ডায়েট চার্ট তৈরি করা জরুরি। বয়স, ওজন ও পরিশ্রমের ধরন অনুযায়ী ডায়েট তৈরির সময়ে প্রধানত মাথায় রাখা দরকার, ক্যালরি গ্রহণ আর ঝরানোর হিসাব।
ডায়েট শব্দটা শুনলেই অনেকে ভয় পেয়ে যান। ভাবেন, ডায়েট মানেই ওজন কমানো। শব্দটা শুনলেই অনেকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শসা, টমেটো, গাজরের সালাদ, কিংবা সিদ্ধ সবজি, মসলা ছাড়া খাবার। আসলে কিন্তু তা নয়। একজন মানুষের শরীরের প্রতিদিনের চাহিদা অনুযায়ী ক্যালরি হিসাব করে খাদ্যতালিকা তৈরি করাই হচ্ছে মূলত ডায়েট। ক্যালরির হিসাবটি হয় বয়স, উচ্চতা, লিঙ্গ, শরীরের অবস্থা ও জীবনযাপনের ওপর নির্ভর করে। ব্যক্তিভেদে শরীরের চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করলে তার ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। আবার চাহিদার চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণ করলে ওজন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অনেকেই মনে করেন ডায়েট মানেই ওজন কমানো। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ব্যক্তির ওজন, উচ্চতা, কাজের ধরন, রোগের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে সুস্থ থাকার জন্য যে খাবার পরিকল্পনা করা হয় তাকেই বলা হয় ডায়েট। এ পরিকল্পিত খাবারকে যখন আবার সারা দিনে পাঁচ থেকে ছয়বারে ভাগ করে তালিকা করে দেওয়া হয়, তাকেই বলা হয় ডায়েট চার্ট।’
সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর প্রতিদিন ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ ক্যালরি গ্রহণ করা উচিত। পুরুষদের ক্ষেত্রে যা ২ হাজার থেকে ৩ হাজার। শিশুদের ক্ষেত্রে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ হতে হবে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ৩ হাজার ২০০ এবং ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের জন্য ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ ক্যালরি প্রয়োজন। শারীরিক অবস্থা, সারা দিনের পরিশ্রম ও জীবনযাপনের মানের ওপর নির্ভর করে এ প্রয়োজন কমবেশি হতে পারে।
২০ থেকে ৩০ বছর বা ৩০-ঊর্ধ্ব নারীর অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সঙ্গে বাড়তি ক্যালসিয়াম ও ফলিক অ্যাসিড প্রয়োজন হয়। এ সময় অনেক নারী মা হন বা মা হওয়ার প্রস্তুতি নেন। ফলিক অ্যাসিড গর্ভাবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪০-৫০ বছর বয়সে সাধারণত নারীদের মেনোপজ হতে শুরু করে। এ সময় শরীরে আয়রনের অভাব হয় এবং বিপাক ক্রিয়াও ধীর হয়ে যায়। ফলে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। তাই এ সময় প্রয়োজনীয় আয়রন এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। ৫০-ঊর্ধ্ব নারীদের ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি১২ এবং ফলিক অ্যাসিডের প্রয়োজন হন। এ ছাড়া হাড় ক্ষয় হতে থাকায় তাদের জন্য বাড়তি ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনও প্রয়োজন। মেনোপজের পর যদি লিভার ম্যাগনেশিয়াম সঠিকভাবে শোষণ করতে সক্ষম না হয় তবে ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণও প্রয়োজন।
একজন কর্মজীবী পুরুষের তার প্রতি কেজি ওজনের জন্য অন্তত ২৫ থেকে ৩০ ক্যালরি গ্রহণ করতে হয়। তবে পরিশ্রম, শারীরিক কাঠামো, ওজন, উচ্চতা, বয়সভেদে এ হিসাবে কিছুটা ভিন্নতা আসতে পারে। সাধারণত পুরুষের জন্য ক্যালরি ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ২০০ হয়ে থাকে। তা ছাড়া প্রত্যেক দশকের পর আমাদের একটু করে ক্যালরি গ্রহণ করা কমানো উচিত। কারণ যত বয়স বাড়ে তত আমাদের খাবারের চাহিদা কমতে থাকে। যেমন ধরুন, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে আপনার ডায়েট চার্টে যা থাকবে, ৩০ থেকে ৪০ বা ৪০ থেকে ৫০-এ কিন্তু সেই একই ডায়েট থাকবে না। কিন্তু পুষ্টির সঙ্গে কোনো আপস নয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের চাহিদা এবং প্রয়োজন বুঝেই খেতে হবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নানা ধরনের হরমোনাল চেঞ্জ হয়। ফলে শরীরে এবং মনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। ওজন বেড়ে যাওয়া, শরীর ভারী হওয়ার পাশাপাশি দেখা দিতে পারে অস্টিওপোরোসসি বা মাসল লসের মতো সমস্যা। সবারই যে এগুলো দেখা দেবে তা নয়। কিন্তু সতর্ক থাকতে দোষ কী! আর এ সতর্কতার অন্যতম ধাপ সঠিক ডায়েট।
ফ্রোজেন খাবার, বাইরের তেলেভাজা, জাঙ্কফুড একেবারেই ছেড়ে দিন। বিভিন্ন ধরনের দানাশস্য খান। মটর, ছোলা, রাজমা জাতীয় ডাল ডায়েটে রাখার চেষ্টা করুন। রোজ একটি বা দুটি ফল খান। তবে একদিনে তার বেশি ফল খাবেন না। এর সঙ্গে একটু দুধ বা দুধজাত খাবার খেতে হবে। যারা ওবিস তারা স্কিমড মিল্ক বা ডাবল টোন মিল্ক খান, তেলের ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকুন। তবে এমন নয়, একেবারেই খাবেন না। শরীরে ফ্যাটেরও প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে গুড ফ্যাটযুক্ত খাবার ডায়েটে রাখুন। যেমন বাটার-ঘি। চিনি যতটা সম্ভব কমিয়ে দিন। সঙ্গে অল্পস্বল্প নিয়মিত এক্সারসাইজ রাখুন আপনার প্রতিদিনের রুটিনে।
এ ছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং হাড়ের ক্ষয়। হাড়জনিত সমস্যায় ডায়েটের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য বয়স কম থাকতেই ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যেস করুন। লো ফ্যাট দই, দুধ, ব্রকোলি, আমন্ড ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে দারুণ। চিনি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। এ ছাড়া প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্টও খাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং মিনারেলের সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়। তবে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ না করে খাওয়া ঠিক নয়।
বয়সকালে সবার যে এক সমস্যা হবে তা নয়। কারও বয়সের সঙ্গে শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হয়, কারও বা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়, কারও সুগার বাড়তে পারে। একেকজনের সমস্যা একেকরকম। সুতরাং ডায়েট প্ল্যানটাও আলাদা হতে হবে।