চিররঞ্জন সরকার: খাতায়-কলমে আগমনি বার্তা ছিল। সেই সঙ্গেই ছিল ‘সে কি এলো, সে কি এলো না’র সংশয়ও। সেই দোলাচল কাটিয়ে আকস্মিকই আততায়ীর মতো হানা দিল শীত। শীতপ্রেমী বাঙালি এখন শীতের আঘাতে জবুথবু! চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মতো শীতে কাঁপছে সারাদেশ।
শৈত্যপ্রবাহের দাপট দিন দিন বেড়েই চলেছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত ও ঘন কুয়াশা। গত কয়েক দিন ধরে মৃদু শীতল বাতাসের প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকছে চারদিক। রাতভর টুপটাপ শব্দে বৃষ্টির মতো ঝরছে কুয়াশা। তীব্র এ শৈত্যপ্রবাহের কারণে অনেক জেলায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছিন্নমূল মানুষেরা সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। যদিও তা পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক কমেছে। মাত্র গেল সপ্তাহেই শীতের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে ছিলেন শীতপ্রেমীরা। কিন্তু আসি-আসি করেও কিছুতেই স্বমহিমায় ধরা দিচ্ছিল না। এক ধাপ পারদ নামার পরে উঠে যাচ্ছিল দুই ধাপ। এ সপ্তাহে ঠিকই সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ সপ্তাহে পারদ নিম্নমুখী তো ছিলই, আগামী সপ্তাহে নাকি পারদ আরো নিম্নমুখী হবে।
আমরা শহরের নাগরিকরা শীতকালকে খুব ভালোবাসি। আমাদের দেশে শীতকাল অতিথির মতো। কয়েক দিনের জন্য আসে। আর এই অল্প কয়েকটা দিনের জন্যই সোয়েটার পরা, কম্বল-লেপের তলায় যাওয়া আর পানি গরম করে হাতমুখ ধোয়া। এরপর সারা বছর তো ঘামতেই থাকা।
বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে শীত মানেই বনভোজন, বিয়েশাদি, ভ্রমণ আর পিঠাপুলির উত্সব। কিংবা শীত মানে স্রেফ পথের ধারে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ আগুন-গরম চা ধীরে ধীরে উপভোগ। শীত মানেই আনন্দ, ফুর্তি আর অলিখিত উত্সব। আমাদের সামর্থ্যে যত সীমিতই হোক না কেন, এর মধ্যেও আমরা শীতকালকে উপভোগ করি। শীতের সকালে আয়েশ করে রোদ বা আগুন পোহানো, সুস্বাদু পিঠা খাওয়া, খেজুরের রস, পুকুরে মাছ ধরা কিংবা কুয়াশামাখা সবুজ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর মজাগুলো ফিরে আসে।
বাঙালির কাছে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ঋতু বর্ষা; কিন্তু সবচেয়ে রূপসী ঋতু সম্ভবত শীত। এর মতো এমন স্মৃতিকাতরতা আর কোনো ঋতুর নেই। স্বচ্ছ সুন্দর নীল আকাশ, ঠান্ডা ঝিরঝিরে হাওয়া, সোনাঝরা মিষ্টি রোদ নিয়ে শীত আমাদের জীবনকে আনন্দময় করে তোলে। ছয়টি ঋতুর মধ্যে শীত ঋতুটা একদমই আলাদা। আলাদা নানান বৈশিষ্ট্যের গুণে।
সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো ঠান্ডা। ঠান্ডা গায়ে অতিরিক্ত কাপড় তুলে দেয় সকলের। রাতে কম্বল কিংবা লেপের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। শীতের ভয়ে সকলেই মোটা কাপড় জড়িয়ে রাখে গায়ে। তবে এসব কাপড় জড়ালে দারুণ আরামের সঙ্গে সাক্ষাত্ ঘটে। কম্বল অথবা লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে অনেক আরাম। ঘুম হয় বেশ। ঘুমের তৃপ্তি দেবার জন্য শীতরাত বেশ দীর্ঘ হয়ে যায়। লম্বা রাতে লম্বা ঘুম। আহ্। কী আনন্দ!
শীতে গ্রামের সর্বত্রই মধুবৃক্ষ খেজুরগাছ কাটার ধুম পড়ে যায়। মধুবৃক্ষ থেকে গাছিরা সংগ্রহ করে সুমিষ্ট খেজুর রস, তৈরি হয় লোভনীয় গুড় ও পাটালি। রস জ্বালিয়ে ভেজানো পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়বে প্রতিটি পরিবারে। শীতের বিকেলে শীতকালীন খেলাধুলাও লক্ষ করা যায় সবখানে, যা অন্য ঋতুতে চোখে পড়ে না। বিশেষ করে, শীতের সন্ধ্যায় হাই পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন ও ভলিবল খেলা গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দর সর্বত্র দেখা যায়।
তবে শীতের অন্য রূপও আছে, যা আমাদের মধ্যবিত্ত চোখে অনেক সময় ধরা দেয় না। এই শীতে শহরের বা গ্রামের নিঃস্ব মানুষ কীভাবে শীতবস্ত্র পরিধান করবে এই সময়ে? যারা রাত কাটায় পথে-প্রান্তরে, তাদের শিশুদের নিজেদের বুকের ভেতর নিয়ে শীতের রাত্রি পাড়ি দেয়। বৃদ্ধরা ধুঁকে ধুঁকে পাঞ্জা লড়ে নির্মম প্রকৃতির সঙ্গে।
গত কয়েক দিনের শীতে ছিন্নমূল মানুষকে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ঘরহীন অনেক দুঃখী মানুষের পেটে খাবার নেই, গায়ে নেই শীত নিবারণের জন্য এক টুকরো গরম কাপড়। শিশু ও বয়স্ক লোকজন আক্রান্ত হয়ে থাকে শীতজনিত নানা রোগে। শীতজনিত কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুর খবরও গণমাধ্যমে দেখা যায়।
এ অবস্থায় সরকার, প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সচেতন নাগরিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। শ্রমজীবী ও কম আয়ের মানুষগুলো এখন ভয়ানক কষ্টে আছে। অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। শীতে মানুষ কষ্ট পাবে, আর আমরা শহরে বসে লেপ-কম্বল-জ্যাকেট-সোয়েটারে মুড়ে শীত উপভোগ করব, সেটা চরম অমানবিক। চরম শীতে দেশের যেসব জেলার মানুষ কাঁপছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ও কম্বলের ব্যবস্থা করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ।
এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ও সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে পারে। আমি, আপনি, আমরা সবাই যদি সচেতন ও উদ্যোগী হই, তবেই সম্ভব শীতের এই দুর্যাগ মোকাবিলা করা। মানুষের বিপদের সময় তার পাশে থেকে সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা করাই মানুষের মূল ব্রত হওয়া উচিত। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একটি প্রাণ বাঁচে, একজন মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে, একটি শিশু উষ্ণতা পায়, তাতেই হয়তো জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কথা দিয়ে কীভাবে ঘায়েল করতে পারেন, সেই প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকলে চলবে না। তাকাতে হবে সাধারণ দরিদ্র মানুষের দিকে।
তবে শীত আমাদের কষ্ট দেয়। আবার জোগায় প্রতিকূলতাকে জয় করবার এক ধরনের শক্তি। শীতের প্রকোপ কিন্তু আমাদের দেশে আগে থেকেই ছিল। গ্রামে-গঞ্জে ছিল ‘ফায়ারপ্লেসের’ ব্যবস্থাও। যাদের শীত তাড়ানোর লেপ-তোশক কেনার সামর্থ্য থাকত না, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করে রাখত তারা। সেই কয়লা মাটির হাঁড়িতে ভরে তৈরি করত গনগনে আগুন। একফোঁটা ধোঁয়া হতো না। হাঁড়িভর্তি জ্বলন্ত অঙ্গার শোবার ঘরে, বিছানার কাছাকাছি রেখে খানিকটা উষ্ণতা পেত ঘুমের মধ্যে। স্থানান্তরের সুবিধাযুক্ত এহেন ফায়ারপ্লেসটি বলা যায় গরিব বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবন।
এবার শীতে আন্দোলন-সংগ্রামের তেমন কোনো বার্তা নেই। অথচ আমাদের দেশে শীতকাল মানে যেন জেগে ওঠারও কাল। আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, সম্মেলন সাধারণত শীতকালে জমে ওঠে। আমাদের জাতীয় জীবনের তাত্পর্যময় দিবসগুলোও এ শীতকালেই। ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ সবই হচ্ছে শীতকালীন ঘটনা। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানও সংঘটিত হয়েছে শীতকালেই। আসলে শীতকালে এ দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের তেজ চাড়া দিয়ে ওঠে। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে শীতের সবজি ও পিঠা। নানা জাতের, নানা স্বাদের বিচিত্র টাটকা সবজি ও পিঠা খেয়ে শরীরের মধ্যে এক ধরনের টগবগে ভাব আসা স্বাভাবিক। আর শরীরে তেজ থাকলে, তেল থাকলে তা বের হবেই!
একটি পুরোনো কৌতুক মনে পড়ল। সেটি দিয়েই শীতের গল্প শেষ করি…
রাজা : শেয়ালগুলো ডাকছে কেন?
মন্ত্রী : শীতের রাত তো তাই।
রাজা : তাহলে ওদেরকে রাজকোষ থেকে কম্বল দেওয়া হোক।
মন্ত্রী :জি হুজুর, আগামীকালই দেব।
পরের রাতে শেয়ালগুলো যথারীতি আবার ডাকা শুরু করে। এবার রাজা মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, মন্ত্রী! শিয়ালগুলোর ডাক থামেনি কেন?
মন্ত্রী : কম্বল পেয়ে ওরা হুজুরের শোকর-গুজার করছে।
তার পরের রাতে রাজা আবারও মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, মন্ত্রী, ওরা কতদিন শোকর-গুজারি ডাক ডাকবে?
মন্ত্রী : যতদিন ওরা আপনার দেওয়া কম্বল ব্যবহার করবে!
n লেখক :রম্যরচয়িতা