নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই তীব্র সমালোচনা চলছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলে সাজানো প্রশাসন নিয়ে। সেই প্রশাসন পরিবর্তনের দাবিও দিন দিন জোরালো হচ্ছিল। অবশেষে শুরু হয়েছে পরিবর্তনের পালা; শুরু হয়েছে প্রশাসনের শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদল। গতকাল বুধবার একদিনে ১১ সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। একই দিন চারটি দপ্তরে পদায়ন করা হয়েছে নতুন চার সচিবকে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাংগীর আলমকে। পরিস্থিতিদৃষ্টে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) গুছাচ্ছেন অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
এদিকে, বিগত ১৫ বছর প্রশাসনে বিভিন্নভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন যারা, তারা প্রতিদিন সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ভিড় করছেন ন্যয্যতা ফিরে পেতে। পদোন্নতি-পদায়নের জন্য বিক্ষোভ মিছিলও করছেন কেউ কেউ। বিসিএস বিভিন্ন ব্যাচ ক্যাডার এবং কর্মচারীরাও সরব হয়েছেন দাবি আদায়ে। এ প্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে পদোন্নতি দেওয়া শুরু করেছে। ২৮তম-৪২তম বিসিএসে ক্যাডার পদে নিয়োগবঞ্চিত ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়োগ দিয়ে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যান ভারতে। তার সরকারের পতনের পর শঙ্কিত হয়ে পড়েন দলীয় আনুগত্যের বদৌলতে বিগত ১৫ বছর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা, জেলা
প্রশাসকসহ মাঠপ্রশাসনে বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। বিশেষ করে যারা বিগত তিন সরকারের এমপি, মন্ত্রীদের পিএস ছিলেন, তারা। এসব কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এখন প্রশাসনে রদবদল দেখে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে একের পর এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন যারা, তাদের অধিকাংশই সরকার পতনের পরপরই দপ্তরে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দপ্তরে এসে বঞ্চিতদের রোষানলে পড়েছেন। সচিবালয়ে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে দেখা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তাদের এসিআর গুছিয়ে নিচ্ছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন এতদিন সব সুবিধা নিলেও এখন তাদের যে কোনো সময় বদলি, ওএসডি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্তও আছে নতুন সরকারের। এ জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে যেসব নিয়োগ নিয়ে বেশি বিতর্ক রয়েছে, সেগুলো অনতিবিলম্বে বাতিল করা হবে। আর পর্যায়ক্রমে সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগই বাতিল হবে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল যে ১১ সচিবের
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত যে ১১ সচিবের নিয়োগ বাতিল হয়েছে, তারা হলেন- এনবিআরের সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম, সড়ক, পরিবহন বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া এবং নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম ওয়াহিদা আক্তার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক (সচিব) মো. আখতার হোসেন। এর আগে, গত ৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
চার দপ্তরে নতুন সচিব
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রজ্ঞাপনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) মো. মোকাব্বির হোসেন। কৃষি সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খানকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক (সিনিয়র সচিব) করা হয়েছে লামিয়া মোরশেদকে।
বাধ্যতামূলক অবসরে জননিরাপত্তা সচিব
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাংগীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং সরকার জনস্বার্থে তাকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা প্রয়োজন বলে বিবেচনা করে। তাই ‘সরকারি চাকরি অবসর আইন, ২০১৮’ এর ৪৫ ধারায় দেওয়া ক্ষমতাবলে তাকে সরকারি চাকরি হতে অবসর দেওয়া হলো।
১৩ মন্ত্রণালয়ে নতুন জনসংযোগ কর্মকর্তা
এ দিন তথ্য অধিদপ্তর থেকে এক অফিস আদেশে সচিবালয়ে তথ্য ও জনসংযোগের দায়িত্ব পালনের জন্য ১৩ মন্ত্রণালয়ে ১৩ জন কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সরকারে সিনিয়র সচিব, সচিব ও গ্রেড-১ পদস্থ কর্মকর্তা আছেন ৯৭ জন। তাদের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক ছিলেন ১৪ জন। অতিরিক্ত সচিব ৩৯৫ জনের মধ্যে চুক্তিতে আছেন ১২ জন।
এখনো যারা চুক্তিতে আছেন
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী প্রশাসনে এখনো যারা চুক্তিতে আছেন, তারা হলেন- মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন; বাংলাদেশ দূতাবাস, বার্লিন, জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত (সচিব) মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এনডিসি; প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মার্ট বাংলাদেশের টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির প্রধান পরামর্শক (সচিব) মো. মোস্তাফিজুর রহমান; বাংলাদেশ দূতাবাস, টোকিও, জাপানে রাষ্ট্রদূত (সচিব) শাহাবুদ্দিন আহমদ; জন বিভাগ, রাষ্ট্রপতি কার্যালয় (সচিব) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খান; বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিআইডিএ) নির্বাহী সদস্য (গ্রেড-১) বেগম মোহসিনা ইয়াসমিন; জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড ১) সারওয়ার মাহমুদ; নজরুল ইনস্টিটিউটে নির্বাহী পরিচালক (গ্রেড-১) এএফএম হায়াতুল্লাহ; বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (গ্রেড-১) জিএসএম জাফর উল্লাহ, এনডিসি।
এ ছাড়া ১২ অতিরিক্ত সচিব আছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে।