স্বপ্ন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে নির্দেশনা পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআন আটটি স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে এবং স্বপ্ন ব্যাখ্যাকে জ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কোরআনের বাচনভঙ্গিতে প্রতীয়মান হয় যে স্বপ্ন এক ধরনের দিব্য জ্ঞান। নবীদের ক্ষেত্রে যা ওহির সমতুল্য। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত পাঁচটি স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।
১. ইউসুফ (আ.)-কে সেজদা করা বিষয়ক স্বপ্ন : পবিত্র কোরআনে ইউসুফ (আ.) কর্তৃক ১১টি নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্র তাঁকে সেজদা করার এক প্রতীকধর্মী স্বপ্ন বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, ইউসুফ তার পিতাকে বলেছিল, হে আমার পিতা, আমি তো দেখেছি ১১টি নক্ষত্র, এবং সূর্য ও চন্দ্র। আমি দেখলাম তারা আমাকে সিজদা করছে। তিনি বলেন, হে আমার বৎস, তোমার স্বপ্নবৃত্তান্ত তোমার ভাইদের কাছে প্রকাশ কোরো না।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৪-৫)#
শৈশব থেকেই ইউসুফ (আ.) ছিলেন সরল ও সত্যবাদী। এই স্বপ্নের মাধ্যমে সুসংবাদ দেওয়া হয় যে তাঁকে আল্লাহ ১১ ভাই ও মাতা-পিতা অপেক্ষা বহু ঊর্ধ্বে স্থাপন করবেন। ইউসুফ (আ.) ওই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পবিত্র কোরআনে বলা হয়, ‘অতঃপর তারা যখন ইউসুফের কাছে উপস্থিত হলো তখন সে তার মাতা-পিতার জন্য তার সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করেছিল এবং বলেন, আল্লাহর ইচ্ছায় নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন। এবং সে তাঁর মাতা-পিতাকে উচ্চ সিংহাসনে আরোহণ করাল এবং তারা তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল। সে বলল, হে আমার পিতা, এটাই আমার আগের স্বপ্নের পূরণ! আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেছেন।’# (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৯৯-১০০)
২. ইউসুফ (আ.)-এর দুই কারাসঙ্গীর স্বপ্ন : ইউসুফ (আ.)-কে কারাগারে প্রবেশের দিন ঘটনাক্রমে দুজন যুবক কারাগারে প্রবেশ করে। কাতাদাহ (রা.) বলেন, যুবকদ্বয়ের একজন ছিল বাদশাহর সুরাবাহী এবং অন্যজন ছিল তার রুটি প্রস্তুতকারী। আল্লামা সুদ্দি (রহ.) বলেন, তাদের বন্দি করার কারণ হচ্ছে, তারা বাদশাহর খাদ্যে ও পানীয়তে বিষ মেশানোর ষড়যন্ত্র করেছিল বলে বাদশাহ সন্দেহ করেন। কোরআনে তাদের স্বপ্নের বিবরণ নিম্নরূপ—‘তাঁর সঙ্গে দুজন কারাগরে এসেছিল। তাদের একজন বলেছিল, আমি নিজেকে মদ নিংড়াতে দেখলাম। অন্যজন বলেছিল, আমি নিজেকে মাথায় করে রুটি বহন করতে দেখলাম এবং পাখিরা সেখান থেকে খাচ্ছিল। তুমি আমাদের এর তাৎপর্য বলে দাও। আমরা তো তোমাকে ভালো কাজ করতে দেখেছি।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৩৭)#
স্বপ্নের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘হে আমার কারাসঙ্গী দুজন, তোমাদের দুজনের একজন তার মালিকের পানের জন্য সুরা ঢালবে। অপরজন শূলবিদ্ধ হবে। অতঃপর পাখিরা তার মস্তক থেকে খাবে। যে বিষয়ে তোমরা জানতে চেয়েছিলে তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৪১)
৩. মিসরের শাসকের স্বপ্ন : পবিত্র কোরআন ইউসুফ (আ.)-এর সমকালীন মিসরীয় অধিপতির স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যাকে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(মিসরের) অধিপতি বলেছিল, আমি দেখেছি সাতটি মোটা গাভি, যাদের সাতটি শীর্ণকায় গাভি খেয়ে ফেলল এবং সাতটি সবুজ শস্যের শীষ ও সাতটি শুষ্ক। হে প্রধানরা, যদি তোমরা আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারো তবে স্বপ্নের তাৎপর্য বোলো।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৪৩)
আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর ব্যাখ্যা পবিত্র কোরআনে তুলে ধরে বলেন, ‘(ইউসুফ) বললেন, তোমরা সাত বছর একাদিক্রমে চাষ করবে, অতঃপর তোমরা যে শস্য কর্তন করবে, তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ তোমরা আহার করবে; এবং তা ছাড়া আর সমস্ত শীষসহ রেখে দেবে। তারপর আসবে সাতটি ভীষণ বছর। আগে যা তোমরা সঞ্চিত রেখেছিলে, লোকে তা খেয়ে ফেলবে—সামান্য কিছু সংরক্ষিত ছাড়া। সে সময়ের পরে আসবে এক বছর যখন মানুষের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং যখন মানুষ প্রচুর (ফলের রস ও তেল) নিংড়াবে।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৪৭-৪৮)
৪. ইবরাহিম (আ.)-এর স্বপ্ন : ইবরাহিম (আ.) তাঁর সাত বা ১৩ বছর বয়সী পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার যে স্বপ্ন দেখেন তা এমন—তিনি বললেন : ‘হে পুত্র, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে তোমাকে জবাই করছি; এখন তোমার অভিমত কী দেখো।…তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে!’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০২-১০৫)#
‘আত-তাফসির আল-কাবির’ গ্রন্থে ওই স্বপ্ন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে ইবরাহিম (আ.) ৮ জিলহজ রাতে সর্ব প্রথম স্বপ্ন দেখেন একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে জবাই করছেন। অতঃপর ৯ তারিখ রাতে তিনি আবার একই স্বপ্ন দেখেন। ফলে তিনি বুঝতে পারলেন এটা স্বপ্ন। তারপর দশম রাতে তিনি আবার একই স্বপ্ন দেখেন এবং পুত্রকে কোরবানি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন।
৫. বদর বিষয়ক স্বপ্ন : রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিমদের নিয়ে যখন মদিনা থেকে বের হচ্ছিলেন বা পথে কোনো মনজিলে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি স্বপ্নে কাফেরদের সেনাবাহিনী দেখলেন। তাঁর সামনে যে দৃশ্যপট পেশ করা হয় তাতে শত্রুসেনাদের সংখ্যা খুব বেশি নয় বলে তিনি অনুমান করতে পেরেছেলিন। এ স্বপ্নের বিবরণ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করুন, তোমার স্বপ্নে আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছিলেন যে তারা সংখ্যায় স্বল্পসংখ্যক। যদি তিনি তোমাকে দেখাতেন যে তারা সংখ্যায় অধিক, তবে তোমরা নিশ্চয়ই সাহস হারাতে এবং অবশ্যই তোমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বির্তকে লিপ্ত হতে। কিন্তু আল্লাহ (তোমাদের) রক্ষা করেছিলেন, যেহেতু তিনি সবার হৃদয়ের কথা বিশেষভাবে অবহিত।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৩)#
পবিত্র কোরআনের বিধৃত এসব স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা থেকে এটা বলা যায় যে স্বপ্ন জ্ঞানের এমন একটি প্রচ্ছন্ন মাধ্যম যা মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার দৈববাণী। মানুষ অন্তর্দৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক উপায়ে স্বপ্নের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা