বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে যত সমস্যা আছে তার মধ্যে এখন সম্ভবত দুর্নীতিই প্রধানতম জাতীয় সমস্যা। দেশের জাতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা বা সাধারণ কথাবার্তা বলতে গেলেও দেখা যায়, বেশির ভাগ মানুষ যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন সেটি দুর্নীতি। দুর্নীতির প্রসঙ্গে অনেকেই রীতিমতো হাহাকার করতে থাকেন এই বলে যে, শুধু এ কারণেই দেশ আজ রসাতলে যাচ্ছে। আমরা পাশ কাটাতে চাইলেও দুর্নীতি যেন নীরব ঘাতকের মতো অলক্ষ্যে থেকে আমাদের অস্তিত্বে আঘাত করে চলেছে। এটি বাংলাদেশের কোনো সাময়িক বা তাৎক্ষণিক সমস্যা নয়; বরং এটি একটি স্থায়ী সমস্যা। বছরের পর বছর আমাদেরই আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আজ বিপুল ডালপালা বিস্তার করে বিশাল মহীরুহে রূপ নিয়েছে এবং এর আগ্রাসী শিকড়ে পুরো জাতির প্রাণরস শুষে নিচ্ছে।
দুর্নীতির কতই না কারণ বিশ্লেষণ করেন আমাদের সমাজতাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞরা। অভাবে স্বভাব নষ্ট এমন আপ্তবাক্যও শোনান প্রায়ই। কিন্তু এখনকার সমাজে দেখা যাচ্ছে, অভাবীরা নয়, যাদের বেশি আছে, যারা বিপুল অর্থের মালিক তারাই আর্থিক লুটপাট ও অন্য নানা ধরনের দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি ডুবে আছে।
সবাই এক উদ্দেশ্যে দুর্নীতি করে না। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের আদর্শহীন বর্তমান সমাজের ভোগবাদী মানসিকতাই যে এ সমস্যার মূল কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে আজ পর্যন্ত দুর্নীতির ছোঁয়া লাগেনি বা দুর্নীতিমুক্ত আছে। সরকারি কি বেসরকারি কোনো খাতই এ থেকে রক্ষা পায়নি। যদি কোনো খাত দুর্নীতিমুক্ত থেকেও থাকে তার অস্তিত্ব হয়তো আমাদের জানা নেই। সব জায়গায় এর ডালপালা ছড়িয়েছে বলেই না বছরের পর বছর আমরা বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা পেয়ে আসছি! ২০১৮ সালেও আমরা দুর্নীতিতে সারা বিশ্বে ১৩তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সেরা হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছিলাম।
কোনো দেশ বা জাতিকে ভেতর থেকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করতে চাইলে সেই দেশে দুর্নীতির বীজ ছড়িয়ে দেয়াই যথেষ্ট। তাহলে সেই জাতিকে দিয়ে যেকোনো অসৎ লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। আর এ দিক দিয়ে আমরা সম্ভবত অনেক এগিয়ে।
বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনা করতে গেলে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে আমরা এক জায়গায়ই আছি। কোনো অবস্থাতেই যেন এসব থেকে পিছিয়ে আসতে পারছি না। অবশ্য দুর্নীতি রোধে আমরা খুব বেশি কিছু করেছি বিষয়টি তেমনও নয় বোধ হয়; বরং নানাভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ই দিয়ে আসছি বছরের পর বছর।
২০১২ সাল থেকে দুর্নীতিতে একটি দেশের অবস্থান চিহ্নিত করতে নতুন স্কেল চালু হয়েছে। বর্তমানে স্কোর নির্ধারণ করা হয় শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে। ২০১২ সালে ১৩তম (২৬), ২০১৩ সালে ১৬তম (২৭), ২০১৪ সালে ১৪তম (২৫), ২০১৫ সালে ১৩তম (২৫), ২০১৬ সালে ১৫তম (২৬), ২০১৭ সালে ১৭তম (২৮) ও সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম (২৬)।
১৮০টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআই ২০১৮ সালের তালিকা প্রকাশ করে। জরিপে শূন্য থেকে ১০০ নম্বরের স্কেলে দেশগুলোকে নম্বর দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে কম নম্বর (১০ স্কোর) পেয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় উঠে এসেছে সোমালিয়ার নাম। তার পরই রয়েছে (১৩ স্কোর) সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদান। তৃতীয় অবস্থানে (১৪ স্কোর) রয়েছে ইয়েমেন ও উত্তর কোরিয়া। ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯ নম্বরে। এর আগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৪৩ নম্বর অবস্থানে। আর সবচেয়ে বেশি স্কোর (৮৮ স্কোর) পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বিবেচিত হয় ডেনমার্ক। কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এর পরই রয়েছে (৮৭ স্কোর) নিউজিল্যান্ড। কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে (৮৫ স্কোর) রয়েছে ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড।
বিশ্বের ১২৯টি দেশে সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে বিশ্বের নতুন পাঁচ ‘স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায়’ বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে।
২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেখানে ‘গণতান্ত্রিক’ কিংবা ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় স্থান পায়নি বাংলাদেশের নাম, যা দেশটির চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টির জানান দেয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির মতে, শুধু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে আসবাব কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে ১৬৯ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। যেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা, প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি ৭৬০ টাকা, কভারসহ কমফোর্টারের দাম ১৬ হাজার ৮০০ টাকা এবং বিদেশী বিছানার চাদর কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৩৬ টাকায়। বালিশকাণ্ডের পর দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের একটি পর্দা ৩৭ লাখ টাকায় কেনা নিয়ে আবারো গণমাধ্যম সরব হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসের শুরুর দিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে সয়াবিন তেলের বাড়তি দাম নিয়ে ১৫ দিনে এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
এদিকে সিলেটের শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (এসএফসিএল) লোহার এক কেজি নাটের দাম কোটি টাকা ও বোল্টের দাম অর্ধকোটি টাকা দিয়ে কেনা হয়। সরকারি অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে এভাবে ক্রয়ের বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। এই হলো বর্তমান বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র। যা বর্তমান সময়ে নিতান্তই সাধারণ অবস্থা। এসব ঘটনা বাংলাদেশে দুর্নীতির মহাসাগরে বয়ে চলা দৈত্যাকার হিমশৈলের ক্ষুদ্র শীর্ষদেশমাত্র। বেশিটাই রয়েছে পানির নিচে অদৃশ্য অবস্থায়।
কোনো দেশের সার্বিক ও সুস্থ উন্নয়নের জন্য দুর্নীতির বেড়াজাল থেকে বের হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতির খবর নেই। এমনকি বিনিয়োগ খাত, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাতও বাদ যায়নি। একটি দেশের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য এটি যথেষ্ট।
বর্তমান সমাজব্যবস্থা অনুযায়ী দুর্নীতিহীন দেশ কল্পনা করা কঠিন। বর্তমানের ভোগবিলাসী চেতনা আমাদের যেন আঁকড়ে ধরে আছে। কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সমাজ থেকে এটি নির্মূল করতে হবে। নিদেনপক্ষে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতেই হবে। আর এর বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য কোনো একা ব্যক্তির কিংবা সংগঠনের একার তৎপরতা যথেষ্ট নয়। দুর্নীতির শেকলে আমরা এমনভাবে বাঁধা পড়ে গেছি যে, এর থেকে মুক্তির জন্য সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কঠোর হস্তক্ষেপ, প্রয়োজন ব্যক্তিপর্যায়ের সহযোগিতা ও জনসচেতনতার। এর সাথে প্রয়োজন যথেষ্ট আইনি ব্যবস্থার। বিদ্যমান আইন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে সমভাবে প্রয়োগ ছাড়া এ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।