শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৭ পূর্বাহ্ন

গোপনে গোনাহ উত্তরণের উপায়

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৯
  • ৩৭৭ বার

গোনাহ প্রভু ও তাঁর বান্দার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। নির্মাণ করে পরিচয়ের দেয়াল। গোনাহ করতে করতে বান্দা একসময় প্রভুর কাছ থেকে দূরে চলে যায়। মনিব ও গোলামের মধ্যকার যে সম্পর্ক, তা ঘুচে যায়। ফলে স্বভাবতই বান্দা যখন আপদে-বিপদে তার একমাত্র প্রভুকে ডাকে, তখন তিনি সাড়া দেন না। অতঃপর ধীরে ধীরে বান্দা প্রভুর মায়া ও রহমতের ছায়া থেকে ছিটকে পড়ে। আর গোনাহের প্রভাবে তার হৃদয় বা আত্মা কালোতে ছেয়ে যায়। যার প্রভাব তার জীবনেও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। জীবন ও জগতে সে হয়ে উঠে চূড়ান্ত ব্যর্থ ও অপাংক্তেয়।
গোনাহের প্রকার: বান্দাহ যেসব গোনাহে লিপ্ত হয়, তা মোটা দাগে তিন প্রকার। এক. আল্লাহ তায়ালা বান্দার ওপর যেসব ইবাদত ফরজ করেছেন, সেগুলোকে ছেড়ে দেওয়া। যেমনÑনামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি। নামাজ আদায় না করা কবিরা গোনাহ, অনুরূপভাবে রোজা এবং জাকাত আদায় না করাও কবিরা গোনাহ। এ ধরনের গোনাহ থেকে মাফ পাওয়ার জন্য করণীয় হলো, যেসব ইবাদত ছুটে গেছে, তা শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী পরে আদায় করে নেওয়া। আর যদি পরে আদায় করা সম্ভব না হয়, তাহলে যে ক্ষেত্রে তার বিকল্প আছে, যেমন রোজার ক্ষেত্রে ফিদয়া আদায় করা। আর যদি তা-ও সম্ভব না হয়, কিংবা যে ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প নেই; তবে তার জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতে হবে এবং আল্লাহর কাছ থেকে তওবার মাধ্যমে মাফ করিয়ে নিতে হবে। দুই. আল্লাহর হক ও নির্দেশ অমান্য করে গোনাহগুলোতে লিপ্ত হওয়া। যেমনÑমদ পান করা, গান-বাজনা করা, সুদ খাওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের গোনাহের কারণে অবশ্যই লজ্জিত হতে হবে এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, এ ধরনের গোনাহ ও অপরাধ আর কখনও করবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজি (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, এক বান্দা গোনাহ করল। তারপর সে বলল, হে আমার রব! আমি তো গোনাহ করে ফেলেছি; আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন তার রব বলেন, আমার বান্দা কি এ কথা জেনেছে যে, তার একজন রব রয়েছে; যিনি গোনাহ মাফ করেন ও গোনাহর কারণে শাস্তি দেন। আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় কিছুকাল কেটে যায়। এরপর সে আবার আরেকটি গোনাহ করে। তিনি বলেন, তখন সে বলে : ও আমার প্রভু! আমি তো আরেকটি গোনাহ করে ফেলেছি; আমাকে মাফ করে দিন। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জেনেছে যে, তার একজন রব আছেন, যিনি গোনাহ মাফ করেন ও গোনাহর কারণে শাস্তি দেন? আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম (তিনবার); সে যা ইচ্ছা তা করুক। (বোখারি: ৭৫০৭)। তিন. আল্লাহর বান্দা তথা মানুষের অধিকার লংঘনজনিত পাপ ও গোনাহ। এ ধরনের গোনাহ সবচেয়ে কঠিন ও মারাত্মক। যেমনÑ কারও সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করা, চুরি করা, ডাকাতি করা, ছিনতাই করা ইত্যাদি। এসব গোনাহ থেকে মাফ পাওয়ার জন্য মালিক তথা যার অধিকার নষ্ট করেছে তার থেকে ক্ষমা নেওয়া। শুধু আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও অনুতপ্ত হওয়ার দ্বারা এর থেকে মুক্তি পাবে না। উপরোক্ত গোনাহের মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ গোনাহ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা কি জানো অভাবী কে? সাহাবিরা বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী, যার টাকা-পয়সা ও অর্থসম্পদ নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়ায় সালাত, সিয়াম, জাকাত আদায় করে আসবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও মাল-সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এ হকদারকে তার নেকি দেওয়া হবে। আবার ওই হকদারকেও (পূর্বোক্ত হকদার, যার ওপর জুলুম করেছিল) তার নেকি দেওয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে গিয়ে যদি তার (প্রথমতো ব্যক্তির) নেকি শেষ হয়ে যায়; তবে তাদের (পরের হকদারের) গোনাহগুলো ওই ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম: ৬৪৭৩)।
গোপন গোনাহের পরিচয়: এই নিবন্ধে গোনাহের বিশেষ একটি প্রকার সম্পর্কে আলোকপাত করব। তা হলো, গোপনে গোনাহ করা। গোপনে গোনাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে নেক আমল করে, সৎকাজ করে এবং আল্লাহর সব বিধিবিধান মেনে চলে। কিন্তু গোপনে মানুষের আড়ালে গোনাহে লিপ্ত থাকে। এ প্রকারের গোনাহ খুবই মারাত্মক প্রভাব ফেলে। গোপনে গোনাহগার ব্যক্তি মূলত জেনে-বুঝে গোনাহে লিপ্ত হয়। ক্রমান্বয়ে সে তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এর থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। মানুষ যখন জেনে-বুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে গোপনে গোনাহ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন অন্তর থেকে তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় বিদায় নিতে থাকে। অন্তর যখন তাকওয়াশূন্য হয়ে যায়, তখন অন্তর পাথরের মতো শক্ত হতে থাকে। তখন আর অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয় না। মোনাজাতে চোখের পানি আসে না। এক পর্যায়ে তার কোনো আমলে আর মন বসে না। ইবাদত করতে ভালো লাগে না। কোরআন তেলাওয়াত আর আগের মতো মধুর মনে হয় না। ক্রমান্বয়ে সে ধ্বংস ও অধ:পতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে বাঁচতে চায়; কিন্তু বাঁচতে পারে না। অবস্থা তো কখনও এতটা ভয়ানক হয় যে, তার ঈমান পর্যন্ত বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ঈমানহীন অবস্থায়ই তার মৃত্যু ঘটে। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যে, সারাজীবন নেক আমল করেছে। লোকে তাকে ভালো জানত। কিন্তু মৃত্যুর সময় ঈমান নসিব হয়নি। কেউ কেউ আবার ইসলামকেই অস্বীকার করে বসে। পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, মনুষ্যসমাজ তাকে ভালো জানলেও, গোপনে মারাত্মক ধরনের গোনাহে লিপ্ত ছিল।
গোপন গোনাহের উপাদান: বর্তমানে গোপন গোনাহের উপাদান অত্যধিক। হাতের কাছে, বালিশের পাশে গোনাহের অসংখ্য বস্তু। আধুনিক পৃথিবীতে প্রযুক্তির সয়লাবের পাশাপাশি গোনাহের সয়লাবও হয়েছে। যেখানে গোনাহ করলে কেউ কিছু জানতে পারে না। শয়তানের প্ররোচনায় অনেক বড় পরহেজগার মুত্তাকি কঠিনতম গোনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। ইন্টারনেট গোনাহের রাশি রাশি উপাদেয় হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। প্রযুক্তির ভালো দিক যেমন রয়েছে, তেমনি খারাপের দিক ঢের কম নয়। তাই গোপন গোনাহের আশঙ্কা থেকে খুব অল্প মানুষই নিরাপদ।
গোপন গোনাহের ভয়াবহতা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা কেয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালা সমতুল্য নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। সাওবান (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতোই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক, যারা একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত কর্মে লিপ্ত হবে।’ (সুনানু ইবনে মাজাহ: ২/১৪১৮)।
ইবনে রজব হাম্বল (রহ.) বলেন, বান্দার গোপন গোনাহ ও অবাধ্যতার কারণে মন্দ মৃত্যু হয়ে থাকে, যা মানুষ জানে না; চাই তা খারাপ কোনো আমল হোক বা অন্য কিছু। তার এ গোপন চরিত্রই তার মন্দ মৃত্যুর কারণ হয়।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ১/১৭২)। হজরত ইবনুল জাওযি (রহ.) বলেন, গোনাহ থেকে পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকা; বিশেষ করে গোপন গোনাহ থেকে। কেননা আল্লাহর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বান্দাকে তাঁর নজর থেকে ফেলে দেয়। আল্লাহ ও তোমার মাঝে গোপনীয় বিষয় সংশোধন করো, তাহলে তিনি তোমার বহিরাগত বিষয় সংশোধন করে দেবেন। (সাইদুল খাতির: ২০৭)। শায়খ ইবনুল আরাবি বলেন, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত সে-ই, যে মানুষের সামনে ভালো আমল করে; কিন্তু যে মহান সত্তা তার শাহরগ থেকেও অধিক নিকটবর্তী, তাঁর সামনে বদ আমল করে। (তারিখ দিমাশক: ৫/৩৫৬)।
গোপন গোনাহ থেকে উত্তরণের উপায়: এক. সর্বদা এ কথা অন্তরে জাগ্রত রাখা যে, আল্লাহ আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি আমাকে সর্বদাই দেখছেন। আমি যা করি, আমার প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর সামনে। এ ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর পর্যবেক্ষক।’ (সূরা নিসা: ১)।
দুই. বেশি বেশি আল্লাহর কাছে দোয়া করা, কান্নাকাটি করা। যেন আল্লাহ নাফরমানি ও সব গোনাহ থেকে হেফাজত করেন। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে; বস্তুত আমি তো রয়েছি সন্নিকটেই। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করি, যখন তারা আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য, যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ (সূরা বাকারা: ১৮৬)।
তিন. অন্তরের সঙ্গে মুজাহাদা করা, তার কুমন্ত্রণা দূর করা এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর। অতঃপর তাকে অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। আর যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।’ (সূরা শামস: ৭-১০)। তিনি আরও বলেন, ‘যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদের অবশ্যই আমার পথগুলোতে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গেই আছেন।’ (সূরা আনকাবুত: ৬৯)।
চার. যে রাস্তাগুলো গোনাহের দিকে ধাবিত করে, সে রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া। তা এভাবে যে, একাকী না থাকা, বরং সবসময় অন্যদের মাঝে থাকা। পরিবার-পরিজন, স্ত্রী ও সন্তানদের মাঝে থাকা। যদি স্ত্রী থেকে দূরে থাকেন, তাহলে স্ত্রীকে সঙ্গে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। আপনার স্ত্রীর মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র রাখুন এবং আপনার মাধ্যমে আপনার স্ত্রীকেও পবিত্র রাখুন। আর যদি আপনি আপনার পরিবারের কাছেই থাকেন এবং তাদের সঙ্গে বসবাস করেন, তাহলে আপনি তাদের থেকে দূরে যাবেন না। আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসুন। তার মাধ্যমে আপনার প্রয়োজন পূরণ করুন। যখনই আপনার অন্তরে দেখার খায়েশ জাগবে কিংবা কোনো কিছু আপনার নজরে পড়ে যাবে, তখন আপনি শয়তানকে হারামের দিকে আপনাকে নিয়ে যেতে দেবেন না। বরং আপনি দেরি না করে হালালকে গ্রহণ করুন।
পাঁচ. সদা-সর্বদা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। কারণ অবসর সময় মানুষের নষ্টের কারণ। এমন নষ্ট যার কোনো সীমা নেই।
ছয়. সম্ভব হলে মোবাইল থেকে ইন্টারনেট সংযোগ চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করা। হতে পারে মোবাইল সেটটি পরিবর্তন করাই অধিক উপকারী। এমন মোবাইল সেট ব্যবহার করা, যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় না।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com