আশঙ্কাজনকভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ। গতিহীন হয়ে পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের উৎসগুলো। হুন্ডি প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরেও বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ডলার সঙ্কটের কারণে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে রফতানি আয়ও কমে গেছে। পাশাপাশি বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের বিদেশী ঋণের ছাড় ও প্রতিশ্রুতিতে পড়েছে ভাটা। বৈদেশিক মুদ্রার উৎসগুলোর এ গতিহীনতার কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার জোগান দিয়ে জ্বালানি তেল, অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটানো হচ্ছে। গত ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয়েছে ছয় বিলিয়ন ডলারের উপরে। আর এ কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিম্নগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল দিন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে নেমেছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব মতে এ রিজার্ভ আরো কমে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার উৎসগুলো সঙ্কোচিত হয়ে আসায় আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নতুন এলসি খুলছে না। যেটুকু খোলা হচ্ছে তাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ায় সামনে পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেবে। ইতোমধ্যে ডাল, চিনি, শিশুখাদ্য যেমন গুঁড়া দুধ ইত্যাদি চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় সামনে রফতানি আয়ের ওপর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স-প্রবাহ : বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্সের মন্থর গতি কাটছে না। এ জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে; কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে প্রবাসী আয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ২৫ দিনে (১-২৫ নভেম্বর) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৫ কোটি মার্কিন ডলার। তবে যে হারে রেমিট্যান্স আসছে তা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে ১৬০ কোটি ডলার পার হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। হুন্ডি প্রতিরোধে ইতোমধ্যে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠন করা হয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের ২৩০ জন বেনিফিশিয়ারির হিসাবের টাকা উত্তোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করে বিএফআইইউ। বলা হয়, ভবিষ্যতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলে হিসাবগুলো খুলে দেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৈধ পথে প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমছে। অর্থনীতির অন্যতম এ সূচকটির নেতিবাচক গতি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে সরকারকে। এমন পরিস্থিতিতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে বিভিন্ন শর্ত শিথিল, চার্জ ফি মওকুফসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও ইতিবাচক সাড়া মিলছে না।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। জুলাইয়ে এসেছিল ২ দশমিক এক বিলিয়ন ডলার, যা ছিল আগের ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ। আগস্টে আসে ২ দশমিক শূন্য চার বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। ওই দুই মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার এসেছিল। চলতি বছরের অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহ গত ৮ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম আসে। চলতি বছরের অক্টোবরে এসেছিল ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। যা গত বছরের অক্টোবরে এসেছিল ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ (১.৬৪ বিলিয়ন) ডলার। এ হিসেবে অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায় প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ।
রফতানি আয়েও ভাটা : রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেক অন্যতম খাত রফতানি আয়ের গতিও মন্থর হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি আয় বাড়লেও পরের দুই মাসে রফতানি আয় কমে গেছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রফতানি আয়ে পবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু সেপ্টেম্বরে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অক্টোবর মাসে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে শিল্প কারখানায় উৎপাদন গত দুই মাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর ওপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে গেছে। সাথে ডলার সঙ্কটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। সব মিলেই রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিদেশি ঋণ ছাড়েও ভাটা : এ দিকে ডলারের সরবরাহের অন্যতম দুটো খাত রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশী ঋণে ছাড় ও প্রতিশ্রুতিতেও ভাটা পড়ে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিদেশী ঋণের অর্থছাড় ২৫ শতাংশ কমে ১৯৭ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। একই সময়ে নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৫ শতাংশ কমেছে। ইআরডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই অর্থাৎ অক্টোবর) বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। অথচ এর আগের বছরের একই সময়ে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছিল ২৭৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত বছরের থেকে প্রতিশ্রুতি কমেছে ৮৫ শতাংশ। গত বছর এ সময় পর্যন্ত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ৬৫ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিলেও এবার দিয়েছে মাত্র পাঁচ লাখ ডলারের। বিশ^ব্যাংক গত বছরের একই সময়ে ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ৫০ কোটি ডলারের। আর এবার দিয়েছে মাত্র ৩০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি আলোচ্য চার মাসে অর্থছাড় হয়েছে ১৯৭ কোটি ডলার। অক্টোবর পর্যন্ত বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় হয়েছে জাপানের কাছ থেকে ৫৮ কোটি ডলার। এর পরই সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে চীন ৪৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। আমেরিকার কাছ থেকে এসেছে ৩৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার, এডিবি দিয়েছে ২৪ কোটি ডলার। রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় হয়েছে আট কোটি ২৮ লাখ ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে ছাড় হয়েছে ১২ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে : ডলারের সরবরাহের উৎসাহগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় আমদানি ব্যয় ডলারের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে প্রায় প্রতিদিনই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে ৬০৫ কোটি ডলার। গতকালও বিক্রি করা হয়েছে ৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। আগের দিন অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর বিক্রি করা হয়েছিল প্রায় ১১ কোটি ডলার এবং ২৮ নভেম্বর বিক্রি করা হয়েছিল ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করায় গতকাল ৩০ নভেম্বর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার মজদু নেমে গেছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। গতকাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার। এর রিজার্ভ এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের ১৬ নভেম্বরে ছিল প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। যদিও আইএমএফের হিসেব অনুযায়ী এ রিজার্ভ এখন ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে।
রিজার্ভ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর আগের মতো সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। এতে ব্যাংকগুলোও পড়েছে বিপাকে। ডলার সঙ্কটের কারণে তারা অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্য আমদানিতে তেমন ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। ব্যবসায়ীদেরকে শতভাগ মার্জিন দিয়ে এলসি খুলতে বলা হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা শতভাগ মার্জিন দিয়েও শুধু ডলার সঙ্কটের কারণে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। এতে পণ্য আমদানি কমে এলেও শঙ্কার বিষয় হলো পণ্যের সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যেই বেশি কিছু পণ্য চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, আমদানি কমে যাওয়ার আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই, আমদানি কমলে রফতানিতেও যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটি ভাবা হচ্ছে না। সামনে পণ্যের সরবরাহের বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।