স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবারো সারা দেশে এনআরসি জারি করার ঘোষণা দিয়েছেন। সবাই জানেন, এনআরসি (National Register of Citizens) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। তিনি তার সব নির্বাচনী বক্তৃতায় নির্ভীকচিত্তে বলেছেন, সারা দেশে এনআরসি বাস্তবায়ন করব। আর অনুপ্রবেশকারীদের বেছে বেছে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। সাধারণ ধারণা হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নিজের ভোট ব্যাংক মজবুত করার জন্য এনআরসি ইস্যু উত্থাপন করে থাকেন। যদি গভীরভাবে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, এনআরসি স্বয়ং ক্ষমতাসীন দলের গলায় হাড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এটাকে না পারছে গিলতে, না পারছে উগলে দিতে। আসামে বিদেশী নাগরিক চিহ্নিত করার জন্য এনআরসির যে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর কর্মকাণ্ড চার বছর ধরে চলছে এবং যে বিষয়ে সরকারের ১৬ হাজার কোটি রুপি ব্যয় হয়ে গেছে, তার নিশ্চিত পরিণতি খোদ বিজেপিরই বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ আসামে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় যে ১৯ লাখ অবৈধ নাগরিককে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে মুসলমানের চেয়ে অমুসলমানের সংখ্যাই বেশি। একারণে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার সুপ্রিম কোর্টে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকার বিপক্ষে মামলা রুজু করেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এ আবেদনকে খারিজ করে দিয়েছেন। কেননা এনআরসি পুরো কার্যক্রম বিজেপির জোরালো দাবির পরেই শুরু হয়েছিল এবং এ কার্যক্রম খোদ সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সর্বাত্মক সতর্কতার সাথে সম্পাদন করা হয়েছে।
গত ২০ নভেম্বর রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, অবৈধ নাগরিকদের চিহ্নিত করার পরিধি দেশব্যাপী বিস্তৃত করা হবে। এর সাথে তিনি এ কথাও স্পষ্ট করে দেন যে, এ ব্যাপারে কারো সাথে ধর্মীয় ভিত্তিতে পার্থক্য করা হবে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথাও বলেন, ‘মানুষের মাথায় এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সম্পর্কে ভুল ধারণা রয়েছে। অথচ এ দুটি পৃথক বস্তু। এনআরসিতে কোনো ধর্মের মানুষেরই চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মিডিয়ায় বেশ আলোচনা হয়েছে। কেননা তিনি এ বক্তব্যে ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে কথা বলেছেন। এটা সম্ভবত এ জন্য হয়েছে, তিনি তার বক্তব্য পার্লামেন্টে দিয়েছেন, যেখানে সব বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টের বাইরে যখন এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে কথা বলেন, তখন তার কথার ঢং ও ভঙ্গি বিশেষ ধরনের কর্কশ ও রূঢ় আকার ধারণ করে। তিনি এনআরসির আগামী পদক্ষেপ হিসেবে যেভাবে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের কথা উল্লেখ করেন, তখন নিঃসঙ্কোচে তাকে সাম্প্রদায়িক ভাষা বলা যায়। তিনি নির্ভীকচিত্তে বলেন, সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করতে যাচ্ছে, যার আলোকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে আগমনকারী অমুসলিমদের ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। তিনি যেসব বিদেশী নাগরিকদের কথা বলেন, তন্মধ্যে হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, জৈন, পারসিক ও বৌদ্ধ ধর্মের লোকদের নাম নেন। কিন্তু মুসলমানদের নাম নিতে তার লজ্জা লাগে। কেননা তার অভিধানে মুসলমানদের নাম নেই। এনআরসির বিষয়টিতে ধাক্কা খাওয়ার পর বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল উত্থাপনের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট বেআইনি ও অসাংবিধানিক। এ বিলের স্বরূপে দেশের ভেতর প্রথমবারের মতো এমন আইন তৈরি হবে, যার দ্বারা মুসলমানদের পৃথক রাখা হবে। এ আইন এ হিসেবে চরম ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকর যে, ভারতের সংবিধান নাগরিকত্বের বিষয়ে কোনো ধরনের ধর্মীয় ভেদাভেদের অনুমতি প্রদান করে না। এ সংবিধান দেশের কোনো নাগরিককেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না।
মজার বিষয় হচ্ছে, যে দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে এ ঘোষণা করেন যে, সারা দেশে এনআরসি বাস্তবায়ন করা হবে, ঠিক ওই দিনই আসামের বিজেপি সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এনআরসি বাতিল করার আবেদন করেছে। বিজেপির প্রাদেশিক সরকারে যুক্ত বাণিজ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেছেন, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা বাতিল করা হোক। গৌহাটিতে এক প্রেস কনফারেন্সের সময় বিজেপির সিনিয়র নেতা শর্মা বলেন, ‘৩১ আগস্ট প্রকাশিত আপডেট এনআরসিতে বেশ ত্রুটি রয়েছে। আর এনআরসির এ ব্যাপক কর্ম স্টেট কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা একতরফাভাবে প্রণয়ন করেছেন। যেহেতু এটা সম্পাদনের জন্য কোনো পরিবর্তনকারী নেই, সুতরাং প্রাদেশিক সরকারের সাথে বিজেপির আসাম শাখাও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেছে যে, এনআরসির বর্তমান রূপকে বাতিল করা হোক।’ আমরা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, হেমন্ত বিশ্ব শর্মা সেই ব্যক্তি, যিনি আসামে এনআরসি বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে সামনের কাতারে ছিলেন। আর প্রতীক হাজেলা তার প্রিয় অফিসার ছিলেন। কিন্তু যখন এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় মুসলমানদের চেয়ে বেশি হিন্দু নাগরিকদের মাতৃভূমি ত্যাগকারী বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো, তখন তার কথার ভঙ্গি ও সুর একেবারে বদলে গেল। প্রতীক হাজেলাকেও আসাম থেকে অন্য কোথাও বদলি করে সরিয়ে দেয়া হলো। এখানে মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, যখন বিজেপির শাসনাধীন রাজ্য আসামেই এনআরসিকে বাতিল করার কথা বলা হচ্ছে, তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোন মুখে এনআরসিকে দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করার কথা বলছেন?
বিজেপি আসামের পর এখন তাদের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু পশ্চিমবঙ্গকে বানাচ্ছে। সেখানে অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের আগে আগে বিদেশী অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি ওঠানো হচ্ছে। অথচ এখানে বিজেপিকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘তার রাজ্যে এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বাস্তবায়ন হতে দেওয়া হবে না।’ তিনি মুর্শিদাবাদে একটি সভায় স্পষ্ট করে বলেছেন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের উদ্দেশ্য দেশের বিশেষ একটি শ্রেণীকে হয়রান করা। তবে এখানে ধর্মের নামে ভেদাভেদ করার অনুমতি দেয়া হবে না। পশ্চিমবঙ্গে কোনোভাবেই এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বাস্তবায়ন করা যাবে না।’ মুখ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি বাস্তবায়নের ফলে লাখ লাখ হিন্দু নাগরিকও এ তালিকায় স্থান পেতে ব্যর্থ হয়ে যাবে। হিন্দুদের মধ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে, হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, পারসিক, জৈন ও বৌদ্ধদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘হিন্দুদের প্রতি সমবেদনার কথা যারা বলেন, তারা জবাব দেন, পরিশেষে লাখ লাখ হিন্দু নাগরিকের নাম এনআরসির তালিকায় যুক্ত হয়নি কেন? আসামে এনআরসির তালিকায় লাখ লাখ গুর্খা নাগরিকের নাম যুক্ত হয়নি।’
প্রশ্ন হচ্ছে, আসামে এনআরসির বিষয়ে হাত পুড়ে যাওয়া সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এনআরসিকে সারা দেশে বাস্তবায়নের কথা কেন বলছেন? এর একটাই জবাব, এ কাজ সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার অধীনে শুধু মুসলমানদের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর জন্য করা হচ্ছে। এ কথা ভারতেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অনুভব করা হচ্ছে যে, বর্তমান সরকার নাগরিকত্ব বিষয়ে মুসলমানদের সাথে প্রকাশ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। এ কারণে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে মার্কিন কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) অভিযোগ করেছে, আসামের এনআরসি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু বানানো ও মুসলমানদেরকে দেশ ছাড়া করার একটি মাধ্যম মাত্র। ওই সংস্থার বক্তব্য, আসামের ভারতীয় নাগরিকদের স্বীকৃতি প্রদানকারী এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখ নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সংস্থার বক্তব্য, কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ধারণা, এটা আসামের বাঙালি মুসলিম বসবাসকারীদের ন্যায্য অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। কমিশন আরো বলেছে, এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য ধর্মকে আবশ্যিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এর দ্বারা বিশালসংখ্যক মুসলমানদের দেশছাড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। নীতি বিশ্লেষক হ্যারিসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনে কমিশন বলেছে, ২০১৯ সালের আগস্টে এনআরসির তালিকা প্রকাশের পর বিজেপি সরকার এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার দ্বারা মুসলমানদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। কমিশন এ কথাও বলেছে, বিজেপি শাসকগোষ্ঠী ভারতের নাগরিকত্বের জন্য ধর্মীয় মাপকাঠিকে চূড়ান্ত করেছে। যেখানে হিন্দু ও বাছাইকৃত সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের জন্য পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। মুসলমানদের সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ২৪ নভেম্বর,
২০১৯ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব