এক বিদেশী সাংবাদিক একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনারা মিছিলে বাচ্চাদের ব্যবহার করেন কেন?
বাচ্চা বলতে ওরা দেখেছে টোকাইদের। বিবিসি বিগত আন্দোলনের সময় একবার তথ্যনির্ভর খবর পরিবেশন করতে পারেনি। সেবার সংবাদ প্রেরণে বেশ ত্রুটি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আমাদের টোকাইরাও যথেষ্ট সচেতন। তারা পথে-ঘাটে থাকে, হরতাল ও আন্দোলনের সময়কার ঘটনাবলির সঠিক তথ্যও তাদের বেশ মনে থাকে। সন্ধ্যায় কোনো দোকানে বা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে তারাও বিবিসি শোনে। খবর পরিবেশনে একটু এদিক-সেদিক হলেই তাদের ছোট মনটা দারুণভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়।
প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বিদেশী সাংবাদিক বা পর্যটক দেখলেই তাদের প্রশ্ন করে, ‘আপনি মার্ক টালী? ক্যামেরা আছে? সাংবাদিক? আপনাকে যিনি প্রশ্ন করেছিলেন সে বেচারা সাংবাদিকও তাদের হাতে পড়ে নাজেহাল হতে হতে বেঁচে যান। সেবার টোকাইদের এ ঘটনা বহু সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছিল। বোধ হয় সেজন্যই তিনি প্রশ্নটি করেছিলেন, মিছিলে বাচ্চাদের কেন ব্যবহার করি। আমি তাকে আমার যে উত্তর জানা ছিল ব্যাখ্যা করে বোঝাবার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রশ্নটা আমার মনেও থেকে যায়। বারবার ঘুরেফিরে আসে। কেন এই শিশুরা রাস্তায়? এদের নাম কেন হলো টোকাই? এদের জন্ম, বেঁচে থাকা, ভবিষ্যৎ সব কিছু আমার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই শিশুরা কোথা থেকে এলো? কেনই বা এরা রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে? স্বাধীনতার ১৭ বছর পরও এদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি কেন? বরং দিনের পর দিন সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থার অবনতি ঘটছে। এর জন্য কে বা কারা দায়ী? কেন? রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে যারা যুক্ত সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, বুদ্ধিজীবী, সমাজের যে যেখানে অবস্থান করছেন, যখনই সুযোগ পাচ্ছেন তখনই বলছেন, ‘শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ’ কিন্তু এই শিশুরা, যাদের জন্ম বেঁচে থাকা, বড় হওয়া সবই ফুটপাতে, ডাস্টবিনের ধারে, তাদের ভবিষ্যৎ কি?। টোকাই! ওরা মিছিলে যায়, প্রতিবাদ জানায়-কিন্তু কিসের মিছিল, কেন প্রতিবাদ, তারা কি কিছু বোঝে? না, বোঝে না। ওরা যেভাবে বেঁচে আছে সেভাবেই নিজেদের ভাগ্যকে মানিয়ে নিয়েছে। তবু ওদের বুকের ভেতর, মনের অগোচরে আছে এক প্রতিবাদের ঝড়। সে ঝড়কে সঠিকভাবে না জানলেও ওরা এটুকু জানে কোথাও একটা অন্যায় রয়েছে, যার প্রতিবাদ করতে হবে। মিছিলে যোগ দিতে হবে। প্রতিবাদের মিছিল পেলেই ওরা শরিক হয়।
ভাষা নেই, শিক্ষা নেই, অবুঝ মন। কোনো গাড়িতে দামী কাপড় পরা ঝকঝকে তকতকে সমবয়সী শিশুমুখ কি ওদের মনে কোনো প্রশ্ন জাগায় না? গাড়ির ধুলো ঝেড়ে একটি বা দুটি টাকার জন্য তা শীর্ণ হাত হয়তো বাড়িয়েছে সে হাত খালি আসবে না ভরে আসবে তা সে জানে না। মলিন মুখ নিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাওয়াই ওদের রীতি, ওরা এটুকুই জানে। তবু ঐ ক্ষুদ্র অবচেতন মনে কখনো কি একবারও প্রশ্ন জাগে না-এই কী জীবন? একেই কি বলে বেঁচে থাকা? কোনো অবস্থাপন্ন ঘরে যদি জন্ম হতো তবে ঐ গাড়িতে ওরা কেউ থাকত আর গাড়ির কাঁচের ফাঁকের শিশুমুখটি রাস্তায় থাকত, যদি এমন হতো? বিদেশী সাংবাদিকের মনে প্রশ্ন, ওরা রাস্তায় কেন? আমার মনেও একই প্রশ্ন ওরা রাস্তায় কেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে সমাজের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রথমে যদি আমরা দৃষ্টি ফেলি আমাদের সামাজিক অবস্থার দিকে, তাহলে দেখতে পাব গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু এমন এক সামাজিক পরিবেশে বাস করছে যে সমাজ দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন, আধা-ঔপনিবেশিক ও সামন্ত শাসনের বন্ধনে আবদ্ধ। এই সমাজ ব্যবস্থার অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণের শিকার গ্রামবাংলার নিম্নবর্ণের মানুষরা। এই সমাজের সর্বত্র রয়েছে শাসক ও শোষকের অন্যায়-অবিচারের ছাপ। এখানে কোনো বিচার নেই, নীতি নেই, আচার নেই- ‘জোর যার মুলুক তার।’ প্রতিবাদের কণ্ঠকে সবসময় অঙ্কুরেই বিনষ্ট করবার প্রচেষ্টা ছিল। আবহমানকাল ধরে। তাই তেমন কোনো প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠলেও সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়নি। কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতে বার বার মার খেয়েছে এইসব মানুষ।
এ সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও নির্যাতিত মেয়েরা। ধর্মীয় কুসংস্কার, অশিক্ষা এদের ওপর অবিচার-অনাচার বাড়িয়েছে, অর্থনৈতিক অবরোধ আরো অসহায় করে তুলে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। এদের সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। একটি পরিবারের একমাত্র অবলম্বন সে পরিবারের পুরুষ সদস্য। বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রীপুত্র, কন্যা ও ভাইবোন সবার ভরণ-পোষণ দায়দায়িত্ব অর্থ উপার্জনের একমাত্র সম্বল পুরুষটি। সংসারের বাকি কাজের দায় স্ত্রীর। আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামের পুরুষ ও নারীর তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সে স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। বেশির ভাগ পুরুষ টিবি রোগে আক্রান্ত হয় অথবা গ্যাস্ট্রিক বা আমাশয়ে ভুগে অকালে মারা যায়। তার পরিবারটিও ভেসে যায়। গ্রামে ভূমি-বসতহীন ছিন্নমূল পরিবারের জন্য কাজের বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকে না। ফলে বিধবা স্ত্রী-সন্তানসহ শহরমুখী হতে বাধ্য হয়।
বিয়ের ব্যাপারেও সমস্যা রয়েছে। মুসলিম পরিবারে বিবাহ বা তালাক দেয়ার যে নিয়ম গ্রামে প্রচলিত তাও ত্রুটিপূর্ণ। রাগের মাথায় স্ত্রীকে তিন তালাক বলার সাথে সাথে তালাক হয়ে যাবার নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীরা মা হয়ে সন্তানদের ফেলে যেতে পারে না। শহরে গিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে, কিন্তু এই সমাজ তাদের বাঁচার পথ দেখায় না, দায়-দায়িত্ব নেয় না; বরং পতিতালয়ে স্থান করে নিতে বাধ্য করে। আর ‘স্বর্গের দূত’ নামে অভিহিত নিষ্পাপ শিশুরা স্থান পায় রাস্তায়। তাদের পরিচয় হয় ‘টোকাই’।
অনেক ক্ষেত্রে একই পুরুষকে একাধিক বিয়ে করতে দেখা যায়। ধর্মে আছে চার বিয়ে করা যাবে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতা খোঁজ-খবর নেবার প্রয়োজনও মনে করে না। হাতে একজোড়া ইলিশ মাছ ও এক ডজন কাচের চুড়িই বিয়ের জন্য অনেক মূল্যবান সামগ্রী। এ গ্রামে এক বিয়ে তো সে গ্রামে এক বিয়ে। এভাবে চারের অধিক বিয়েও করে যাচ্ছে। বিয়ের পর স্বামীর ঘরেও অনেককে নেয়া হয় না। বিবাহিতা বা তালাকপ্রাপ্ত নারী বাবা বা ভাইদের সংসারে সব স্থান পায়। তখন বাধ্য হয়ে ভাগ্যান্বেষণে সন্তানের হাত ধরে বের হতে হয়। অভাবের সংসারে কে কার দায়িত্ব নেবে? গৃহপরিচারিকার কাজ করলেও নিস্তার নেই। গৃহকর্তার চোখে পড়লে লাঞ্ছিত অপমানিত হতে হয়। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াটাই কি অভিশাপ? তার প্রতি কেন মর্যাদা ও মমত্ববোধ থাকবে না?
আমার প্রত্যক্ষভাবে জানা একটি ঘটনার কথা বলি। আমাদের গ্রামের বাড়ি টুঙ্গীপাড়ায় জুলেখা নামের একটি মেয়ে আছে। আমাদের পাকের ঘরের পেছনের একটি ঘরে তার মায়ের সাথে থাকত। ছোটবেলা থেকেই ওকে আমরা জানি। ওর মা আমাদের বাড়িতে থালাবাসন ধোয়া ও পানি তোলার কাজ করত। জুলেখাও মা-বোনের সাথে কাজ করত। মাঝে মাঝে সাত-আট মাসের ভরাপেট নিয়ে বৃষ্টিকাদার মধ্যেও কলসি কাঁখে পানি বয়ে আনত। গ্রামীণ সমাজে এটা অপরাধ বা দৃষ্টিকটু নয়।
সেবার সকলে মিলে গ্রামের বাড়িতে যাই। দেখি জুলেখা আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। জানতাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে ভিন গাঁয়ে। কিন্তু এখানে কেন? তার উপর সাত-আট মাসের বাচ্চা পেটে আর সেই অবস্থায় ছোটাছুটি করে কাজ করছে। ব্যাপারটা আব্বারও নজরে পড়ে, ‘এ শরীরে ওকে দিয়ে কাজ করান হচ্ছে কেন?’
ওর প্রকৃত অবস্থাটা আব্বাকে জানালাম। মাস দুই আগে ওর স্বামী ওকে তালাক দিয়েছে। আব্বা বললেন এ অবস্থায় তো তালাক হয় না! গ্রামের অশিক্ষিত সরল সাধারণ মেয়ে এসবের কিছুই জানে না। কতইবা বয়স, আঠারো-উনিশ হবে। একটি মেয়ে আছে, মাঝখানে আরো একটি সন্তান মারা গেছে। যতবার সে সন্তানসম্ভবা হয়, স্বামী ওকে ফেলে রেখে চলে যায়। খেতে পায় না, এখানেই আশ্রয় নেয়। ওর স্বামী-শাশুড়িকে খবর দেয়া হলো, ওরা এলো না। পরে পুলিশ পাঠিয়ে ধরে আনা হলো। ওর স্বামী ওর কাছে মাফ চাইল এবং ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। প্রায় পনেরো-ষোলো বছর আগের ঘটনা। সুখের কথা, এখন ওর স্বামী ঠিক আছে। ঐ ঘটনার পর আর তালাক দেয়নি, অন্য বিয়েও করেনি। যদি আমাদের আশ্রিত না হতো তাহলে ঐ মেয়েটিকেও হয়তো বেঁচে থাকার তাগিদে সন্তানের হাত ধরে শহরমুখী হতে হতো। শহরে এসে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় না পেলে অমানুষের হাতে পড়ে হয়তো পতিতালয়েই আশ্রয় নিতে হতো। তারপর সেখানকার অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে রোগগ্রস্ত হয়ে অকালমৃত্যু বরণ করত। আর ওর সন্তানরাই হতো টোকাই।
সামাজিক নিরাপত্তার অভাব থাকায় নানাভাবে আরো পরিবার নির্যাতিত হয়ে শহরমুখী হয়। সাংসারিক প্রয়োজনে মহাজনের কাছ থেকে বা গ্রামের সুদখোর অবস্থাপন্নদের কাছে জমিজমা, বসতবাড়ি, ঘটিবাটি বন্ধক রেখে টাকা নেয়। অশিক্ষিত কৃষক টিপসই দিয়ে সামান্য টাকার বিনিময়ে জমি বন্ধক রেখে সর্বস্বান্ত হয়। খরা বন্যা নদীভাঙনে ঘরবাড়ি জমিজমা সব নিঃশেষ হয়েও অনেক পরিবার শহরবাসী হয়ে একই অবস্থার শিকার হয়। সরকারি সাহায্যসহযোগিতা এরা পায় না। উপরন্তু করের বোঝা, অনাদায়ী ঋণ, সুদ খাজনা আদায়ের নামে ক্রোকি পরোয়ানা ও সরকারি অত্যাচারে বহু পরিবার ছিন্নমূল হয়ে শহরবাসী হতে বাধ্য হয়, ধ্বংস হয়ে যায়। এর মধ্যে যারা সংগ্রাম করে বাঁচতে পারে অর্থাৎ জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে তাদের সংখ্যা নগণ্য। এভাবে চলছে সমাজের সর্বস্তরে চরম অনিয়ম, অরাজকতা। দুর্বলের উপর সবলের আঘাত, নিম্নস্তরের উপর উচ্চস্তরের কষাঘাত, শোষিতের উপর শাসক ও শোষকের সীমাহীন পীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিতদের আধিপত্য অনেক পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়।
তাদের সন্তানদের টোকাই বানিয়ে রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেয়। এভাবে বিদ্যমান নানা আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে আমাদের দেশের শিশুরা টোকাই-তে পরিণত হয়।। এই রাজধানী ঢাকা শহরে পাঁচ লাখেরও বেশি টোকাই আছে। ফুটপাত, রেল স্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল, বস্তি এদের আশ্রয়স্থল। কোনো গভীর রাতে যদি কেউ শহরে বের হন তবে দেখবেন এরা কিভাবে ঘুমায়, কিভাবে আশ্রয় খোঁজে অন্ধকার নির্জনতায়। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, চট বা খবরের কাগজ জোগাড় করে কোনোমতে তার ওপর শুয়ে শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস কাটিয়ে দেয়। শীতের রাতে আবর্জনার ভেতর থেকে কাগজ সংগ্রহ করে। আগুন জ্বেলে শরীর গরম করে। কনকনে ঠাণ্ডা বাসাতে একে অপরকে জড়িয়ে, কখনো কুকুর-বেড়ালের পাশে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেয় মানব সন্তান-স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব। অনাহার আর অপুষ্টি অকালে এদের জীবনদীপ নিভিয়ে দেয়। দশ-পনেরো বছরের বেশি এরা পৃথিবী দেখতে পায় না। নগণ্য অসংখ্য যৌবনের মুখ দেখতে পেলেও পঁচিশ তিরিশ বছরের বেশি বাঁচে না। ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাতে হয় বলে এদের শরীরের ভেতরটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। অকালবার্ধক্য ও মৃত্যু অগোচরে গ্রাস করে এদের জীবন। এদের নাম-ঠিকানা নেই। বাবামায়ের পরিচয় নেই। ক্ষুন্নিবৃত্তিই বড় কথা।
জীবন প্রদীপ প্রজ্বলিত রাখার তাগিদে প্রতিনিয়ত এরা যুদ্ধরত। জীবনের কোনো অর্থ নেই। এদের প্রতি মমতা ও সহানুভূতিতে ফুটপাতের দোকানদার অথবা কোনো পথিক কখনোবা ছুঁড়ে দেয় এক টুকরো কাপড় লজ্জা নিবারণের জন্য। হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাদ্য, বিয়েবাড়ি বা পিকনিক পার্টির উচ্ছিষ্ট, ডাস্টবিনে ফেলা পচা-বাসি খাবারই এদের পেটের জ্বালা মেটায়। কারোর বাড়ির ছেঁড়া লুঙ্গি বা প্যান্ট ভাগ্যে থাকলে জুটে যায়। পেট ফোলা, রুগ্ন হাড্ডিসার শরীরের এইসব শিশুরা অসুখে কোনো চিকিৎসা পায় না। গ্রীষ্ম বর্ষা শীত সবই এদের অর্ধনগ্ন ছোট্ট শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এদের জন্ম যেমন জানান দিয়ে আসে না, মৃত্যুর খবরও কেউ রাখে না।
আবার জুলেখার কথায় ফিরে যাই। একটি মেয়ের জীবন ও পরিবারকে মডেল হিসেবে ধরলে গ্রামবাংলার হাজার হাজার পরিবারের চিত্র আমরা দেখতে পাব। গত কয়েক বছর গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে অনেক ঘুরেছি। সর্বত্রই দেখেছি জুলেখাদের একই চেহারা, একইভাবে নির্যাতিত। এ পর্যন্ত জুলেখা দশ থেকে বারোটি সন্তানের মা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র পাঁচটি সন্তান জীবিত, বাকি সবারই অকালমৃত্যু ঘটেছে। যখনই গ্রামের বাড়িতে যাই রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট ঘরটায় শিশুর কান্না শুনলেই বোঝার বাকি থাকে না যে জুলেখা আবার মা হয়েছে। আমরা দেশে যারা থাকি টুকটাক কাজ করে দেয়। ওর বয়স এখন খুব বেশি হলে একত্রিশ বা বত্রিশ বছর। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। বছরের পর বছর সন্তান জন্ম দেবার ধকল শরীর সইতে পারেনি। তার ওপর অভাব-অনটন-অপুষ্টিতে শরীরের অবস্থা বর্ণনাতীত।
পরিবার পরিকল্পনার প্রচার টেলিভিশন-রেডিওতে সীমাবদ্ধ থাকায় জুলেখার মতো মেয়েরা এর প্রয়োজনীয়তা জানে না, বোঝে না। যে শ্রেণী টেলিভিশন-রেডিও কিনতে, দেখতে এবং শুনতে পারে তারা সমাজের অংশ। তাদের কাছে প্রচারের কি প্রয়োজন আমার বোধগম্য নয়। বরং গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রচারণা চালালে অনেক কাজে লাগত।
এই পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে জুলেখার অভিমত তুলে ধরছি। যতবার গ্রামে গিয়েছি অথবা ওকে আমাদের শহরের বাড়িতে নিয়ে এসেছি বোঝাবার চেষ্টা করেছি পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা। ওর উত্তর পরিষ্কার ‘মছলায় কয়না আল্লায় ব্যাজার হইবে’ ‘আল্লায় মুক দেছে আল্লায় খাওয়াইবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
মছলায় কয় না, অর্থাৎ মৌলভি সাবরা যখন ওয়াজ-নসিহত করেন তখন এর বিরুদ্ধে প্রচার হয়। তাঁদের মতে এটা ধর্মবিরোধী, খোদার উপর খোদগারী, ইত্যাদি।
জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে মত পোষণের আরো একটা কারণ হলো সামাজিক নিরাপত্তার অভাববোধ, সন্তান বেশি হলে হাতের কাজে সাহায্য পাওয়া যাবে। বিশেষ করে ছেলে হলে বৃদ্ধ বয়সে এক ছেলে যদি না দেখে তো অন্য ছেলে দেখবে। যতদিন ‘রতে (শ্রম দেয়ার শক্তি) বল আছে ততদিন খাইটা খাব, যহন রত পইড়া যাবে তখন কে দ্যাখবে?’ (সংকলিত)