বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের গড়পড়তা মানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে, একই জরিপে বিপরীতমুখী খবর হচ্ছে মানুষের আয় বাড়ছে। একইভাবে সরকারের বিভিন্ন হিসাবেও দেখা যাচ্ছে মানুষের আয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সাধারণত দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের আয় বৃদ্ধির কারণে খাদ্য গ্রহণের হারও বেড়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু এ ধরনের বিপরীতমুখী পরিসংখ্যান প্রকাশ হওয়ার পর বিভিন্ন সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের আয় বেড়েছে কি? নাকি, মানুষের প্রকৃত আয় না বেড়ে বেড়েছে বৈষম্য। ফলে বাজার থেকে গড়পড়তা মানুষের খাদ্য কেনার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
নয়া দিগন্ত বিবিএস জরিপের বিস্তারিত তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মানুষ প্রধান খাদ্য ভাত ও গম খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। ২০১০ সালে একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৪১৬ দশমিক ১ গ্রাম ভাত খেত। ২০১৬ সালে এসে দেখা যাচ্ছে জনপ্রতি ভাত খাওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬৭ দশমিক ১৯ গ্রাম। ২০০৫ সালে ভাত খাওয়ার পরিমাণ ছিল গড়ে জনপ্রতি ৪৩৯ দশমিক ৬৪ গ্রাম। আটা খাওয়ার পরিমাণও একই সময়ে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫ সালে দৈনিক মাথাপিছু আটা গ্রহণের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৮ গ্রাম। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৯ গ্রাম। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৮৩ গ্রামে। মূল ব্যাপার হচ্ছে ২০১৬ সালে চালের দাম বেড়ে যায়। আগে যে টাকায় এক কেজি চাল পাওয়া যেত, সেটি কিনতে গিয়ে তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সীমিত আয়ের একটি পরিবার বাধ্য হয়ে তাদের বরাদ্দ চাল কেনা কমিয়ে দিয়েছে কি না, এটা আরেকটি গবেষণার বিষয়। ব্যাপারটি ঘটে থাকতে পারে সাধারণত মধ্যবিত্ত নি¤œমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষদের বেলায়, যাদের আয়ের বড় অংশটি চলে যায় জীবন ধারণের জন্য মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য কিনতে।
জরিপে কিছু ইতিবাচক দিকও এসেছে। মানুষের মধ্যে ডাল, সবজি, মাছ ও গোশত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। ২০১০ সালে মাথাপিছু দৈনিক ডাল, সবজি, মাছ ও গোশত গ্রহণের পরিমাণ যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৩০, ১৬৬ দশমিক ৯, ৪৯ দশমিক ৫০ এবং ১৯ দশমিক ৭ গ্রাম। ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৬০, ১৬৭ দশমিক ৩০, ৬২ দশমিক ৫৮ এবং ২৫ দশমিক ৪২ গ্রামে। এতে করে মানুষের মোট খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে গেছে তার প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। জরিপে দেখা যাচ্ছে, মোট খাদ্য গ্রহণ করার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ক্যালোরি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক ২৩১৮ দশমিক ৩ ক্যালোরি খাদ্য গ্রহণ করত। ২০১৬ সালে মানুষ গ্রহণ করেছে দৈনিক ২২১০ দশমিক ৪ ক্যালোরি। এতে করে মানুষের খাদ্য গ্রহণের ওপর কোন্ জিনিসটি বেশি প্রভাব ফেলেছে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বিবিএস বলেনি।
বিবিএসের জরিপ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সাধারণত অনেকসময় এই ধারণা প্রবল হয় যে, সরকার নিয়ন্ত্রিত জরিপে সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে বিগত এক দশকে বড় ধরনের বৈষম্য দেখা দিয়েছে সমাজে। বিশেষ করে কিছু মানুষ অগাধ অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছে রাতারাতি। ফলে অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্ত সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছে না পরিস্থিতির। মাথাপিছু আয় ব্যয় এবং খাদ্য গ্রহণের ধারণাটি এখানে সঠিকভাবে প্রক্ষেপিত না-ও হতে পারে। বিবিএস খানা জরিপ করেছে। এ জরিপ নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে মিডিয়ায়। তার পরও যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে তা গ্রহণ করা হলে আমাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দেবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির বিষয়টি। সরকারকে ব্যাপারটি গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। একটি উন্নত জাতি গঠন করতে হলে তার স্বাস্থ্য হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ। সে জন্য বৈষম্য দূর করে সুষম উন্নয়ন করতে হবে।