দুর্ঘটনা ছাড়া মানুষ সাধারণত দুই ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সংক্রামক যা রোগজীবাণু থেকে হয় এবং অসংক্রামক রোগ যা জীবনযাত্রার পরিবর্তন, বংশগত কারণ ও অস্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে হয়ে থাকে। অসংক্রামক রোগের সুবিধা হলো ধোঁয়া দেখে যেমন আমরা কোথাও আগুন লাগার বিষয়টি বুঝতে পারি, তেমনি অসংক্রামক রোগ পুরোপুরি প্রকাশ পাওয়ার আগে এমন কিছু চিহ্ন প্রকাশ পায় যা থেকে বোঝা যায়, নির্দিষ্ট রোগে সে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস প্রকাশ পাওয়ার আগে এমন কিছু চিহ্ন প্রকাশ পায়। ডায়াবেটিসের সেসব লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমরা ডায়াবেটিস থেকেই মুক্ত থাকতে পারি। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে ৭৫ শতাংশই পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ ডায়াবেটিসে রূপ নেয়। ডায়াবেটিসের লক্ষণ যেটিকে প্রি-ডায়াবেটিস বলা হয়- সেটি এক গুরুতর স্বাস্থ্যগত অবস্থা, যেখানে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, কিন্তু টাইপ-২ ডায়াবেটিস হিসেবে নির্ণয় করার মতো এখনো যথেষ্ট নয়।
ডায়াবেটিস হলো নীরব ঘাতক আর প্রি-ডায়াবেটিক কন্ডিশন হলো অনেকটা গুপ্তচরের ভ‚মিকার মতো। দিনের পর দিন রক্তের ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল প্রি-ডায়াবেটিক কন্ডিশনে থাকার একপর্যায়ে আপনি পূর্ণাঙ্গ ডায়াবেটিস রোগী হয়ে যান। প্রি-ডায়াবেটিক কন্ডিশনকে রুখতে হলে স্বাস্থ্যকর ও কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রোটিন, ভালো ফ্যাট এবং নিয়মিত শরীরচর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রি-ডায়াবেটিক রোগী নিয়ে বাংলাদেশে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও সংখ্যাটি যে আমেরিকানদের তুলনায় আনুপাতিক হারে বেশি হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাদের প্রি-ডায়াবেটিস আছে, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি জানেন না যে, তাদের এটি আছে। বাংলাদেশে ২০১১ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী ছিল ৮০ লাখ। ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ১০ লাখ; এখন এ সংখ্যা দেড় কোটি প্রায়। ডায়াবেটিক রোগীদের ৩০-৪০ শতাংশ আলটিমেটলি ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগী হয়ে যায় যার জন্য প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিস বা ট্রান্সপ্লান্টেশন এবং যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
প্রি-ডায়াবেটিসের অন্যতম লক্ষণ হলো- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থাকা। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স আছে কি না বোঝার দু’টি উপায় আছে। একটি হলো- ফাস্টিং ব্লাড ইনসুলিন লেভেল নরমালের চেয়ে বেশি উপরে থাকা। আর রক্তে হিমোগ্লোবিন এ১সি-এর লেভেল বেশি পারসেন্টেজে থাকা। পরীক্ষাটি হিমোগ্লোবিনের সাথে অ্যাটাচড গ্লুকোজের পরিমাণ এবং গেল তিন মাসের গড় ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল নির্দেশ করে। সাধারণত এই লেভেল ৫.৭-৬.৫ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থাকলে আমরা প্রি-ডায়াবেটিক ও এর উপর লেভেলে থাকলে ডায়াবেটিস বলি। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের হিমোগ্লোবিন এ১সি-এর লেভেল সাতের নিচে রাখা উচিত। সিডিসির সুপারিশ অনুযায়ী, এ জন্য আদর্শ অভ্যাস হলো ৪৫ বছর পর প্রতি নরমাল ব্যক্তিই তিন বছর অন্তর এই টেস্ট করিয়ে নেবে। আর যাদের আগের টেস্টে প্রি-ডায়াবেটিক ছিল তাদের পরীক্ষা করতে হবে এক-দুই বছর অন্তর। ডায়াবেটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর যেমন- ওভার ওয়েট, উচ্চরক্তচাপ, হার্ট ডিজিজ ও ফিজিক্যাল ইনেক্টিভিটি ইত্যাদি যাদের মধ্যে আছে তাদেরও উচিত ডাক্তারের নির্দেশমতো টেস্ট করিয়ে নেয়া। এ ছাড়াও যাদের মধ্যে এখনই ডায়াবেটিসের উপসর্গ যেমন- পিপাসা কিংবা ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া, প্রস্র্রাবের পরিমাণ ও ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা এবং বেশ দুর্বল অনুভব করা ইত্যাদি থাকলে উচিত পরীক্ষা করিয়ে নেয়া। তবে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে, রক্তশূন্যতা রোগ বা অন্য যেকোনো ধরনের ব্লাড ডিজঅর্ডার ও শিশুদের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা তেমন কার্যকর নয়। পূর্ণাঙ্গ আকারে ডায়াবেটিস প্রকাশ পাওয়ার আগে শরীরে এমন কিছু চিহ্নিত পরিবর্তন ঘটে যাতে করে আমরা সহজেই শনাক্ত করতে পারি প্রি-ডায়াবেটিক কন্ডিশন।
এই চিহ্নগুলো শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলে সহজেই ডায়াবেটিসের মতো নীরব ঘাতক রোগের মারাত্মক ঝুঁঁকি থেকে বাঁচতে পারি। প্রি-ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা এই জন্য জরুরি যে, একবার ডায়াবেটিস হলে এবং পরপর পাঁচ বছর নিয়ন্ত্রণ না করলে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের ক্রনিক কিডনি ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করলে সারা জীবন ভালো থাকা যায়, কিন্তু এই সমস্ত রোগ নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে একবার যদি ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হয়ে যায় তাহলে শত চিকিৎসায়ও ভালো করা যায় না। চিকিৎসা করে শুধু একটু আরাম দেয়া যায়। এ জন্যই প্রি-ডায়াবেটিক রোগীদের সময়মতো শনাক্তকরণ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অন্যান্য কার্ডিওভাস্কুলার রোগ এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রি-ডায়াবেটিস পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা রোগ বা রিভার্সিবল ডিজিজ। তাই এই কন্ডিশনের উপসর্গ দেখে আগেভাগেই শনাক্ত করা জরুরি।
প্রথম চিহ্ন : ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল অব্যাহতভাবে নরমালের চেয়ে বেশি থাকা।
দ্বিতীয় চিহ্ন : ফাস্টিং ইনসুলিন লেভেল বেড়ে যাওয়া।
তৃতীয় চিহ্ন : খাবার পর দুর্বল বোধ করা। যাদের প্রি-ডায়াবেটিক কন্ডিশন নেই তারা খাবারের পরপর তেমন কোনো দুর্বলতা বোধ করেন না। কিন্তু প্রি-ডায়াবেটিক কন্ডিশনে পৌঁছে যাওয়া রোগীরা খাবার পরপর নিজেদের শক্তিশালী না ভেবে বরং ঘুম ঘুম ভাব ও অনেক দুর্বল মনে করে। এ অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া মানে আপনি প্রি-ডায়াবেটিক ফেজে পৌঁছে গেছেন।
চতুর্থ চিহ্ন : কোথাও কেটে গেলে সহজে শুকায় না। রক্তের ঘনত্ব ও প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে শরীরের টিস্যুগুলো প্রয়োজনীয় খাবার পায় না, ফলে ঘা শুকাতে দেরি হয়।
পঞ্চম চিহ্ন : ব্লাড সার্কুলেশন কম হওয়ার কারণে হাত-পা ও সারা শরীরে অসারতা এবং শক্তিহীন অনুভব করা। ব্লাড সার্কুলেশন কম হওয়ার অন্যতম কারণ হলো- রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকার কারণে এবং তার চাপে রক্তনালীর বাইরে এসে আরো পানি আটকে ধরে ফুলে যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে পায়ে পচন ধরে ও পা কেটে ফেলতে হয়। ডায়াবেটিসই বর্তমানে অকালে পা কেটে ফেলার প্রধান কারণ।
ষষ্ঠ চিহ্ন : কিডনি রোগ ধরা পড়া। ম্যাক্রোভেসেল ডিজিজ। তবে প্রি-ডায়াবেটিক স্টেজে সাধারণত ঘন ঘন প্রস্রাব হয় না। কারণ ঘন ঘন প্রস্রাব হতে গেলে কিডনি দিয়ে রক্ত ফিল্টারিংয়ের সময় ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল ১৮০ মিলিগ্রামের বেশি হতে হবে। ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল ১৮০ মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটারের বেশি হলে রেনাল টিউবিউলে গ্লুকোজ চলে আসে এবং টিউবিউলে গ্লুকোজের উপস্থিতির কারণে শরীর থেকে পানি টেনে নিয়ে অধিক প্রস্র্রাবসহ বের হয়ে যায়। তবে গ্লুমেরুলার ইনজুরি হলে ঘন ঘন প্রস্র্রাবের পরিমাণ বেড়ে যায়।
সপ্তম চিহ্ন : রেটিনোপ্যাথি হওয়ার কারণে চোখে ঝাপসা দেখা। অন্ধত্বের জন্য সবচেয়ে বড় এবং নম্বর ওয়ান কারণ টাইপ-২ ডায়াবেটিস। অব্যাহতভাবে ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে থাকার কারণে চোখের লেন্স শুকিয়ে যায়, ফলে ঝাপসা দেখায়। ব্লাড সুগার লেভেল নরমাল হয়ে আবার ঠিক হয়ে যায়।
অষ্টম চিহ্ন : ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল নরমাল থাকলে মানুষের মনোভাব ভালো থাকে; কিন্তু যদি লেভেল অব্যাহতভাবে বেশি থাকে তাহলে এবং আমাদের কোষগুলো ঠিকমতো গ্লুকোজ ব্যবহার করতে না পারার কারণে সবসময় মেজাজ খিটখিটে থাকে।
নবম চিহ্ন : পানির পিপাসা লাগা ও ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা।
দশম চিহ্ন : বারবার প্রস্র্র্রাবের বেগ হওয়া।
একাদশ চিহ্ন : ওজন বেড়ে যাওয়া। বেশি বেশি খেতে খেতে ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণে ডায়াবেটিসও বেড়ে যায়।
দ্বাদশ চিহ্ন : রক্তে চর্বির লেভেল বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল ও এলডিএল বা লো-ডেন্সিটি লাইপোপ্রোটিন লেভেল বেড়ে যাওয়া।
ত্রয়োদশ চিহ্ন : অনেক বেশি বেশি খাবার পরও ওজন কমে যাওয়াও প্রাক-ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম লক্ষণ।
লেখক : স্বাস্থ্যবিষয়ক নিবন্ধকার ও কলামিস্ট