জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১ প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। আট বছর ব্যবধানে এই শুমারির ব্যয় সাড়ে সাত গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০১১ সালে ২৩৭ কোটি টাকায় যে শুমারি করা হয়েছিল এবার তা এক হাজার ৭৬২ কোটি টাকায় প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই শুমারির কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের সন্ধান করছে সরকার। কিন্তু এখনো কোনো উন্নয়ন সহযোগী সাড়া দেয়নি। জিওবিতেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। প্রতিটি সফটওয়ারের দাম ৩৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা ধরা হয়েছে।
প্রবাসে থাকা বাংলাদেশী এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশীদেরও এই গণনায় আনা হবে। আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে বলে একনেক সূত্রে জানা গেছে।
বিবিএস সংশ্লিষ্ট সূত্র ও প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, প্রতি ১০ বছর অন্তর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশে জনশুমারি ও গৃহগণনার কাজ করে। আগামী ২০২১ সালের ষষ্ঠবারের মতো এই শুমারির কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রকল্পটি ২০১৯ সাল থেকে শুরু করার কথা। যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। পরে এটা কমিয়ে এক হাজার ৭৬১ কোটি ৭৯ লাখ টাকায় আনা হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ধরা হয়েছে এক হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর বাকি ১৮৩ কোটি ১১ লাখ টাকা বিদেশি সংস্থা থেকে নেয়া হবে। আর এই সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউএনএফপিএ, ডিএফআইডি, ইইউ, ইউএসএইড এবং কোইকা।
অনুমোদন না পাওয়ার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই শুমারি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। যেটা আগামী ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের সমাপ্ত করার কথা ছিল। উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। এরপর হয়েছিল ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে। ২০১১ সালের কাজে মোট তিন লাখ ১০ হাজার গণনাকারী এই কাজে নিয়োজিত ছিল। যেখানে ব্যয় হয় ২৩৭ কোটি টাকা। এবার এই ব্যয় এক হাজার ৫২৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বা সাড়ে সাত গুণ বেশি।
বিবিএসের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, মূল শুমারি সম্পন্ন হওয়ার এক মাসের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ও মান যাচাইয়ের নিমিত্তে নমুনা গণনা এলাকা থেকে গণনা-পরবর্তী জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। সর্বশেষ ধাপে মূল শুমারির সম্পূরক হিসেবে বিশদ প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড পারসোনাল ইনটারভিউয়ের (সিএপিআই) মাধ্যমে নমুনা গণনা এলাকায় আর্থসামজিক ও জনতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করা হবে। আগামী ২০২১ সালে মার্চ মাসে পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীর দিন ১৭ মার্চ ২০২১কে সেনসাস রেফারেন্স ডে হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ক্ষণ গণনা শুরু করা হবে।
এই প্রকল্পে জরিপ কাজে ৯৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, বিজ্ঞাপন ব্যয় ২৬ কোটি ৩৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, স্থানীয় প্রশিক্ষণ ১৪৭ কোটি ৪৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা, বিদেশে প্রশিক্ষণ তিন কোটি ৯৯ লাখ টাকা, দেশীয় ভ্রমণ অগ্রিম ১৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ১২ জন পরামর্শকের পেছনে ১১ কোটি ৬১ লাখ টাকা, মোটর যান কিনতে ১১ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, মুদ্রণ ও বাঁধাই কাজে ১৩৯ কোটি ৫২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, ম্যাপ তৈরিতে ২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা, কম্পিউটার সফটওয়্যার কিনতে ছয় কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে।
ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৪ হাজার ২৩৮ জনের দেশীয় ভ্রমণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৮ হাজার টাকা। যেখানে মাথাপিছু গড় ব্যয় হচ্ছে ১৪ হাজার ৫০ টাকা। বিদেশে প্রশিক্ষণে জনপ্রতি ব্যয় হবে সাড়ে তিন লাখ টাকা। পরামর্শককে মাথাপিছু দিতে হবে ৯৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ৪১৩টি মোটরযান প্রতিটিতে দর ধরা হয়েছে দুই কোটি ৮১ লাখ টাকা। ছয় কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ১৯টি সফটও্যয়ার কেনা হবে, যাতে প্রতিটি সফটওয়্যারের দর পড়ছে ৩৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা।
বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ষষ্ঠ জনশুমারিতে সব জনগণের পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিক এবং বিদেশে সাময়িকভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিককে গণনার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একটি নির্দিষ্ট তারিখে প্রতিটি খানা ও শতভাগ জনগণকে গণনায় অন্তর্ভুক্ত করে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১ পরিচালনা করা। সব ধরনের আর্থসামাজিক জরিপের জন্য নমুনা ফ্রেম প্রস্তুত করা। জেলাভিত্তিক জনসংখ্যার প্রক্ষেপণ করা। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের জন্য তথ্য সরবরাহ করা। জাতীয় সম্পদ বণ্টন ও কোটা নির্ধারণে তথ্য সরবরাহ করা। চার ধাপে এই জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১ বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে দেশের প্রতিটি খানার তালিকা প্রণয়ন কাজসম্পন্ন করতে হবে। খানা তালিকায় প্রবাসীসহ খানার সব সদস্যের অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং তাদের তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
প্রতিটি খানার জন্য একটি ইউনিক খানা নম্বর ব্যবহার করে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হবে, যা জনশুমারির ফ্রেম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এই ধাপের পর খানা তালিকা হালনাগাদ করণ করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে মূল শুমারি পরিচালনা করা হবে। এতে আইসিআর প্রশ্নপত্র, মোবাইল অ্যাপলিকেশন ও ই-মেইল ব্যবহার করা হবে। মূল শুমারির মাধ্যমে ডিফেক্ট বা ডিজুর পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট রেফারেন্স তারিখের জনসংখ্যা ও খানা সংক্রান্ত সব মৌলিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। ইউএনএফপিএ বাংলাদেশে অর্থায়নের ব্যাপারে সমন্বয় করছে। শিগগিরই উন্নয়ন সহযোগী কনসোর্টিয়াম মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দবিহীন প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এনডিজি) ২৩২টি সূচকের মধ্যে ১৬টি সূচকের তথ্য এই শুমারি থেকে পাওয়া যাবে। আর ৯৭টি সূচকের দিভাজক হিসেবে এর তথ্য ব্যবহার করা হবে। ১৪৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে কতজনকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তা উল্লেখ করা হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় এই শুমারির ব্যয়ের আকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা যৌক্তিক করার জন্য আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ থেকে বলা হয়। তাতে ব্যয় কমিয়ে আনা হয়। কাস্টমস খাতে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ব্যয় অপ্রয়োজনীয় বলে সেটাকে বাদ দিতে হবে। প্রতিটি ব্যয়কে ২০১১ সালের শুমারি এবং চলমান কৃষি শুমারির ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে যুক্তিযুক্ত করার জন্য আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য আবুল কালাম আজাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।