শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৩ পূর্বাহ্ন

ভয় করো না করোনাকে

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
  • ৩২৯ বার

আরো অনেক ভাইরাস, আরো অনেক রোগের মতো করোনাভাইরাসের নামও আমরা জীবনেও শুনিনি। কালে কালে আরো কত কী যে শুনব, কত কী যে দেখব। আজ থেকে ৬০/৭০ বছর আগে মরণব্যাধি ক্যান্সারের নামও বড় একটা শোনা যেত না। অন্তত সাধারণ মানুষ ক্যান্সার নামক রোগটির ব্যাপারে অবহিত ছিল না। ডাক্তাররা নিশ্চয়ই ক্যান্সার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু এর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে তাঁদের জ্ঞানও ছিল সীমিত। সাধারণ মানুষ ক্যান্সারের ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল বলে রোগটির উপসর্গ নিয়েই আলাপ করত। যেমন বলা হতো, আহা, মানুষটার কী যে এমন পেটে ব্যথা হলো, কিছুই খেতে পারত না, আর না খেয়ে না খেয়ে, শুকাতে শুকাতে একেবারে দড়ি দড়ি হয়ে মারা গেল। আর না হয় বলত, গলায় কী যে হলো, পানিটুকুও গিলতে পারত না। হাসপাতালগুলোতে ক্যান্সার চিকিৎসার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন তো রেডিওথেরাপি-কেমোথেরাপি ইত্যাদিসহ বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা বাংলাদেশেই পাওয়া যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস নামক ভয়ঙ্কর ভাইরাসটি দু-তিন মাস ধরে সারা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এর উৎপত্তি বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক মোড়ল চীনে, যেখানে এই গ্রহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বাস। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি ওই বিশাল কর্মচঞ্চল দেশটি হঠাৎ কেমন স্থবির হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট জনশূন্য। কলকারখানা, দোকানপাট, শিক্ষালয়, কর্মস্থল সবখানে ঝুলছে তালা। আর চীনের বাইরে যাতে এই আচানক ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য পৃথিবীর সব দেশে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ মাত্রার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। উৎপত্তিস্থলে যেভাবে এই ভাইরাসজনিত রোগ দুর্বার গতিতে বিস্তার লাভ করছে, তাতে শুধু চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোই নয়, সারা বিশ্বেই এই বহিঃশত্রুর আক্রমণের আতঙ্কে সাইরেন বেজেই চলেছে। বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর যেখানেই চীন থেকে একটি বিমান, জলযান বা স্থলযান এসে পৌঁছাচ্ছে, সেখানেই তাকে নিরাপত্তা বাহিনী, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্যরা এমন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দিয়ে এই পরীক্ষা, সেই পরীক্ষা, এই তল্লাশি, সেই তল্লাশি করছে যে যাত্রীদের অবস্থা জেরবার হওয়ার জোগাড়। অবশ্য পরিস্থিতি যেরূপ দাঁড়িয়েছে তাতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা না নিয়ে উপায়ও নেই। কোনো চান্স নেওয়া মানেই সংশ্লিষ্ট দেশটিতে করোনাভাইরাসকে স্বাগত জানানো। আর এই দুষ্ট ভাইরাসটি এমন ভয়ঙ্কর যে সে দাবানলের মতো দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। চীনে মাত্র মাস দুয়েক আগে এক ডাক্তার ভদ্রলোক সর্বপ্রথম এই নতুন ভাইরাসটির অস্তিত্বের কথা সবাইকে জানালেন। তখন কর্তৃপক্ষ তাঁকে পাগল ঠাউরে হেনস্তা করল এবং তাঁর কথা কেউ বিশ্বাসই করল না। আর ওই দেশে অদ্যাবধি (১৩ ফেব্রুয়ারি) এই ভাইরাসজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা এগার শ ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪৫ হাজারের বেশি। আর ভাগ্যের এমনি নির্মম পরিহাস যে ওই চীনা ডাক্তার ভদ্রলোকও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি পরলোকগমন করেছেন।

২.

চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক গভীর। আমাদের মেগাপ্রকল্পগুলো থেকে শুরু করে ছোট-বড় অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। চীন সত্যিকার অর্থেই আমাদের ডেভেলপমেন্ট পার্টনার বা উন্নয়ন সহযোগী। আর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে দুই দেশের সম্পর্ক দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আলপিন থেকে অ্যারোপ্লেন প্রস্তুতকারী দেশ চীনের পণ্যসামগ্রীতে ভরপুর আমাদের বিপণিবিতানগুলো। এমনকি পেঁয়াজ-রসুনের মতো কৃষিজাত পণ্যও আমরা আমদানি করে থাকি চীন থেকে। এ ছাড়া ভূরাজনৈতিক কারণেও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এক কথায় অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে যোগাযোগ ও যাতায়াত দিন দিন বাড়ছে। ফলে ইদানীং বাংলাদেশে যেমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চীনা নাগরিক বসবাস করছেন, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেখাপড়ার কারণে বেশ কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক আছেন চীনে। এঁদের অনেকেই নিয়মিত এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করে থাকেন। চীন থেকে যাঁরা আজকাল বাংলাদেশে আসছেন সেই সব বাংলাদেশি বা চীনা যাত্রী স্বভাবতই করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য ‘ক্যারিয়ার’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। যে প্লেনে করে তাঁরা বাংলাদেশে আসছেন সেই প্লেন ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে তার ক্রু, যাত্রী এবং তাদের সবার লটবহর বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না কাউকে। এরপর যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয় বিমানবন্দরের নিকটবর্তী ‘কুয়ারিনটিন’ ক্যাম্পে, যেখানে বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয় দুই সপ্তাহ। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বহিরাগত কোনো যাত্রী বা ক্রু করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহ হলে তাঁকে তত্ক্ষণাৎ নিকটবর্তী কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এবং প্রয়োজনবোধে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এভাবে করোনাভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক বলা যায়। এটা নিষ্ঠার সঙ্গে যেমন ধরে রাখতে হবে, তেমনি জনসাধরণকেও ধৈর্যসহকারে কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ‘সুপার চালাক’ কেউ যেন কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর চোখকে ফাঁকি দিতে না পারে।

সুখের বিষয়, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি বাংলাদেশে। তবু চীনের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ, যাতায়াত, পণ্যসামগ্রীর অবাধ আমদানি-রপ্তানি ও আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় আমরা অবশ্যই বিরাট ঝুঁকির মধ্যে আছি। কাজেই যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো যত দিন পর্যন্ত না এই বালাই সম্পূর্ণ দূর হয়েছে, তত দিন চালিয়ে যেতে হবে। এই ব্যবস্থাপনাকে কেউ যদি বাড়াবাড়ি মনে করেন করতে পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সব কিছুর ওপরে মানুষের জীবন। কারো ক্রুটি-বিচ্যুতি বা গাফিলতির জন্য একবার যদি এই প্রাণঘাতী ভাইরাসটি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে, তাহলে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও অযুত সমস্যাসঙ্কুল গরিব দেশটির যে কী অবস্থা হবে তা ভাবতেও শিহরণ লাগে। বিশেষ করে রোগ-বালাই সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অতি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা যে মোটেই সুখকর নয় তা ভুলি কী করে। হ্যাঁ, ডেঙ্গু জ্বরের প্রার্দুভাবের কথাই বলছি। এই তো সেদিন, রাজধানী ঢাকায় আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা যে তেলেসমাতি কাণ্ড দেখালেন তা দেশবাসী বহু দিন মনে রাখবে। ডেঙ্গু দমনে কর্তাব্যক্তিরা কী করেননি? বক্তৃতা-বিবৃতি, ভাষণ-তোষণ-ফটোসেশন, বিদেশ গমন, যুদ্ধযাত্রার মতো সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে শোভাযাত্রা, সর্বোপরি পাবলিকের পয়সায় কোটি কোটি টাকার মশকনিধনকারী ঔষধ আমদানি (দুষ্ট লোকে তখন বলাবলি করেছে, ওই সব ঔষধ নাকি ছিল ভেজাল কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ)—দৃষ্টিনন্দন অনেক কিছুই করেছেন তাঁরা। আর এত এত ঢক্কানিনাদ ও নর্তন-কুর্দনের পর ফল? অষ্টরম্ভা। বেশ কিছু মূল্যবান প্রাণ অকালে বাজে খরচ হয়ে গেল। ডেঙ্গুযুদ্ধের চিহ্নিত ভিলেন যে মশা সে রীতিমতো কলা দেখিয়ে বংশবিস্তার করেই চলেছে। শহরবাসীও অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা, ডাবের খোসা, কচুরিপানা ভর্তি ডোবা, হাজামজা নালা-নর্দমা, খানা-খন্দক ইত্যাদি সহকারে মশককুলকে ‘মানবিক সহায়তা’ দিয়েই চলেছেন, তাঁদের আজন্মলালিত খাসলতের এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। ভাগ্যিস ডেঙ্গুর মতো মশা, মাছি, তেলাপোকা বা ইঁদুরজাতীয় কোনো প্রাণী করোনাভাইরাসের বাহন নয়, মানুষই তার বাহন। তা না হলে তো বাংলাদেশের চেয়ে উত্তম নিবাস ও বিচরণক্ষেত্র আর দুটি পেত না করোনা। তবে অন্য কোনো প্রাণীর সাহায্য ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ে বিধায় করোনাকে বলা যায় ‘সাইলেন্ট কিলার’ বা নীরব ঘাতক। এটা অবশ্যই আরো মারাত্মক। রোগী টেরই পেল না এই আততায়ীকে সে নিজেই বয়ে বেড়াচ্ছে।

তবে করোনাভাইরাস—যার নাম বদলিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন নাম রেখেছে কভিড-১৯—যত ভয়ঙ্কর খুনিই হোক না কেন, তাকে যে প্রতিহত করা যায় তা তো গত কয়েক দিনে আমরা বাংলাদেশেই দেখতে পেয়েছি। নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা করোনাকে পাকড়াও করার বিভিন্ন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছি। এবং তা করেছি একটি ‘টিম ওয়ার্কের’ মাধ্যমে। এটাই আরো জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে পুরো অভিযানের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে হবে দেশের সব নাগরিককে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যেসব স্বাস্থ্যবিধির কথা স্বাস্থ্য বিভাগ ও চিকিৎসকরা বলে আসছেন, শুরু থেকেই সেগুলোর প্রচার আরো বাড়াতে হবে।

এখনও সমস্যাটি শহর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরকেন্দ্রিক। কাজেই যাবতীয় ব্যবস্থা আপাতত ওইসব স্থানেই নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ না করুন, যদি এই ভাইরাস আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পার হয়ে মফস্বলে চলে যায়, তখন? সে জন্য স্বাস্থ্যবার্তা প্রচারের যে কর্মসূচি সরকার চালু করেছেন তা বন্দর নগরীগুলোর বাইরেও জারি রাখতে হবে। আর তা সফলভাবে করা যাবে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত স্থানীয় সরকার সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততার মাধ্যমে। আর যদি রাজনৈতিক দলগুলো এতে শরিক হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

মোট কথা, আতঙ্কিত না হয়ে করোনা বিবিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে হবে। বলতে হবে, বাংলাদেশ তোমার জন্য ‘হেলায় লঙ্কা করিল জয়’-এর মতো হবে না, সুন্দরী। এ দেশের মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেই বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে। আজ আরেক ফেব্রুয়ারি। আর যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে একাত্তরে, শহীদ হয়েছে ত্রিশ লক্ষ মানুষ। সামনের মাসেই আসছে আমাদের স্বাধীনতা দিবস। অতএব, করোনা বিবি, জেনে রাখো, এ বড় কঠিন ঠাঁই। এখানে ঢোকার চেষ্টা করো না।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com