করোনার আবির্ভাবের পর থেকে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।
তবে কখনো কখনো সীমিত আকারে কদাচিৎ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস খুলেছে। জরুরি প্রয়োজনে বিভাগে এসেছেন দু-একজন শিক্ষক। অথবা, পরীক্ষার কাজে এসে কাজ সেরে তারা আবার দ্রুত বাসায় ফিরেছেন। একে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বলা যায় না।
এমতাবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা যায় না। অবশ্য একুশ সালের গোড়ার দিকে সব কিছু খোলা রেখে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় বিষয়টির সমালোচনা হয়। এর মধ্যে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কিনা সে বিষয়ে লেখালেখি হয়েছে। করোনার প্রাথমিক ধাক্কার পর প্রথমে বেসরকারি এবং পরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অনলাইনে পাঠদান শুরু করেন।
কিন্তু এমন ক্লাস নেওয়ার অনেক অসুবিধা আছে। বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রী অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবার থেকে আগত। তাদের অনেকের ল্যাপটপ বা অ্যানড্রয়েড ফোন নেই। আবার অনেকের ফোন থাকলেও নেট দুর্বল। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। এসব অসুবিধার মধ্যে শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস করতে হয়।
করোনার শুরুর দিকে আমি স্যাবাটিক্যাল ছুটিতে ছিলাম। ছুটি শেষে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বিভাগে যোগ দিলেও আমাকে ক্লাস দেওয়া হয় মে মাসের শেষ সপ্তাহে। তরুণ শিক্ষকদের মতো আমি কম্পিউটারে অভিজ্ঞ নই। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারটি শিখতে আমার সময় লাগে। জুনের প্রথম সপ্তাহে তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষ সম্মান শ্রেণিতে ক্লাস নিতে শুরু করি। তবে সাধারণ ক্লাসের মতো ভার্চুয়াল ক্লাসকে অংশগ্রহণমূলক করাতে পারিনি।
অনেকটা একতরফাভাবে বক্তৃতা দিচ্ছি, আর শিক্ষার্থীরা শুনছে। ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ভাষা দেখতে পারছি না। তারা বুঝতে পারছে কিনা, তাও জানতে পারছি না। সাধারণ সময়েই ক্লাসে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা কম প্রশ্ন করে। আর ভার্চুয়াল ক্লাসে তারা অনেকটাই নীরব থাকছে। আমি প্রশ্ন করলে সে প্রশ্ন শুনে জবাব দিতে তাদের দেরি হয়। অনেকে সময় জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া যায় না। সময় নষ্ট হয়। চ্যাটবক্সেও তেমন কেউ প্রশ্ন লেখে না। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জেলা থেকে অংশগ্রহণ করায় এমন হতে পারে। প্রশ্ন করলে কেউ হয়তো ভাবে অন্য কেউ জবাব দেবে। এভাবে একটি প্রশ্নের জবাব পেতে অনেক সময় লাগে।
জুনের প্রথম সপ্তাহে দুর্নীতি বিষয়ে একটি ক্লাস শুরু করার ঘণ্টা দুই পরে শেষ করব কিনা ভাবছিলাম। শিক্ষার্থীরা কিছুই বলছিল না। জোহরের আজান শুনে বললাম, আজ এখানেই আমরা শেষ করব। তবে তোমাদের ৩ মিনিট সময় দিচ্ছি। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে পার। আধা মিনিট পার হলেও কোনো আওয়াজ নেই। ভাবলাম অনেকক্ষণ ক্লাস করে ওরা ক্লান্ত। ওদের সঙ্গে একটু হাস্যরস করা দরকার। এমন সময় একটি মেয়ের কণ্ঠ শুনলাম।
নেট কানেকশন দুর্বল থাকায় তার প্রশ্ন বা মন্তব্য বুঝতে পারিনি। শব্দগুলো কেটে কেটে এসেছে। আর দেরি করা যায় না। আমি বললাম, তোমার প্রশ্নটি শুনতে ও বুঝতে পারিনি। তুমি এই প্রশ্নটি আগামী ক্লাসে করতে পারবে। তবে আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করি। এ প্রশ্নের উত্তর শুনে ক্লাস শেষ করব। আচ্ছা মনে করো আজ থেকে ছয়-সাত বছর পর তোমার প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে যদি তোমার স্বামী তোমাকে হীরা মণি-মাণিক্যখচিত দামি একসেট জড়োয়া গহনা উপহার দেন তাহলে তুমি কী করবে?
জামাই বাবাজিকে কি এ উপহারের দাম জিজ্ঞেস করবে? জিজ্ঞেস করবে যে টাকা দিয়ে এ উপহার কেনা হয়েছে সে অর্থের বর্ণ সাদা নাকি কালো? মেয়েটি বুদ্ধিমতী। এবার আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাই। সে এক কথায় উত্তর না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে বলে : স্যার, আমি পুঁথির মালা পছন্দ করি। জড়োয়া গহনা ভালো লাগে না। তার উত্তর শুনে খুশিমনে ক্লাস শেষ করি।
এমন নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটছে। তবুও তো ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সংশ্লিষ্ট রাখা যাচ্ছে। এর মধ্যে টিউটোরিয়াল গ্রুপের তালিকা পেলাম। স্বাভাবিক সময়ে টিউটোরিয়াল গ্রুপের ছেলেমেয়েদের দিয়ে অনেক কাজ করাতাম। তাদের কাছ থেকে শিখতামও অনেক। তাদের টিউটোরিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট মনোযোগ দিয়ে দেখে দিতাম। কাটাকাটি ও সংশোধন করে মন্তব্য লিখতাম। তারা বিরক্ত হতো না।
কিন্তু এখন তো সব অনলাইনে। এখন শিক্ষার্থীদের সামনে পাব না। এখন তারা সারা দেশে ছড়ানো। আর তাছাড়া হাতে সময়ও কম। একটি বিষয় বুঝতে পারি না। বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক বিভাগেই টিউটোরিয়াল গ্রুপ দেরি করে কেন করা হয়?
ক্লাস শুরু হওয়ার দুই-তিন মাসের মধ্যে টিউটোরিয়াল গ্রুপ করে দিলে কী এমন অসুবিধা হয়? তাহলে তো শিক্ষকরা ধীরে-সুস্থে শিক্ষার্থীদের দিয়ে কাজ করাতে পারেন। কিন্তু কিছুসংখ্যক বিভাগে পরীক্ষা শুরুর মাত্র দু-এক মাস আগে টিউটোরিয়াল গ্রুপ করা হয়। এমনটা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি? এতে ছাত্ররা পরীক্ষার অব্যবহিত আগে টিউটোরিয়াল করার বাড়তি চাপে পড়ে। অথচ টিউটোরিয়ালটা আগে সম্পন্ন করা থাকলে পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারত।
এর মধ্যে প্রথম বর্ষের ক্লাস প্রতিনিধি টেলিফোন করে টিউটোরিয়ালের প্রসঙ্গ তোলে। ছেলেটি খুবই ভদ্র। তাকে বললাম, বাবা তুমি কি আমার গ্রুপে? সে বলল, না স্যার আমি আপনার গ্রুপে নই। তখন বলি, আমার গ্রুপের একটি ছেলে ও একটি মেয়ের নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দিয়ে আমাকে সহায়তা করতে পার। তোমাকে বিরক্ত করব না। সে দ্রুত আমাকে আমার গ্রুপের তৌহিদ ও ফাহিমার নাম, আইডি ও ফোন নম্বর মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দিল। এই দুজন এবং গ্রুপের অন্য সবার সহযোগিতামূলক আচরণে আমি খুশি হলাম। এদের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কারণ, এরা ভর্তি হওয়ার সময় আমি ছুটিতে ছিলাম। অথচ আমি এদেরকে ক্লাসের জন্য অনলাইন শিডিউল দিলে প্রত্যেকে উপস্থিত হয়। সবার সঙ্গে কথা বলে মন ভরে যায়। তাদের লেখাপড়ার খোঁজ নেই। ওরা একটি-দুটি কোর্সে একটু ক্লাস কম হওয়ার কথা জানায়। বলে, স্যার আপনি আমাদের ক্লাস নিন। বললাম, না আমি ক্লাস নেব না। আমি তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হব। তোমাদের কথা শুনব। তোমাদের সঙ্গে গল্পগুজব করব। তবে গল্প অবশ্যই তোমাদের পাঠ্যক্রমের বাইরের বিষয় নিয়ে হবে না।
সম্ভবত দু-তিনটি ক্লাসের পরই মনে পড়ে, এদের পরীক্ষা আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। কাজেই আমার উচিত হবে তাদের দ্রুত টিউটোরিয়ালের চাপ থেকে মুক্ত করা। এ জন্য অ্যাসাইনমেন্টের দিকে মনোযোগী হই। কাজের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ চাইলে তারা বলে, স্যার আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। আপনি যে কাজ দিবেন আমরা তাই করতে চেষ্টা করব। বললাম, তোমাদের একটি কাজ দেব, নাকি কয়েকটি গ্রুপ করে একেক গ্রুপকে একটি করে কাজ দেব, না প্রত্যেককে পৃথকভাবে কাজ দেব? শিক্ষার্থীরা শেষ প্রস্তাবটি পছন্দ করে। যেহেতু একেকজন একেক জায়গায়, সেজন্য তারা সঙ্গত কারণে গ্রুপে কাজ নিতে চায়নি। ফলে আমার পরিশ্রম বাড়ে। আমি তাদের ওইদিনই আমার মেসেঞ্জারে নক দিতে বলি। প্রত্যেকের মেসেঞ্জারে একটি করে লেখার লিংক দিয়ে ৩০০ শব্দের মধ্যে ওই লেখার রিভিউ লিখে ৯ জুলাই রাত ১২টার মধ্যে মেসেঞ্জারে পোস্ট করতে বলি। একজন বাদে সবাই নির্দিষ্ট সময়ে কাজ জমা দেয়। বাকি ছাত্রটি তার অসুবিধার কথা বলে একটু সময় চাইলে বলি, বাবা তুমি টেনশন নিও না। দরকার হয় তুমি দুদিন পরে হলেও জমা দাও। কিন্তু সে পরদিনই লেখা জমা দেয়। শিক্ষার্থীরা ভেবেছিল আমি হয়তো ওদের লেখা পড়ে নম্বর দিয়ে দেব।
আমি প্রতিটি লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ি। প্রায় সাত থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টা পরিশ্রম করে লেখাগুলোয় দৃশ্যমান ভুলত্রুটি, বানান, বাক্য গঠন, যতিচিহ্নের ব্যবহার, ভাব সংযোগ প্রক্রিয়া, লিখনভঙ্গিমা ইত্যাদি যতদূর পারি সম্পাদনা ও সংশোধন করি। পেশাদার রংমিস্ত্রির মতো লাল, নীল, সবুজ, ফিরোজা, বেগুনি ইত্যাদি রং ব্যবহার করি। নির্দেশনা দেই, মন্তব্য লিখি। বিভিন্ন বর্ণ ব্যবহার করে সম্পাদনার পর তাদের একেকটি ছোট্ট লেখা শিশু শিল্পীর আঁকা রঙিন ছবির মতো মনে হয়। লেখাগুলো পড়ে আমার ভালো লাগে। তবে রিভিউ, সামারি এবং অ্যাবস্ট্রাক্ট যে এক বিষয় নয়, সে বিষয়টি অনেকেই বোঝেনি।
বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই মূল লেখাটি পড়ে তার সংক্ষিপ্তসার লিখেছে। তবে লেখাগুলো যে অন্য কাউকে দিয়ে না লিখিয়ে তারা নিজেই লিখেছে তা বুঝে খুশি হই। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসাবে তারা ভালোই লিখেছে। চর্চা অব্যাহত রাখলে যে এরা পরে আরও ভালো লিখতে পারবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। পরদিন সন্ধ্যায় এদের ফিডব্যাক দিতে গিয়ে প্রথমজনের মেসেঞ্জারে সংশোধিত রঙিন লেখাটি পোস্ট করেই দেখি সব বর্ণ কালো হয়ে গেছে।
কম্পিউটার আনাড়ি হওয়ায় আমি ভয়ে ঘেমে উঠি। ভাবি, সব পরিশ্রম কি বৃথা যাবে? পরে পিডিএফ ফাইল হিসাবে সেভ করে মেসেঞ্জারে দেওয়ার পর খুলে রং ঠিক আছে দেখে আমার ভয় কেটে যায়। দ্রুত ১৭ জনের প্রত্যেকের মেসেঞ্জারে একটি করে পিডিএফ ফাইল পোস্ট করে দিয়ে তাদেরকে আমার ফিডব্যাক দেখতে বলি। কোনো প্রশ্ন থাকলে বা আমার সংশোধনী বা নির্দেশনা না বুঝলে আমাকে মেসেঞ্জারে কল করতে অনুরোধ করি। মাত্র একজন ছাত্র আমাকে ফোন দিলে আমি তার জিজ্ঞাসা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেই। পিডিএফ ফাইল সবাই খুলতে ও পড়তে পেরেছে কিনা জানতে আমি অনেককে ফোন করে জানতে চাই। অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ফোন করে জানি ফাইল খুলতে তাদের অসুবিধা হয়নি। তখন বাকিদের আর ফোন করিনি। কেবল প্রিয়া নামের একজন বলে-স্যার, আমার এখানে নেট দুর্বল। আমি এটি খুলতে পারিনি। আমার ভাইকে দিয়েছি। মনে হয় তিনি পারবেন। যাদের ফোন করি সবার নাম মনে না থাকলেও মাহিমা, তৌহিদ, মামুন, মারিয়া, আদনান, মিম, শাওন, মাফরুহা এবং আরও কয়েকজনের নাম মনে আছে। আমার ফোন পেয়ে এরা খুশি হয়। প্রত্যেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে স্যার, আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। আমি আমার ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি। একটি মেয়ে বলে-স্যার, আপনার নির্দেশনা মোতাবেক লেখাটি সংশোধন করে আবার আপনাকে পাঠাব? আমি বলি, তার দরকার নেই। তুমি বুঝলেই হবে।
আরেকটি মেয়ে বলে-স্যার, আমাদের বাড়িতে বেড়িয়ে গেলে খুশি হব। আমি দুষ্টুমি করে বলি, করোনার কারণে বলছ। স্বাভাবিক সময় হলে বলতে না। সে বলে, না স্যার বিশ্বাস করুন, আপনি এলে আমার ভাইয়া খুশি হবেন। তিনি আপনার লেখার ভক্ত। আমিও ভদ্রতার প্রত্যুত্তরে বলি, তুমি যদি ভাইয়ার সঙ্গে করোনা কমলে কখনো খুলনায় আসো, তাহলে ফোন দিও। স্যারকে দেখে যেও।
সব কিছু মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অনলাইনে ক্লাস নিয়ে এবং তাদেরকে দিয়ে ভার্চুয়াল টিউটোরিয়াল কাজ করিয়ে ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা হয়। শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার ফলে আমার কাজ করা সহজ হয়। এমন সহযোগিতা ও ভদ্রতার জন্য ২০১৯-২০২০ সেশনের ‘খ’ গ্রুপের ১৭ জন শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। পরীক্ষায় তাদের সাফল্য কামনা করি।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়