একটি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন গ্রাহকের মোবাইলে খুদে বার্তা যাচ্ছে, ‘এক লাখ টাকা জমা রাখলে প্রতি মাসে মুনাফা দেয়া হবে ১ হাজার ২২ টাকা। আর সাড়ে ৫ বছরেই দেয়া হবে জমাকৃত টাকার দ্বিগুণ।’ অপর একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে, ‘প্রতি এক লাখ টাকার বিপরীতে প্রদান করা হবে ১ হাজার ৫০ টাকা। আর ৫ বছরেই দ্বিগুণ হয়ে যাবে গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ।’ এমনই বাহারি অফার দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। নগদ টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করায় আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠেছে কিছু কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে বিশাল অঙ্কের চেক দিলে অনেক ব্যাংকের জন্য গ্রাহককে টাকা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে গত আগস্ট শেষে ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর হাতে রয়েছে প্রায় আট হাজার কোটি অলস টাকা, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্টে পড়ে রয়েছে। এ থেকে কোনো মুনাফা বা সুদ মিলছে না। অথচ গত মে শেষে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা, আর ব্যাংকগুলোর হাতে অলস টাকা ছিল তিন হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল শনিবার এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে যে উদ্বৃত্ত তারল্য দেখানো হচ্ছে, তার সাথে বাস্তবতার কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেন, কিছু কিছু ব্যাংকের বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে বাড়তি তহবিল রয়েছে। কিন্তু ওই সব ব্যাংক ইচ্ছা করলেই অতিরিক্ত ঋণ দিতে পারে না। আবার প্রকৃত অবস্থায় ঋণের চাহিদাও কম। বেসরকারি খাতের মাত্র ১০ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ঋণের চাহিদা না থাকলে যেসব ব্যাংকের কাছে উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে, তাদের তারল্য বাড়বে।
তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবেই খারাপ অবস্থানে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। সাধারণত ১৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ঋণ আদায় বাড়ছে না। বরং এর বিপরীতে ঋণখেলাপিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে ভালো গ্রাহকও ঋণ পরিশোধের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
ঋণ আদায় না হওয়ায় সাধারণ গ্রাহকের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না কেউ কেউ। বিশেষ করে লিজিংগুলোর ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি। বর্তমান অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে এর ভবিষ্যৎ কী- এমন এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই গভর্নর জানান, এর ভবিষ্যৎ মোটেও সুখকর নয়। ব্যাংকিং খাতের সমস্যার অর্থ হলো এটি পুরো অর্থনীতির জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। এতে যে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে; তা কাগজে-কলমে অর্জন হবে, বাস্তবে অর্জন হবে না।
টাকার অভাবে গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অনেক ব্যাংকও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না। গত ১৭ অক্টোবর দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের রামপুরায় অবস্থিত একটি শাখা গ্রাহকের ১৫ লাখ টাকার চেক নগদায়ন করতে পারেনি। গ্রাহককে চেকে টাকার অঙ্কের ঘরে ১৫ লাখ টাকার পরিবর্তে পাঁচ লাখ টাকা লেখার অনুরোধ করেন ওই ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক। পরবর্তী কার্যদিবসে বাকি ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করতে পারবেন এমন আশ্বাস পেয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক চেক সংশোধন করেন। দেশে কার্যত প্রায় অর্ধেক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ অবস্থায় গ্রাহকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির কাছে ধরনা দিচ্ছেন জমানো টাকা উত্তোলনের জন্য। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানও কিছু কিছু ব্যাংকে টাকা রেখে তা ফেরত পাচ্ছে না। সম্প্রতি এমন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নতুন প্রজন্মের ব্যাংক পদ্মা ব্যাংক থেকে তাদের জমানো টাকা উত্তোলনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
সাধারণ গ্রাহকের প্রশ্ন, ব্যাংকে যদি প্রায় এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি উদ্বৃত্ত তারল্য থাকে, তা হলে সাধারণ গ্রাহকের জমানো টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে এমন হয়রানির শিকার হচ্ছে কেন? তা হলে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য দেখানো হচ্ছে, তা কি হিসাবের মারপ্যাঁচে বন্দী রয়েছে? আর সাধারণ আমানতকারীদের অর্থই বা কোথায় গেল?
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তার বেশির ভাগই আদায় হচ্ছে না। কিছু কিছু বড় শিল্প গ্রুপকে ঋণ দেয়া হয়েছে, যারা ঋণ পরিশোধ না করায় পুরো আর্থিক খাতেই অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বয়ং পরিচালকরাই সাধারণ গ্রাহকের আমানতের অর্থ ঋণ আকারে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তা আর ফেরত দিচ্ছেন না। এতে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সাথে বৈঠকের একপর্যায়ে বিআইএফএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এখলাসুর রহমান বলেন, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানির মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত আমানতগুলো ঋণ হিসেবে নিয়ে গেছেন। এর ফলে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়েছে। এসব মালিকের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অবিলম্বে ফৌজদারি মামলা করারও পরামর্শ দেন তিনি।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ অবলোপন, ঋণ নবায়নসহ দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ। এ খেলাপি ঋণ সাতটি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান। অথচ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে মাত্র এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খেলাপি ঋণ আসলে দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংক এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার হিসাব দেখায়। কিন্তু আদালতের স্থগিত আদেশে ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে। ৬৭৫ জন শীর্ষ ঋণগ্রহীতার আবেদনের ভিত্তিতে এ স্থগিতাদেশ দেন আদালত। ফলে সেগুলো ঋণখেলাপির হিসাবে দেখায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এগুলোও খেলাপি ঋণের মধ্যে পড়ে। বিশেষ অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ৯ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণের ২৬ শতাংশ খেলাপি। আবার জাতীয় বাজেট ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক খেলাপি ঋণ।