মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট, টাকার দরপতনের মতো পরিস্থিতিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নতুন মুদ্রানীতিতে রেপো রেট বা নীতি সুদ হার বাড়ানো হয়েছে, সেইসাথে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে, ভোক্তা ঋণের সুদহারের সীমা শিথিল করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো রেট ৫.৭৫ ভাগ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ ভাগ করা হয়েছে। আর রিভার্স রেপো হার আগের ৪ ভাগ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪.২৫ ভাগ করা হয়েছে।
রেপো রেট শব্দটি রিপারচেজিং অপশন বা পুনঃক্রয় চুক্তি থেকে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ ঘাটতির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে অর্থ ধার দেয় সেটাই রেপো রেট।
আর রিভার্স রেপো রেট হলো যে সুদহারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে।
ভোক্তা ঋণের সুদহার ৩% বাড়িয়ে ১২% করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসাথে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেয়া সুদহার তুলে দেয়া হয়েছে। সেইসাথে ক্রেডিট কার্ড ঋণের ক্ষেত্রে কোনো সীমারেখা থাকছে না।
তবে ভোক্তা ঋণ ছাড়া সব ধরনের ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশেই নির্ধারিত থাকবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ শিল্প ঋণসহ অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কোনও ঘোষণা আসেনি।
একইভাবে বিশেষ রেপো হার আগের মতোই ৮% এবং ব্যাংক রেট ৪% রাখা হয়েছে। ব্যাংক রেট হল কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদার রোববার প্রথমবারের মতো মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেন।
২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে।
তবে এবার সঙ্কট সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ ঋণের অন্যতম শর্ত বছরে অন্তত দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা।
মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজার ও সুদহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে এবারের মুদ্রানীতি করা হয়েছে এবং আগামীতে খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করবে বলে জানিয়েছেন আব্দুর রউফ তালুকদার।
মুদ্রানীতির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন অর্থবছরে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৭.৭%, যেখানে গত বছরের জুনে ধরা হয়েছিল ৩৬%।
তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের মতো ১৪.১% ধরা হয়েছে।
সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.৫%, গত জুনে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে যা ধরা হয়েছিল ১৮.২%।
অর্থাৎ চলতি অর্থবছর অর্থাৎ জুন নাগাদ ঋণের প্রবৃদ্ধি যেটা টার্গেট করা হয়েছে, সেটা গত অর্থবছরের ডিসেম্বরের প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
কিন্তু মুদ্রানীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা সেই লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘মুদ্রানীতিতে বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও উদ্যোগের বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু এর সাপেক্ষে কৌশলী ও টার্গেটেড উদ্যোগ দরকার ছিল, সেই বিষয়গুলো মুদ্রানীতিতে প্রতিফলিত হয়নি।’
‘আইএমএফ-এর সাথে সরকার বিভিন্ন শর্তাদি নিয়ে আলোচনা করছে। সে হিসেবে এই মুদ্রানীতিতে যতো উদ্যোগ প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা পর্যাপ্তভাবে ফুটে ওঠেনি,’ তিনি বলেন।
গত জুন মাসের মুদ্রানীতিতে রেপো সুদ হার বাড়িয়ে ৫.৫০% নির্ধারণ করা হলেও পরে দুই দফায় বাড়িয়ে এবার তা ৬% করা হলো।
সাধারণত মূল্যস্ফীতি সীমিত করতে রেপো রেট বাড়ানো হয়, যেন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিতে নিরুৎসাহিত হয়। এতে বাজারে অর্থের জোগান কমে এবং তারল্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সহজভাবে বললে রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়া হয়।
তবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র রেপো রেট বাড়ানো যথেষ্ট নয়, বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা ৯ শতাংশে বেঁধে দেয়ায় অর্থনীতিতে বড় কোনো চাপ পড়ছে না।
তবে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, এই সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেয়া হলে ব্যাংকগুলো আরো প্রতিযোগিতামূলক দামে তাদের ঋণ সুবিধাগুলো দিতে পারত।
কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদের হারে শিথিলতা না আনায় বড় আকারে ঋণ নেয়া এখনো সহজ হয়ে পড়েছে। ঋণ নিয়ে ঋণগ্রহীতারা আরো অর্জন করছেন বলে তিনি জানান।
এতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ সামাল দেয়ার বিষয়টি এই মুদ্রানীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ বলে তিনি মনে করেন।
মোয়াজ্জেম বলেন, ‘যদি সুদের হার শিথিল করা হতো তাহলে সেটি ১২% থেকে ১৩% যাই দাঁড়াত তাহলে সেটা ঋণের প্রবৃদ্ধিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কিন্তু মুদ্রানীতিতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়নি।’
এমন অবস্থায় সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
ব্যাংক ঋণের সুদের হারে শিথিলতা আনা হলে, সেইসাথে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন সুদহার তুলে দেয়া হলে, ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
সেইসাথে সরকার এত দিন মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে।
এর অর্থ, এখন বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুদ্রা বিনিময় হার ঠিক হবে। এর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে শুধুমাত্র ২%-এর মতো। যেমন বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা করা হলে সরকার সেটাকে হয়তো কমিয়ে ৯৮ টাকা করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মুদ্রানীতিতে এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে।
তবে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের বিষয়টি অনেক আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও মুদ্রানীতিতে এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ খন্দকার মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ‘সুশাসনগত দুর্বলতার কারণে যে পরিমাণ অর্থ অনাদায়ী হচ্ছে সেটা আমানত ও ঋণ দুই ধরনের অর্থের যোগানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আইএমএফ-এর সাথে সরকারের আলোচনায় ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলেও মুদ্রানীতিতে সুশাসনের জন্য করণীয় কিছুই উঠে আসেনি।’
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫% প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬% ধরে রাখার পরিকল্পনা নির্ধারণ করে সরকার।
অবশ্য সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬. ৫০% করা হয়েছিল। যদিও বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৫.২০%-এর মধ্যে থাকবে।
কিন্তু সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮.৭১% শতাংশে দাঁড়িয়েছে, আর গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭.৭০% হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, নতুন মুদ্রানীতি সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওই লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র সামনের দিনগুলোয় কেমন হবে সেটি তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। ১. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়কাল ও তীব্রতা, ২. মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার বৃদ্ধির উদ্যোগ, ৩. চীনে পুনরায় ছড়িয়ে পড়া কোভিড পরিস্থিতি।
এসব প্রতিকূল পরিস্থিতির নিরসন হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি আরো গতিশীল হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র : বিবিসি