বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কি সা¤প্রদায়িক? তারা ধর্মভীরু, যে ধর্মেরই হোক না কেন, প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্মচর্চা করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু তারা কি সাম্প্রদায়িক হামলার মতো সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত? বাংলাদেশের মানুষ কি এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার হরণ করতে তৎপর? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর কিছুটা জটিল হয়ে ধরা দেয় আমাদের সামনে।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায্য শাসন, একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিপরীতে গিয়ে এক গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল এ দেশের মানুষ। সেই মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকের ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে অসা¤প্রদায়িক ঐক্যের রাজনীতি তুলে ধরেছিল বাংলাদেশের জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের পরও দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে জনগণ এগিয়ে এসেছে সম্মিলিতভাবেই, কোনো সাম্প্রদায়িক চেতনা সেই একতায় চিড় ধরাতে পারেনি। ঈদ কিংবা দুর্গাপূজার মতো বৃহত্তর উৎসবগুলোতে সবার শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণ চলে আসছে বহুকাল ধরে। অথচ আজ যখন আরেকটি দুর্গাপূজা এসেছে, তখন যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িক হামলার আশঙ্কা। কিন্তু কী কারণে এমন পরিবর্তন? কেন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক জনগণের কপালে জুটছে সা¤প্রদায়িক হামলাকারীর তকমা?
সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনে কারা
২০২১ সালের মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লায় ইসলাম ধর্মের অবমাননার অভিযোগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে হামলা করা হয়। প্রথমে আওয়ামী লীগ সরকারের তরফ থেকে এর সাথে হেফাজতে ইসলামের কর্মীসহ সাধারণ মানুষের যোগসাজশের কথা উল্লেখ করা হলেও পরে বেরিয়ে আসে- ওই হামলার মূল হোতা ছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম স্বাধীন। আর হামলার মূল কারণ, কোনো সাম্প্রদায়িক উসকানি ছিল না, ছিল ‘জলমহাল’ নামে ইজারাকৃত দীঘির দখল-সংক্রান্ত বিরোধ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুবলীগ সভাপতি স্বাধীনকে আটক করা হলেও কিছু দিন পর ২০২১ সালের ২১ জুন তাকে জামিন দিয়ে দেন আদালত।
শুধু শাল্লা নয়, বিগত ১৩-১৪ বছর ধরে বাংলাদেশে নিয়মিত বিরতিতে যেসব সা¤প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে, তার প্রতিটির পেছনেই এমন জমি দখল, লুটপাট ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধ কারণ হিসেবে কাজ করেছে। ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। সেই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখল ও নির্যাতন চালিয়ে উচ্ছেদের ঘটনা তুলে ধরে। মজার ব্যাপার হলো, এই নির্যাতন ও দখলের কারণ হিসেবে বাংলাদেশের কোনো সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে দায়ী করেনি সংগঠনটি। এর প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে দায়ী হিসেবে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম প্রকাশ করে। তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় সংসদের হুইপ মাহবুব আরা গিনি, ঠাকুরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম ও পিরোজপুরের সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল। এদের মধ্যে তিনজনই পরবর্তীতে ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছেন এবং এম এ আউয়াল এখনো পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে হামলার ঘটনার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বিচার অধরা। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে সেই হামলার ঘটনায় অভিযুক্তদের বর্তমান অবস্থা জানলে। গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ওই ঘটনার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও সাক্ষীরা ভয়ে রয়েছেন, যেতে পারছেন না সাক্ষ্য দিতে। সরকার কিংবা প্রশাসনের তরফ থেকে তাদের নিরাপত্তা ও আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এমন অবহেলার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, আসামিরা রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের ছত্রছায়ায়। সংসদ সদস্যের ভাইও এই একই অভিযোগ তুলেছেন।
আবার ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে আটটি হিন্দু পাড়ায় প্রায় ৩০০ ঘরবাড়িতে যে ভয়াবহ হামলা করা হয়, তার নেপথ্যেও ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর পুরস্কার হিসেবেই হয়তো বা ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ওই হামলার চার্জশিটভুক্ত তিন আসামিকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এখানে উল্লেখ যে, ওই ঘটনাগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের ১৪ বছরের শাসনামলে ঘটা অসংখ্য ঘটনার মধ্যে মাত্র কয়েকটি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে তিন হাজার ৬৫৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত বছরের দুর্গাপূজাতেই প্রায় ৭০টি মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এটি অনুমান করা অসম্ভব হবে না যে, ওই হামলাগুলোর বেশির ভাগের সাথেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের জমি দখল এবং লুটপাটের মনোবাসনা জড়িত।
সরকার, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের দায়
কিছু দিন পরপরই হয়ে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা রুখতে দেশের পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো। কারণ, গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হামলার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে এগুলোর মধ্যে কিছু আশ্চর্যজনক মিল পাওয়া যায়। প্রথমেই ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলাম ধর্মের অবমাননার অভিযোগ ওঠে। এরপরই ওই অভিযোগ নিয়ে আইনি আশ্রয় নেয়ার বদলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালায় কিছু মানুষ। হামলার শিকার ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বারবার পুলিশ-প্রশাসনের কাছে সাহায্যের আবেদন করা হলেও বেশির ভাগ সময়ই সেই সাহায্য হামলার আগে এসে পৌঁছাতে পারে না; বরং হামলার পর মামলায় জড়ানো হয় বিরোধী দল ও মতের মানুষকে। কিন্তু তদন্ত এগোলেই বেরিয়ে পড়ে প্রকৃত সত্য। হামলায় জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাঁচাতে তখন পুরো মামলাটিই চলে যায় হিমাগারে। গত ১৩-১৪ বছর ধরে একই কায়দায় একই চিত্রনাট্যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চলছে।
প্রশ্ন ওঠে, হামলার আশঙ্কা থেকে যখন পুলিশ-প্রশাসনের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন এগিয়ে আসে না তারা? কেন হামলার পর এর মূল হোতাদের গ্রেফতারে তৎপর হয় না পুলিশ? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে বিরোধী মত ও জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হলেও কেন সাম্প্রদায়িক উসকানি রুখতে তা ব্যবহার হচ্ছে না? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর একটাই- সরকারের সদিচ্ছার অভাব। এতগুলো হামলার পরও দোষীদের বিচারের আওতায় না আনা, দোষীদের দলীয় মনোনয়ন দেয়া, জমি দখলে যুক্ত সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়াই প্রমাণ করে- দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বন্ধ হোক, তা আওয়ামী লীগ সরকার চায় না। কেন চায় না, এরও উত্তর আছে। পরপর দু’টি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা দলটি তৃণমূল নেতাকর্মীদের জমি দখল ও লুটপাটের সুযোগ করে দিতে চায় এর মাধ্যমে। সাথে দেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সাথে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায় তারা, একনায়কতন্ত্র দীর্ঘায়িত করতে চায়।
প্রশাসনের তরফ থেকেও সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে তদন্ত ও দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। যদি তা দেখা যেত, যদি রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ কিংবা নড়াইলের ঘটনার বিচার হতো, তাহলে দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিছুটা হলেও নিরাপদ বোধ করত। কিন্তু প্রশাসনের ব্যাপকভাবে দলীয়করণের কারণে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের প্রত্যাশাও কমে গেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে।
দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে খোদ সরকারের এমন অপপ্রচেষ্টার পরও দেশের নাগরিক সমাজের একটি অংশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষের একমাত্র শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক প্রচারণা, তার পক্ষে রসদ জোগায় নাগরিক ও সুশীলসমাজের এই নীরবতা। দেশের যেকোনো প্রান্তে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হলেই বিএনপি ও অন্য বিরোধীদলসহ দেশের ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দায় চাপানো এই গোষ্ঠীটি প্রকৃত তথ্য নিয়ে খুব বেশি সোচ্চার নয়। যদি তারা সোচ্চার হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এসব ভয়াবহ হামলার বিষয়ে দলটির উচ্চ পর্যায়কে জবাবদিহি করতে বাধ্য করত তারা। কিন্তু এখনো আমরা দেখি, ঘুরেফিরে বিরোধীদের ওপর দায় চাপানোর যে রাজনৈতিক কৌশল আওয়ামী লীগের আছে, সেই কৌশলেরই অন্ধ অনুকরণ করে চলেছেন সুশীলসমাজের একটি অংশ। পাশাপাশি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদেরও পরোক্ষভাবে এসব হামলার জন্য দায়ী করে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করাতে ভূমিকা রাখছেন তারা। কিন্তু সুশীলসমাজ হিসেবে প্রকৃত সত্য উন্মোচন এবং তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরকারকে জবাবদিহি ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাধ্য করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভবিষ্যতে তারা তাদের সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে আশা করে দেশের জনগণ।
ইতোমধ্যে চলে এসেছে আরেকটি দুর্গাপূজা। গত বছরের দুর্গাপূজায় দেশজুড়ে হামলার ক্ষত এখনো শুকায়নি। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এই ব্যথায় আজও ব্যথিত। কিন্তু ভূমিদস্যু ও হিন্দু সম্পত্তি দখলদারদের সরকারি প্রভাব এবং ক্ষমতার কাছে এই সাধারণ মানুষ অসহায়। তাই যেকোনো বিশৃঙ্খলা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে দেশের প্রশাসনকেই। সন্ত্রাসী, দখলদারদের রাজনৈতিক পরিচয় আমলে না নিয়ে তাদের সুষ্ঠু বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। একই সাথে এর আগে সংখ্যালঘুদের ওপর হওয়া প্রতিটি হামলারও সুষ্ঠু বিচারকাজ ত্বরান্বিত করতে হবে। নইলে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় হওয়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা শুধু বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদাই নষ্ট করবে না, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশী নাগরিকদের ব্যাপারেও দেশ-বিদেশে ভুল ধারণা সৃষ্টি করবে। এগুলো রুখে দিয়ে আবারো উৎসবমুখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করুক আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনেরা- এমনটাই প্রত্যাশা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের।