মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:১৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে চুরি করা ভারতীয় চিনি ছিনতাই করতে গিয়ে বিএনপির ২ নেতা আটক শহিদ আবু সাঈদকে ‘সন্ত্রাসী’ বলা ঊর্মির এবার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন, চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তুজা সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গ্রেপ্তার পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি সংঘাত, নারী-শিশুসহ নিহত ১৬ থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করা নারী খুন, গ্রেপ্তার পুলিশ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে সুপারিশের ব্যাখ্যা দিলেন আবদুল মুয়ীদ তারেক রহমানের সব মামলা প্রত্যাহার না হলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি পিরিয়ডের সময় যেসব খাবার খাবেন

দুই সিটিতেই আ’লীগের একচেটিয়া জয়

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
  • ২৪৮ বার

সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণের মধ্য দিয়ে ঢাকা সিটির উত্তর ও দক্ষিণ অংশে গতকাল শনিবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবারের মতো ঢাকা মহানগরীতে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণের সময় নানা অনিয়ম, ভোগান্তি ও জটিলতার ঘটনা ঘটে। বড় ধরনের সহিংসতা না ঘটলেও ভোটার উপস্থিতির হার ছিল কম। নির্বাচন কেন্দ্রগুলো ছিল সরকার সমর্থকদের দখলে। বাইরেও তাদের মহড়া ছিল চোখে পড়ার মতো। বহু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টদের দেখা যায়নি। নির্বাচনী প্রচারণার সময় যে ধরনের উৎসবমুখরতা ছিল ভোট প্রদানের সময় তা লক্ষ করা যায়নি। ইভিএম ভোট প্রদানে মানুষের সাড়া ছিল কম। ফলাফল নির্ধারিত- এমন আশঙ্কায় অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাননি বলে আলাপকালে জানিয়েছেন তারা। এসব অনিয়মের মধ্যেই এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে এগিয়ে আছেন।

কেউ কেউ ইভিএমে সহজে ভোট দিতে পারলেও বেশির ভাগ ভোটারকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। ইভিএমের ধীরগতি, আঙুলের ছাপ না মেলা এবং মেশিন কাজ না করার জটিলতায় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তারা। খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাও ইভিএমের ভোগান্তি ও বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাননি। উত্তরায় একটি কেন্দ্রে শুরুর প্রথম ঘণ্টায় একটি ভোটও পড়েনি। ভোটারদের অনীহা, বিরোধী প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়া ও এজেন্ট দিতে না দেয়া, কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারদের শুধু কন্ট্রোল ইউনিটে আঙুলের ছাপ নিয়েই ভোট হয়েছে বলে বিদায় করে দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। কাউন্সিলর প্রার্থীদের আধিপত্য বিস্তার ও ডিজিটাল ভোট চুরিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও রক্তাক্ত করা, তাদেরকে দায়িত্ব পালনে বাধা এবং এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব দর্শকের ভূমিকার মধ্য দিয়ে সকাল ৮টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। কেন্দ্রে লাঞ্ছিত হয়েছেন মোহাম্মদপুরে জাতীয় পার্টির কাউন্সিলর প্রার্থী ডেইজি সারওয়ার। নির্বাচনী এলাকা সরেজমিন ঘুরে দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রতিবেদক টিমের চোখে এসব ধরা পড়ে।

উত্তর সিটিতে নানা অনিয়ম : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ধানের শীষের এজেন্ট প্রবেশ করতে পারেননি। কেন্দ্রে মারধরের শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। একাধিক কেন্দ্রে ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। সাখাওয়াত হোসেন সুমন নামে একজন ফটোসাংবাদিকের ওপর বেপরোয়া হামলা চালিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। বিএনপি সমর্থিত বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরের ওপর হামলা হয়েছে।

বহু কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। কোনো কোনো কেন্দ্রে স্বয়ং প্রিজাইডিং অফিসার নিজেই বিএনপির এজেন্টকে বের করতে মদদ দেন। ধানের শীষের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এমন অভিযোগ পেয়ে দিনভর এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে ছুটেছেন। বহু কেন্দ্রে তিনি এজেন্টদের বসিয়ে দিয়ে চলে আসার পর, তাদের আবার বের করে দেয়া হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে ভোট দেয়া হয়ে গেছে বলে বিদায় করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে ওই ভোটারের ভোট তাদের পছন্দ মতো প্রার্থীকে দেয় সরকারি দলের লোকজন। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে বিএনপির ভোটাররা ইভিএমে ধানের শীষ প্রতীক খুঁজে পাননি। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের সময় বিএনপির অনেক ভোটারকে বাধা দেয়া হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে ভোটাররা লাইনে দাঁড়াতে পারলেও ভোট দিতে পারেননি। আবার গেটের সামনে দীর্ঘ লাইন থাকলেও ভেতরে প্রবেশ করানো হয়নি। গুলশান কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। কেন্দ্র ভোটশূন্য দেখে তিনি সকালে ওই কেন্দ্রে যান। প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।

দুপুরের আগেই ৫১টি ভোটকেন্দ্রে নানা অনিয়মের তথ্য জানিয়ে তাবিথ আউয়াল রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
তাবিথ আউয়ালের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের গাড়িতে পাঁচটি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। দুপুর ১২টার দিকে ১৬নং ওয়ার্ডের ইব্রাহীমপুরে মনিপুর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ শাখা-২ কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে তার গাড়িতে এ ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় চার দিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
তেজগাঁও টেক্সটাইল বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার, বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকেরা নৌকায় ভোট দেয়ার শর্তে ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করায়।
ঢাকা উত্তর সিটির ২২নং ওয়ার্ডের পূর্ব রামপুরা শিশু শিক্ষালয় মহিলা কেন্দ্র থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় বিরোধী দলের সব এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়। সাড়ে ১১টার দিকে পুরো কেন্দ্র দখলে নেয় আওয়ামী লীগের লোকজন।

বেলা ২টার দিকে একই ওয়ার্ডের বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার পর ভোটারদের সাথে বুথে নিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় স্থানীয় বিএনপির ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী ফয়েজ আহমেদ ফরু জানান, বেলা ১১টার সময় তাবিথ আউয়াল এ কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় এজেন্টদের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। তাবিথ আউয়াল বের হয়ে যাওয়ার পর ওই এজেন্টদের আবার বের করে দেয়া হয়।
১০নং ওয়ার্ডে ঠেলাগাড়ি প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থী মাসুদ খান অভিযোগ করেন, গোপন কক্ষে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের উপস্থিতিতে ভোট দিতে বাধ্য করেছে ভোটারদের। তিনি নিজেই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছেন। এই বিষয়টি বেলা পৌনে ১১টায় বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি কেন্দ্রে ভোট পর্যবেক্ষণ করতে আসা বিদেশী পর্যবেক্ষকদেরও জানান মাসুদ খান। এখানে তিনটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম। ভোটারদের সহযোগিতার নামে একাধিক ব্যক্তিকে দেখা গেছে গোপন কক্ষে। কেন্দ্র ও কক্ষের ভেতরে এবং বাইরে নৌকার ব্যাজ পরা নানা বয়সী মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। এখানকার একটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ধানের শীষের কোনো এজেন্ট আসেনি।
কাজিপাড়ার প্যারামাউন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রের প্রতিটি বুথে আতিকুল ইসলামের কর্মীদের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এই কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো এজেন্টকে থাকতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

উত্তরের ৩৪নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন খোকনের লোকজন সাংবাদিক সাখাওয়াত হোসেন সুমনের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়। কেন্দ্রের বাইরে অস্ত্রের শোডাউন করছিল খোকনের লোকজন। এ ছবি তুলতে গেলে অস্ত্রধারীরা সুমনের ওপর হামলা চালায়। প্রথমে তার মাথায় দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়, পরে আবার ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে তার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় আহত হওয়ায় তাকে ভর্তি রাখতে অনীহা দেখিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা।

উত্তর সিটির ১৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শরিফ উদ্দীন জুয়েলের কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকেরা। এ সময় তার কর্মী রবিন, মারুফ, রাসেল ও মাসুম আহত হন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
শরিফ উদ্দীন জুয়েল জানান, কালাচাঁদপুরে উত্তর সিটি ১৮ নং ওয়ার্ডে ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। সকাল ১০টার পর থেকেই এ কাজ শুরু হয়।
উত্তর সিটির ৩নং ওয়ার্ডের পল্লবী থানা যুবদলের সভাপতি পিন্টু ভোটকেন্দ্রে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন।
রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় সরেজমিন দেখা গেছে, এই কেন্দ্রে বিএনপির কোনো এজেন্ট নেই। ভোটারদের মধ্যে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় এখানে।
কাফরুল ম্যাক ডোন স্কুলে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। সকাল ১০টার আগেই এখানে ১৬নং ওয়ার্ড বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী হাবিবুর রহমান রাব্বির এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেয়া হয়।

লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এ কেন্দ্রের ৯টি বুথে বেলা ১১ পর্যন্ত ভোট পড়ে মাত্র ৩৪টি।
সকালে ইব্রাহিমপুরে একটি ভোটকেন্দ্রে থেমে থেমে ককটেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। মাঝে মধ্যে মিছিলও করে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা।
উত্তরের ১নং ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় আহত হন।
পল্লবীর শহীদবাগ স্কুলে ইভিএম অচল ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। মিরপুর-১০ আদর্শ স্কুল সেন্টারে বোমাবাজি হয়েছে। এই এলাকায় কেন্দ্রের বাইরে বিএনপির ভোটার সিøপ দেয়ার জন্য তৈরি করা বুথ আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়া হয় ভোট শুরু হওয়ার অনেক আগে।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কোনো কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষের পুলিং এজেন্টদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এমনকি কাউন্সিলর প্রার্থীকেও কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয়। এ কেন্দ্রে বহিরাগত লোক এনে জড়ো করা হয়; যারা ভোটারদেরকেও কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়নি। বারিধারা ইউআইটিসি স্কুল কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেয়া হয়। বিএনপির চিহ্নিত ভোটারদের বেছে বেছে বাধা দেয়া হয়। ইব্রাহিমপুরে দ্য নর্দান ক্রস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট দেখা যায়নি। প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ আকতার জানান, কক্ষ ছোট হওয়ায় সবাইকে বসতে দেয়া যায়নি। তবে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হাবিবুর রহমান রাব্বীর ঘুড়ি প্রতীকের পোলিং এজেন্ট ছিল। এই কেন্দ্রের বাইরে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণের উপস্থিতি দেখা গেলেও ৯টা ৪ মিনিটে চারজন ভোটার লাইনে দাঁড়ানো ছিল। ভোটকেন্দ্রের অদূরে থেমে থেমে বিকট শব্দ শোনা গেছে, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী রাব্বি।

সরকারি জামলা আইনুল আনন্দ বিদ্যালয় ও কলেজে ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগণ্য। বিএনপির এজেন্ট ছিল না। এ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসার সাংবাদিকদের ভেতরে ঢুকতে বাধা সৃষ্টি করেন। মোহাম্মদপুর গ্রাফিক্স আর্টস ইনস্টিটিউটে স্থানীয়দের পরিকল্পিতভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তবে ভেতরে কোনো ভোটার ছিল না। সকাল ৯টায় সানবিম স্কুলে কোনো ভোটার ছিল না এবং বিএনপির কোনো এজেন্টও পাওয়া যায়নি। ভয় দেখিয়ে তাদের বের করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ও এজেন্টরা। ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী এ জি এম শামসুল জানান, উত্তর বাড্ডা গার্লস স্কুল কেন্দ্র দখল করে প্রিজাইডিং অফিসারের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নৌকার পক্ষে ইচ্ছেমতো ভোট দেন। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ফারুক হোসেন ভূঁইয়ার ওপর মানারাত স্কুল কেন্দ্রে যুবলীগ নেতা লালনের নেতৃত্বে হামলা করা হয়। এর আগে বেলা ২টার দিকে এই কেন্দ্র থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় আহত পোলিং এজেন্ট লেহাজউদ্দিন শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে : তাবিথ আউয়াল
৫৪টি ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্র থেকে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন তাবিথ আউয়াল। দুপুরে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে তাবিথের প্রতিনিধি জুলহাস উদ্দিন এ অভিযোগপত্র জমা দেন। এ সময় সিটির ৪৩টি ওয়ার্ডের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ লিখিতভাবে দেন তিনি। তাবিথ বলেন, ডিএনসিসির সব ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রেই বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে ৪৩টি ওয়ার্ডের বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি।
এর আগে গুলশান-২ নম্বর সেকশনে অবস্থিত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রের ৬ নম্বর বুথে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে ভোট দেন তাবিথ। এরপর সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালেও বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করেন তিনি। তাবিথ বলেন, আমাদের এজেন্টদের সকাল থেকেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও কেন্দ্রে ঢুকতেই দেয়া হয়নি এজেন্টদের। সরকারি দল সকাল থেকেই ভয়ভীতি ও হামলা শুরু করে।
সরেজমিন দেখা যায়, অনেক কেন্দ্রে ভোটারের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। প্রথম কয়েক ঘণ্টায় কেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগ বুথে ভোটার উপস্থিতি ছিল না। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্টদের অলসভাবে বসে থাকতে দেখা যায়। আবার বিএনপিসহ সব প্রার্থীর এজেন্টও বেশির ভাগ বুথে ছিলেন না। আতঙ্ক, শঙ্কা ও ইভিএমের প্রতি বিতৃষ্ণার কারণেই ভোটার উপস্থিতি এতটা কম ছিল বলে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে। অন্য দিকে, ভোটের আগের রাতেই বিভিন্ন স্থানে কাউন্সিলর প্রার্থীদের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে সঙ্ঘাত হয়। কেউ কেউ একে অপরের ভোটার স্লিপ ক্যাম্পও ভেঙে ফেলে।
আপত্তির মুখে পুরো ঢাকা সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভোট করতে গিয়ে সিইসি নিজেই বিড়ম্বনার শিকার হন। উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের আইইএস স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়েছিলেন সিইসি কে এম নুরুল হুদা। বাকি সব কেন্দ্রের মতো এই কেন্দ্রেও ইভিএমে নেয়া হচ্ছিল ভোট। সিইসি উপস্থিত হওয়ার পর তাকেও ভোট দেয়ার জন্য ইভিএম মেশিন সরবরাহ করা হয়। বিধি অনুযায়ী, তাতে ভোট দেয়ার জন্য আঙুলের ছাপ দিতে যান তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত তার আঙুলের ছাপ মেলেনি। জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভোট দেন তিনি।
নৌকা সমর্থকদের দাপট : উত্তরের গাবতলী বাগবাড়ী রোডের শেষ মাথায় অবস্থিত মিরপুর ল্যাবরেটরি হাইস্কুল। এই স্কুলে ৩১৩ ও ৩১৪ নম্বর কেন্দ্রের ভোট নেয়া হচ্ছে। সকাল ৮টায় ভোট শুরুর আগেই আশপাশ থেকে শুরু করে কেন্দ্রের ভেতর পর্যন্ত চলে নৌকা মার্কার প্রার্থী ও ঠেলাগাড়ি মার্কার সমর্থকদের আধিপত্য। তাদের দাপটে ওই এলাকায় ছিল এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ। কেন্দ্রের ভেতরে তারা অবাধে প্রবেশ করলেও দায়িত্বরত কেউই তাদের বাধা দেননি। নৌকা ও ঠেলাগাড়ির এজেন্টরা দুই কেন্দ্রে সম্মিলিতভাবে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে অবাধে যাওয়া-আসা করেন। কিন্তু কোনো বুথকক্ষে ধানের শীষ কিংবা বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর কোনো এজেন্ট চোখে পড়েনি।
৩১৩ নম্বর কেন্দ্রের ৪ নম্বর কক্ষে পৌনে ৪টার দিকে দেখা গেল মাঝবয়সী এক পুরুষকে বুথকক্ষে নিয়ে কোটপ্যান্ট পরা অন্য একজন ভোট দিতে সহায়তা করছেন। শোনা গেল, চার নম্বর বোতামে চাপ দেন, তখনই তিনি তার নির্দেশ মতো চার নম্বর বোতাম চাপ দেন। বলে, আপনার ভোট হয়ে গেছে, তখন ভোটার হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন। কোটপ্যান্ট পরা ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতেই তিনি নিজেকে ঠেলাগাড়ি মার্কার এজেন্ট পরিচয় দেন এবং তার নাম মো: জীবন বলে জানান। এই জীবনের মতো সেখানে মো: সুমন, মাসুমসহ অনেকেই আছেন ভোটাররা না চাইলেও জোর করে সহায়তা করতে। ভয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার এ কে এম আশরাফুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, এই কেন্দ্রে এক হাজার ৭২৫টি ভোট রয়েছে। বেলা ২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশ। সরকারি দলের বাইরে অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট নাই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা আসেননি। একই স্কুলের আরেকটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো: ইউনুছ জানান, বেলা ২টা পর্যন্ত এক হাজার ৬৮৮টি ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ৬১৬টি। তিনিও বলেন, এখানে অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট আসেননি। তবে ডলফিন মার্কার এক এজেন্ট বলেন, তারা এসেছিল সকালে, কিছুক্ষণ পর চলে গেছে।
মিরপুর ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের মতো একই অবস্থা বাগবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থিত দু’টি কেন্দ্রে। নৌকা, ঠেলাগাড়ি ও ডলফিন মার্কার প্রার্থী ছাড়া বিরোধী কোনো প্রার্থীর এজেন্ট চোখে পড়েনি। ওই স্কুলের চারতলা বিল্ডিংয়ের দুইতলা পর্যন্ত ৩১৯ নম্বর এবং তৃতীয় ও চতুর্থ চলায় ৩২০ নম্বর কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ হয়। এই দু’টি কেন্দ্র ও আশপাশে দেলোয়ার হোসেন দিলু, রিন্টু, মো: সেলিমের মতো অনেকেই আছেন, যাদের দাপটে ভোটাররাও আতঙ্কিত। নৌকা ও ঠেলাগাড়ির প্রার্থীকে ভোট না দিলে নানাভাবে নাজেহাল করছেন তারা। এমনকি নারীদের গায়েও হাত তুলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেলা ৩টায় ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে সরকার সমর্থিত প্রার্থীর কর্মী রিন্টু এক নারী ভোটারকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। ওই নারী প্রতিবাদ করলে তাকে থাপ্পড়ও মারেন। এ সময় পাশে থাকা অন্য লোকজন গিয়ে রিন্টুকে নিবৃত করেন এবং ওই নারী ভোটার সেখান থেকে চলে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আসনার সদস্য নয়া দিগন্তকে জানান, সকাল থেকেই নৌকা ও ঠেলাগাড়ির সমর্থকরা খুবই সমস্যার সৃষ্টি করেন। ভোটারদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে দেননি। জোর করে নৌকা ও ঠেলাগাড়ির পক্ষে ভোট আদায় করেন। অনেকেই প্রতিবাদ করে ভোট না দিয়ে চলে গেছেন। এজেন্ট না থাকা প্রসঙ্গে তিনি জানান, বিএনপি প্রার্থীদের এজেন্ট এসেছিল। কিন্তু তাদের থাকতে দেয়া হয়নি। তাদের জোর করে বের করে দেয়া হয়েছে।
৩১৯ নম্বর কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো: মনিরুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, ইভিএম পদ্ধতি নতুন হওয়ায় অনেকে বুঝতে পারেননি। একটি ভোট দিতে কখনো কখনো ৮-১০ মিনিট লাগছে। এক আঙুলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মিললে আরেক আঙুল দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। কারো কারো ১০টি আঙুল দিয়ে চেক করে মেলানো হচ্ছে। আবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় অনেকেই ভোট না দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত দুই হাজার ৩৮৯ ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ৬৮০টি। ৩২০ নম্বর কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ড. সুরঞ্জন সরকার বলেন, দুই হাজার ৫৮০টি ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ১৭ শতাংশ। এজেন্ট না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সকালে বিএনপির ২০ জন এজেন্টের কার্ড ইস্যু করেছি। তারা না থাকলে তো জোর করে রাখতে পারব না। মিরপুর ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, বাগবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো শাহ আলী মডেল হাইস্কুল, দারুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (মহিলা কেন্দ্র), গাবতলী জমিদার বাড়ি স্কুল, আর সি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দারুস সালাম সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কোরিয়ান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ অনেক কেন্দ্রে বিএনপি মনোনীত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সহসভাপতি মাসুদ খান। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, সকালে আমাদের এজেন্টরা কেন্দ্রে প্রবেশ করলে আওয়ামী লীগের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে, জোর করে তাদের বের করে দেয়।

সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলাফল
উত্তর (কেন্দ্র : ১৩১৮, প্রাপ্ত কেন্দ্র : ১৩১৮)
নৌকা : ৩,৭০,০৬১
ধানের শীষ : ২,১২,৫৭৭

দক্ষিণ (কেন্দ্র : ১১৫০, প্রাপ্ত কেন্দ্র : ১১৫০)
নৌকা : ৪,২৪,৫৯৫
ধানের শীষ : ২,৩৬,৫১২

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com