কোথাও বেশি আবার কম। কিন্তু বেশি হওয়ায় সমাজে সম্পদের অপ্রতুলতা সৃষ্টি হয়, যার ফলে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যার প্রয়োজন অনুযায়ী চাহিদা বাড়তে থাকলে দ্রব্যের মূল্যও বাড়তে থাকে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বাংলাদেশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও দায়ী। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় অনেকেই দ্রব্যমূল্য বাড়িয়েছেন। কিছু কিছু আড়তদার আছেন যারা পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেন। আড়তদার ও মজুদদার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দায়ী। বাংলাদেশে অনেক খাতে দুর্নীতি বিদ্যমান। এই দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ। সিন্ডিকেটের সাথে যারা জড়িত তারা শাস্তি পায় না। ফলে আবারো সেই একই কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না।
নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মজুদকারীদের বিরদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেন তাদের শাস্তি দেখে বাদ বাকি সবাই এমন ঘৃণ্য কাজ করতে সাহস না পায়। পণ্য সঙ্কটের অজুহাতে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা যেন পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক