শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির চিন্তাদর্শনের মৌলিক অবকাঠামোর দিকে যদি চোখ বুলাই, তার চিরায়ত গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ যদি অধ্যয়ন করি, তাহলে এই বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায় যে— শাহ সাহেবের দৃষ্টিতে নবী-রসুলদের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ যেভাবে আত্মিক বিকাশ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিকে আল্লাহওয়ালা (রব্বানি) হতে প্রেরণা দেয়, ঠিক সেভাবেই সমাজ ও সভ্যতা উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দান করে।
শাহ সাহেবের মতে নবুয়তের উদ্দেশ্য ব্যক্তির অষ্টপ্রহরের জীবন— ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে জাগতিক কারবার, সংস্কৃতি ও অবসরও ইসলামি নীতির অধীন। এবং নবুয়তের উদ্দেশ্য ‘দুনিয়ায় কল্যাণ’ ও ‘আখেরাতে কল্যাণ’ দুটোই নিজের মধ্যে শামিল করে, দুই ক্ষেত্রেই চলে তার কার্যপ্রক্রিয়া।
নবুয়তের এই সংজ্ঞা যদি আপনাদের বোঝাতে পারি তাহলে নিশ্চয় ইবনে খালদুনের নবুয়তের সংজ্ঞার ‘অযথোচিত’ হওয়ার বিষয়টি সাফ সাফ নজরে আসবে।
ইবনে খালদুনের মতে নবুয়তের প্রয়োজন কেবল আখেরাতের জীবনে সাফল্য লাভের জন্য। জাগতিক নিয়মকানুনে, অর্থাৎ রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নবুয়তের প্রয়োজন নেই।
নবুয়ত প্রসঙ্গে ইবনে খালদুনের এই মতদর্শন আরবীয় সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিতে ভয়াবহ রকমের প্রভাব ফেলেছে। আরবরা ইবনে খালদুনের প্রভাববলয় অতিক্রম করে অন্যকোনো মতদর্শন বা দার্শনিকের দ্বারস্থ হতে পারেনি।
আর ঘটনাচক্রে ইবনে খালদুনের নবুয়ত প্রসঙ্গে মতদর্শন যেহেতু স্রেফ পরকালীন জীবনের জন্যে সীমাবদ্ধ, ইহকালীন ক্ষেত্রে নবী-রসুলদের প্রয়োজনীয়তা অনুপস্থিত— তাই সুনিশ্চিতভাবে তার এই মতদর্শন মানুষকে নবী-রসুলদের আর্থসামাজিক দিকনির্দেশনার অনুসরণ থেকে নিরুৎসাহিত করে, এবং স্পষ্টতই কোনো জাতি ও সমাজের জন্য এর ফলাফল ভালো কিছু বয়ে আনে না।
ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে, নবুয়তকে কেবল পরকালীন নির্দেশনা ভাবার ফলে আজকের আরবরা জাগতিক নিয়মকানুনে খুব সহজেই ইউরোপীয় পণ্ডিতদের প্রোপাগান্ডার শিকার হয়েছে।
অন্যদিকে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির নবুয়ত প্রসঙ্গে মতদর্শন অধ্যয়নে যেকোনো ব্যক্তি এই ধরনের প্রোপাগান্ডায় শিকার হওয়ার মুসিবত থেকে সবসময় নিরাপদ থাকবে।
শাহ সাহেব মানুষের ‘সর্বপ্রধান’ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের (মন বা মস্তিষ্ক) সঙ্গে ‘অপেক্ষাকৃত কম প্রধান’ অঙ্গপ্রত্যঙ্গও (পেট ও যৌনাঙ্গ) জুড়ে দিয়েছেন। এই ‘অপেক্ষাকৃত কম প্রধান’ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে জীবনের বুনিয়াদ আখ্যা দিয়ে শাহ সাহেব একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্নের সমাধান দিয়েছেন।
সাধারণত অধিবিদ্যা ও দর্শনের আলোচনা শুরু হয় মানুষের মাস্তিষ্কিক ক্ষেত্র থেকে, যদিও মানুষের জীবনযাপনে অর্থনীতির ক্ষেত্রকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু উচ্চতর ভাবনার জগতে অর্থনীতির অনুপ্রবেশকে মোটেও স্বাগত জানানো হয় না।
মানুষের জীবনকে এইভাবে ‘মস্তিষ্ককেন্দ্রিক’ দেখার ফলে আমাদের রাজনীতি একেবারে অন্তসারশূন্য হয়ে পড়েছে। আমাদের এখানে পণ্ডিতশ্রেণির লোকেদের বেশি থেকে বেশি বুদ্ধিবৃত্তির গুণসম্পন্ন ভাবা হয়, এবং অরাজনৈতিক মনোভাবকে উচ্চতর গুণ ভাবা হয়।
সুতরাং তাদের মতে রাজনীতি— যা নাগরিকদের জীবনের প্রাত্যহিক কাজকর্ম জুড়ে আছে, তা ‘ছোটখাটো’ ও ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ জিনিস।
এর বিপরীতে গিয়ে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায়’ বেশ কয়েক জায়গায় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার মতে মানুষের আত্মিক ও মানসিক বিকাশ খুব বেশি পরিমাণে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ওপর নির্ভর।
এক জায়গায় তিনি বলেন: ‘মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সব ছন্দ ওই সময় বেগতিক ও বরবাদ হয়ে যায়, যখন কোনো জালেম সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যতা সৃষ্টি করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, আর মানুষ গরু-গাধার মতো স্রেফ দুই লুকমা খাবারের জন্য সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যায়। যখন মানুষের ওপর এহেন মুসিবত আসে, তখন আল্লাহ সেই মুসিবত থেকে উদ্ধার করতে কোনো না কোনো উপায় বের করে দেন। তিনি তার নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মনে বার্তা পাঠান। ফেরাউনের ডুবে মরা, সিজার ও কিসরার ধ্বংস এই মূলনীতির ওপর নবুয়তের জন্য আবশ্যকীয় নির্দেশনা হিসেবে গণ্য হবে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, বাবু ইকামাতিল ইরতিফাকাত ও ইসলাহির রুসুম)
যদি মানুষের জীবনকে পেট ও পিঠের প্রয়োজন থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ পর্যন্ত একই ধারা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে যেই দর্শন তৈরি হবে তাকে পরিপূর্ণ বলা সম্ভব।
এইজন্য মানুষের জন্য সামগ্রিকভাবে এমন এক অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করা জরুরি, যা তার সামগ্রিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ নিশ্চিত করবে।
সুতরাং যখন মানুষ জৈবিক চাহিদা থেকে নিশ্চিন্ত হবে, তার কাছে ভাত-কাপড়ের ফিকির করার বাইরেও সময় থাকবে, তখনই গিয়ে উচ্চস্তরের মাস্তিষ্কিক কাজে মনোনিবেশ করার ফুরসত পাবে। যেই চিন্তাদর্শন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাকে একটি পরিপূর্ণ জীবনদর্শন বলা ভুল হবে না।
মানুষ যখন অর্থনৈতিক অন্যায্যতার দুরবস্থায় পড়ে, তো আল্লাহ তাআলা কখনো নবী-রসুলদের নির্দেশ পাঠিয়ে আবার কখনো আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং দার্শনিকদের মনে বার্তা পাঠিয়ে সেখান থেকে মানুষদের উদ্ধার করেন।
তারপর যখন অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে প্রথম কদম ফেলার সুযোগ পায়, এভাবে একসময় চূড়ান্ত বিকাশের মঞ্জিলে পৌঁছে। এই দুনিয়ায় যদি মানুষ আত্মিক বিকাশের মওকা পেয়ে তা কাজে লাগাতে পারে, তাহলে মৃত্যুর পরে কবরে ও হাশরের ময়দানে তারা মুসিবত থেকে নাজাত পায়।
আসল কথা হলো মৃত্যু পরবর্তী জগতে জান্নাতের নাজ-নেয়ামতে যে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন কাটাবে, তা পার্থিব জীবনে আত্মিক বিকাশেরই ফল। দুনিয়ায় আল্লাহর খলিফা হওয়ার হুকুম তামিলের সুন্দরতর পরিণতিই ঘটবে সেখানে।
এই দুনিয়া হলো পরীক্ষাকেন্দ্র। এখান থেকে উত্তীর্ণ হতে পারলে পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবে। মানুষ প্রথমে রুহের জগতে ছিল, সেখান থেকে এই দুনিয়ায় এসে পৌঁছেছে, তো এখানে যদি কামিয়াবি হাসিল করে তাহলে তৃতীয় ধাপে গিয়ে ‘আল্লাহর দর্শনলাভের’ পরম আরাধ্য সৌভাগ্য হাসিল করবে।
খেয়াল করে দেখুন, মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে দর্শনের শৃঙ্খল ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আর শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির চিন্তাদর্শন এতবেশি অর্থপূর্ণ, বহুমাত্রিক, বিশ্বব্যাপী এবং সার্বজনীন যে, তা মানুষের জীবনের প্রথমদিনের প্রয়োজনীয়তা (যাকে আমরা প্রাণীর জীবনরক্ষার আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে মানি) থেকে শুরু করে মানব জীবনে আত্মিক ও মানসিক বিকাশের যতগুলো পর্যায় আছে— সবগুলোকে শামিল করে নেয়।
যদি এই চিন্তাদর্শনের ভিত্তি নবুয়তকে মেনে নেওয়া হয়, এবং নবী-রসুলের অনুপস্থিতিতে তাদের অনুসৃতপন্থায় সৎকর্মশীল উত্তরাধিকার ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ যদি সেই কাজ আঞ্জাম দেয়, তাহলে নবুয়তের শিক্ষা কত বেশি ফিতরতি বা প্রাকৃতিক হয়ে যায়।
আর নবুয়ত প্রসঙ্গে যে বিভ্রান্তিকর ধারণা জনমানসে ছড়িয়ে গেছে— নবুয়তের উদ্দেশ্য কেবল পরকালীন জীবন— এই ধারণার মূলোৎপাটন করে নবুয়তের প্রকৃত অর্থ ‘দুনিয়ায় কল্যাণ’ ও ‘আখেরাতের কল্যাণ’-এর বিশ্বাস মানুষের মনে গাঁথা যাবে।
এই হলো শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির প্রজ্ঞা ও চিন্তাদর্শনের মূলকেন্দ্র— এতক্ষণ যেই বিষয়ে বললাম।
সূত্র: মন ও মননের কথা/ মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি